“এই জনহীন প্রান্তর, এই রহস্যময়ী রাত্রি, অচেনা নক্ষত্রে ভরা আকাশ, এই বিপদের আশঙ্কা – এইতো জীবন। শান্ত নিরাপদ জীবন নিরীহ কেরানীর জীবন হতে পারে – তার নয় -”
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
||১৩||
একজন হাত ঘষে ঘষে মুছছে।
-“আর ভাল্লাগেনা মাইরি… জঙ্গলে ভূত, পাঁচিলের পেছনে ভূত… তার ওপর এই কাঁদুনে বৃষ্টি।”
শ্বেতাংশুর মুখ তখনো গম্ভীর; সে অসীমাভের পাশে এসে বসে তার কথায় সায় দিয়ে বলল,
-“যা বলেছিস ভাই…”
মৈনাক কোনো কথা না বলে এসে বিছানায় বসে পড়ল। বাইরে বৃষ্টির দাপট বাড়েনি ঠিকই, কিন্তু ঝিরঝির শব্দের কোনও বিরাম নেই।
-“এটা একটা নতুন উপসর্গ, আজ যেটা হল…” -এবার মুখ খোলে মৈনাক।
-“উপসর্গের লিস্টি দিন দিন বেড়েই চলেছে ভাই…” -শ্বেতাংশু জবাব দেয়।
-“না না, ঠিকই, কিন্তু এ ব্যাপারে তোর কি মতামত ? মানে আমাদের মধ্যে তুইই প্রথম দেখতে পাস ব্যাপারগুলো…”
-“হ্যাঁ, সেটা ঠিক, তাহলে এখনো অবধি উপসর্গের ফর্দ দাঁড়ালো এক, পাঁচিলের পেছনে মেয়েদের গলার শব্দ; দুই, জঙ্গল থেকে আর আকাশ থেকে কিছু একটা বিরাট বড় জিনিস নেমে আসছে; তিন, একটা ছায়ামূর্তি যার চোখ আগুনের মতো জ্বলে; চার, ভারী পায়ের শব্দ, যার পা তাকে দেখা যায় না, কিন্তু পায়ের ছাপ পড়ে; আর পাঁচ, জঙ্গলে ঘ্যাঁষঘ্যাঁষে করাত চালানোর মত শব্দ।”
-“তুই ওটাকেও উপসর্গের মধ্যেই ধরছিস ? জঙ্গলের শব্দটাকে ?” -শ্বেতাংশুর প্রশ্ন।
-“হ্যাঁ, ভাই, ধরছি। কারণ জঙ্গলের শব্দটা শুরুর আগে এক থেকে চারের মধ্যের কোনো একটা করে উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। আর ভুলে যাস না, এখনো অবধি কিন্তু দিলীপ বাবু জঙ্গলে গিয়ে কিছু পাননি।”
-“এখন এর মধ্যে অনেকগুলো কি আর কেন জুড়ে রয়েছে। জঙ্গলের ছায়ামূর্তিটা কি ? জঙ্গল থেকে ওটা কি, যেটার শুধু আকার বোঝা যাচ্ছে, আর কিচ্ছু না ? হাসি আর কথা বলার শব্দটা ওখানে কেন শোনা যাচ্ছে ? আর সবথেকে ইম্পর্টেন্ট; তুই সবার আগে কেন এসব দেখলি ?
অসীমাভর কথায় হেসে ফেলে মৈনাক;
-“তুই তো রীতিমত ভূতের প্লটকে গোয়েন্দা গল্প বানিয়ে ছাড়বি দেখছি ভাই ! একটা কথা বলি শোন, মানে এটা আসলে আমার অনেকদিনের বিশ্বাস, ভূত, মানে অপদেবতা, কনসেপ্টটাই তো গোলমেলে, ইল্লজিক্যাল। এখন সেখানে তুই লজিক খুঁজতে গেলে হবে কি করে ভাই ? না, ‘ভূত আছে’ এর থেকে অযৌক্তিক কথা পৃথিবীতে কিছু আছে কি ? এখন বলিউডি সিনেমার মতো বা কাঁচা হাতে লেখা খাজা ভূতের গল্পের মতো তুই যদি কি ভূত, কেন ভূত সব খুঁজতে যাস, তাহলে তো মুশকিল।”
অসীমাভ কিছু বলার আগেই শ্বেতাংশু বলে ওঠে,
-“কথাটা মন্দ বলিসনি, মৈ। আসলে আমাদের মানসিকতাটা কিরকম বলত ? ভাঙব, তবু মচকাবো না। যতক্ষণ মুখে বলছি ভূত মানি না, ভূত মানি না, ভূত অযৌক্তিক; ঠিক আছে, এবার ভূতের দেখা পেলে তখনো যুক্তির প্যাঁচ মারতে পিছপা হইনা, কি ভূত, কেন ভূত ইত্যাদি। আসলে যুক্তি খোঁজার সীমা-পরিসীমা নেই কোনো। ভূতের আগে যুক্তি, না হলে ভূতের পড়ে যুক্তি।”
-“হয়েছে, তোদের ভাট বকা ? এবার আমি বলি ? দেখ, তারাদার সাথে একদিন কথা হয়েছে, তাতেই জানা গেছে এই লেপার্ডস নেস্টের এলাকার মধ্যে, একটা অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু এখনো জানা হয়নি, রিসর্টটা কেন বন্ধ হল। আর রতনের সাথেও কথা হয়নি এ নিয়ে। তো সেগুলো জানার পর তখন তোদের থিওরী অথবা থিওরীর এই অভাব নিয়ে ভাবা যাবে না হয়?”
-“বেশ, সে না হয় মানা গেল, তাহলে ওই ছায়ামূর্তিটা, মানে যার জ্বলন্ত চোখ, সেটাকে আমি বক্সা দুয়ারে দেখলাম কেন ? মানে যেদিন আমরা রাতে লেপচাখা গিয়ে আটকা পড়লাম, সেইদিন রাতে ?”
এবার অসীমাভর চোখগুলো বড় বড় হয়ে যায়।
-“তুই বক্সাতেও ভূত দেখেছিস ? আগে বলিস নি কেন ?”
-“আগে বলিনি, মানে তোদের বলিনি… স্যারকে পরের দিন সকালেই বলেছিলাম। তোদের সাথে কথা হওয়ার পর বলিনি কারণ, ফ্র্যাঙ্কলি, অত ভেবে দেখিনি। এখানে ভূত না ওখানে ভূত… এখানে তো সর্বত্রই একটা না একটা ভূতের গল্প চালু আছে… কোথায় খুনিয়ার জঙ্গলে নিশীর ডাক, তো বক্সা ফোর্টে কয়েদিদের ভূত… তুই প্রথম লেপার্ডস নেস্টের সাথে ভূতের ডাইরেক্ট কো-রিলেশন স্থাপন করতে আমার মাথায় এল…”
এবার শ্বেতাংশু, অসীমাভর গলা এবং হাবভাব নকল করে বলল,
-“তার মানে, এই ভূত নিশ্চয়ই মৈনাকের প্রেমে পড়ে ওকে ফলো করছে, আর সেদিন অসীমাভ মৈনাককে ঝাড়ছিলি বলে তোকে বোঝাতে এসেছিল, ঠাকুরপো, আমার বরের সাথে ঝগড়া কোর না। অথবা, প্লট ট্যুইস্ট !!! ড্রামরোল প্লিজ… মৈনাকই হল ভূত, যে মানুষের ছদ্মবেশে আমাদের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে…”
অসীমাভ ব্যাজার মুখে শুয়ে পড়ে, মাথা অবধি কম্বল টানতে টানতে বলে,
-“শুয়ে পড়… কোন পাপে শালা এদের সামনে মুখ খুলেছি…”

সেদিন বাকী রাতটা নির্বীঘ্নেই কেটে যায়। আশ্চর্য্যের ব্যাপার হল, যবে থেকে শ্বেতাংশু আর অসীমাভ অলৌকিকের আশ্বাস পেয়েছে, তবে থেকে মৈনাকের ভয়টা কেটে গেছে অনেকটাই। বাকী দু’জনের মনের কথা সে জানে না, কিন্তু দু’বেলা ঘুমের বহর দেখে তারাও বিশেষ আতঙ্কে রয়েছে বলে তো মনে হয় না। আসলে অলৌকিকের মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে বেশী ভীতিপ্রদ হল পরিবার-বন্ধুদের কাছ থেকে সমর্থন না পাওয়া, সাহায্য না পাওয়া। যে কথা স্বীকার করলে বেশিরভাগ সময়েই সবার কাছে হাসি বা অবহেলার পাত্র হতে হয়, সে সব কথাই মানুষ মনে চেপে রেখে একলা যুঝতে চায়, আর তারই ফলাফল আরও ভয়, মানসিক অবসাদ… শ্বেতাংশু আর মৈনাকের সাথেও একই ঘটনা ঘটার পর থেকে, মৈনাক তাই অনেকটাই এত আতঙ্কের মধ্যেও কেমন নিশ্চিন্ত বোধ করছে।
সকালে স্যার তোলেন ওদের ঘুম থেকে। তৈরী হয়ে বেরিয়ে পরা হয় সাখামের পথে। সাখাম সান্তালাবাড়ির থেকে অনেকটাই দূর, এবং দিলীপবাবুর এলাকাও নয়। তবে উনি ওখানকার বীট অফিসারের সাথে কথা বলে নিয়েছেন, কোনও সমস্যা হবে না, সাখামের ফরেস্ট বাংলোয় এক-দুদিন থাকার ব্যবস্থাও হয়ে গেছে। আর তারাদা তো সঙ্গে থাকছেই; তার তো আর এলাকার বালাই নেই; গোটা উত্তরবঙ্গই তার এলাকা।
রাত থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টিটা এখন ইলশেগুঁড়ির পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে; আকাশ কালো হয়ে আছে, কিন্তু বৃষ্টি আর বাড়বে বলে মনে হচ্ছে না। তবু, স্যারের নির্দেশে, জীপের খোলা মাথা ঢেকে ভেতরে সুবোধ বালক-বালিকাদের মতো বসতে হলে সবাইকে। আর সেই জন্যই আজ দু’টো জীপ নিতে হল। নাহলে একটা জীপেই হইহই করে যাওয়া যেত, যেমন খুনিয়া যাওয়ার দিন গেছিল ওরা। সকাল আটটা নাগাদ রওনা দেওয়ার সময় তারা দা বলেছিল, ‘রাস্তা মাঝে মাঝে খারাপ আছে, অন্তত দু’ঘন্টা লাগবেই’। তো সেই হিসেব ধরে কিছু খেয়ে, কিছু রসদ রাস্তার জন্য নিয়ে বেরিয়ে পড়া হয়েছিল।
আপাত খারাপ রাস্তা পেড়িয়ে ভালো রাস্তায় গাড়ি ওঠা মাত্রই, শ্বেতাংশু গান ধরল
বনে নয়, মনে মোর পাখি আজ গান গায়…
কিন্তু ‘ঝিরিঝিরি হাওয়া দোলা দেওয়ার’ আগেই ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে বেরসিক জীপ তার তাল কেটে দিল। সামনের জীপে তারাশঙ্করের সাথে ছিল মৈনাক, পল্লবী, অসীমাভ আর শ্বেতাংশু। পেছনের জীপে স্যারের সাথে বাকি ক’জন। তারাদা আর জীপ ড্রাইভারের কাঁধের মাঝখান দিয়ে উইন্ডস্ক্রীনের ওপাশে যে দৃশ্যটা দেখল ওরা, সেটা দেখে প্রকৃতই চক্ষু চরকগাছ হয়ে গেল সবার। রাস্তার মাঝখানে, গোটা রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে আছে একজোড়া হাতি, তার মধ্যে একটা দাঁতাল, এবং তার দাঁতদুটো বড়ই অদ্ভূত; একটা দাঁত ওপরদিকে আর একটা নীচের দিকে কিঞ্চিৎ বেঁকানো। দুটো হাতিই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। মৃদু মৃদু শুঁড় আর কান না নাড়লে, সেগুলোকে মূর্তি বলে ভুল হত। গাড়ির মধ্যে একেবারে পিন ড্রপ সাইলেন্স। সবাই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে হাতিদুটোর দিকে। ড্রাইভার গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করেনি ঠিকই, কিন্তু একহাত স্টীয়ারিং আর একহাত গীয়ার লিভারে রেখে অপেক্ষা করছে ধূর্ত শিকারী বাঘের মতো; বেকায়দা বুঝলেই যাতে গাড়ি ছোটাতে পারে।
তবে, সে সবের কিছুরই দরকার হল না। দেখা গেল, বাঁদিকের জঙ্গল থেকে ভীরু ভীরু পায়ে একটা বাচ্চা হাতি বেরিয়ে এল। একটু এঁকেবেঁকে হাঁটতে হাঁটতে চারদিকে দেখে নিয়ে রাস্তা পেরিয়ে উল্টোদিকের জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। এতক্ষণ রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা দুই অভিভাবক হাতিও এবার রাস্তা ছেড়ে দিল। দু’টো জীপই হুস হুস করে বেরিয়ে গেল। সবার আগে পল্লবীই মুখ খুলল,
-“কি কিউট !!!”
-“ওর বাবার দাঁত গুলো দেখেছিলি তো ? দাঁত তো নয়, যেন পাইপ রেঞ্চ !!!” -শ্বেতাংশু মন্তব্য করে।
-“ও আমাদের এই অঞ্চলের আর এক বিখ্যাত টাস্কার। ওই ব্যাঁকা দাঁতের জন্য ওর নাম আকাশপাতাল। তবে ডুয়ার্সের হাতিদের মধ্যে সব থেকে ফ্রেন্ডলি। এখন বাচ্চাটা সঙ্গে ছিল তাই, নাহলে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ফটোর জন্য পোজ টোজ দেয়।”
তারাদা-এর এ কথায় সবাই হেসে ফেলে।
-“আচ্ছা, তারা দা, সাখামে যেখানে থাকব, সেখানটা কিরকম ?”
-“এখানকার থেকে জঙ্গল অনেকটাই ঘন; বাংলোটাই জঙ্গলের মধ্যে; সুতরাং রাতে বেরোনো এক্কেবারেই মানা। আর সাখামে আদিবাসী বেশী, আর রাতে তারাও জঙ্গল থেকে দূরেই থাকে, আর কাউকে ঢুকতেও দেয় না…”
-“কেন ?”
-“ওখানকার লোকেদের বিশ্বাস রাতে জঙ্গল জীবন্ত হয়ে ওঠে। গাছের প্রাণ আছে এটা ওরা যুগ যুগ ধরে মেনে আসছে, তার সাথে ওরা এটাও মনে করে যার প্রাণ আছে, সে মরলে ভূত হবেই। আর জঙ্গলের সব মরা গাছেরা নাকি রাতে জঙ্গলে আবার নিজের জায়গায় ফিরে আসে, তাই পাল্টে যায় জঙ্গল। যে জায়গা দিয়ে তুমি হাজারবার গেছ, সে জায়গাও এক্কেবারে অচেনা মনে হয় রাতে…”
-“মানে গাছ-ভূত ?” -অসীমাভ ব্যাজার মুখে বলে।
-“গাছ ভূত ঠিক নয়… আসলে বহুদিন জঙ্গলে থাকলে দেখবে জঙ্গলটাকে সত্যিই একটা জীবন্ত জিনিস মনে হবে; তার একটা সত্ত্বা আছে। তাই তার প্রাণ আছে, রূপ আছে, মনখারাপ আছে, আবার আনন্দও আছে… আর আমাদের মতো দু’পেয়েরা জঙ্গলের সাথে যা দূর্ব্যবহার করছি, তাতে সেই সত্ত্বার মৃত্যুও হয়তো আমাদের হাতেই লেখা। তোমরা তো জঙ্গলে গাছ কাটা দেখোনি; ধর একটা ঘন জঙ্গলের কয়েকটা গাছ কাটা হল, সেখানে একটু খালি জায়গা হল, রাতে যখন চারদিক নিস্তব্ধ, তখন সেইসব জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালে গাছের ফাঁক দিয়ে হাওয়াটা যখন কেটে এসে পৌছোয়, তখন মনে জঙ্গল কাঁদছে, হাহাকার করছে…”
তারাদার কথায় সবাই চুপ করে যায়। মৈনাকের মনের মধ্যে একটা চিন্তা এল এই কথাগুলো শুনে। কিন্তু গাড়িতে পল্লবী থাকায় কথাটা তখনই বলতে পারল না।
-“তবে সাখামের জঙ্গলটা নর্থ বেঙ্গলের জঙ্গলগুলোর মধ্যে যাকে বলে… ইউনিক…”
-“ইউনিক কেন ?”
-“জঙ্গলের নেচারটাই আলাদা। হ্যাঁ, ডুয়ার্সের জঙ্গলগুলোর প্রতিটার কিছু নিজস্বঃ বৈশিষ্ট আছে, যেমন ধর, এই যে বক্সার জঙ্গলে ঘন্টিপোকার শব্দ, গোরুমারা বা চাপড়ামারির দিকে কিন্তু এটা এতটা নেই। তবু, সাখামের জঙ্গলটা একেবারেই অন্যরকম। জঙ্গলের শব্দ প্রায় নেই বললেই চলে, জঙ্গল অনেক বেশী ঘন, লোকবসতীও কম, চা বাগান নেই বলে, লোক বলতে প্রধানত ওঁরাও আর কিছু মুন্ডা প্রজাতির আদিবাসী।”
সাখাম পৌঁছোতে বাজল প্রায় পৌনে এগারোটা। এখানের স্পটটা জঙ্গলের ভেতরে, যার রাস্তা গিয়েছে ফরেস্ট বাংলোর পাশ দিয়ে। সামনের বাগান সমেত ফরেস্ট বাংলোটা ছিমছাম পরিবেশে; বলাই বাহুল্য আকারে-আয়তনে লেপার্ডস নেস্ট-এর ধারকাছেও যায় না। আসার আগে বিট অফিসার বিপুলবাবুর সাথে কথা বলে আসা হয়েছে, তিনি বলে দিলেন দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা বাংলোতেই করা আছে; দুপুরে কাজের ফাঁকে শুধু একবার এসে খাওয়া দাওয়াটা করে যেতে হবে, তারপর কাজ আবার চলুক; তবে বিকেল সাড়ে পাঁচটা, ব্যস। তার বেশী না হয় যেন।
সাখামের কাজের পরিমাণ লেপচাখার থেকে কোনও অংশে কম নয়, কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশ নয় বলে, কাজটা করতে অনেক সুবিধা হচ্ছিল। বেলা একটা অবধি কাজ অনেকটাই এগিয়ে গেল। তারপর খেতে যাওয়া হল। বাংলোয় ফেরার রাস্তাটা পুরোটাই মানুষের পায়ে চলা পথ, জঙ্গলের ভেতরের আবার কিছু রাস্তা হাতির পায়ে তৈরী। তাতেই, মাঝে মধ্যে গাছপালা দুহাতে সরিয়ে এগোতে হয়। জঙ্গলটাকে খুব ভালো করে দেখছিল মৈনাক। তারাদার কথা তো গাড়িতে আসতে আসতে শুনেছিল; এখন সত্যিই, জঙ্গলের ভেতরে কাজ করতে করতে মনে হচ্ছে, সত্যিই জঙ্গলটার চরিত্র একেবারে আলাদা; একটা খুব আদিম, অগোছালো ব্যাপার আছে জঙ্গলটার মধ্যে। আগে থেকে না জানলে যেন কল্পনাই করা যাচ্ছে না, যে এই জঙ্গলের হাঁটা পথে একটু দুরেই একটা বসবাসযোগ্য বাংলো আছে।
বাংলোয় ফেরার পথে মৈনাকরা লক্ষ্য করল, তারাদা মাঝে মাঝে কয়েকটা গাছকে ভালো করে দেখছে, ওপর থেক নীচ পর্যন্ত, অনেক সময় গায়ে হাত দিয়েও। কৌতুহল চেপে না রাখতে পেরে অসীমাভ জিজ্ঞাসা করে
-“এটা কি করছ তারা দা ?”
-“ল্যান্ডমার্কিং করছি ভাই; অচেনা রাস্তা তো, মার্কিং না করলে বেলা পড়ে গেলে এই রাস্তায় ফেরা মুশকিল হবে।”
বাংলোয় খাওয়া দাওয়া সেরে আবার স্পটে যেতে হয়। প্রায় বিকেল পাঁচটা অবধি কাজ করার পর, দেখা গেল যা কাজ আছে, আর আধঘন্টা হলে পুরোই শেষ হয়ে যাবে, তাহলে শুধু শুধু কালকের দিনটা নষ্ট হবে না। জঙ্গলে আলো কমে এসেছে, কিন্তু কাজ চালানোর পক্ষে যথেষ্ট। তারাদাও সম্মতি দিল, তাই তাড়াতাড়ি হাত চালিয়ে, পাঁচটা চল্লিশ নাগাদ কাজ গুছিয়ে ফেলল ওরা। বাংলোয় ফিরতে প্রায় ১৫-২০ মিনিট লাগবে; জঙ্গলের নিয়ম মাফিক অন্ধকারটাও নামল হুশ করে। ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে বাংলোর পথে রওনা দিল সব্বাই। সবার আগে তারাদা, পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে।
কিছুদূর যাওয়ার পর, তারাশঙ্কর হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভালো করে চারপাশ দেখে নিয়ে বলল,
-“একটু পেছন দিকে চল তো… রাস্তা ভুল করেছি মনে হচ্ছে।”
পেছনে একটু যাওয়ার পরও ব্যাপার তথৈবচ; তারাদা একটু দাঁড়িয়ে পড়ে, বিড়বিড় করে বলে,
-“এরকম তো হয়না…”
তারপর মনে মনে কি যেন ভাবতে থাকে। সকলেই দাঁড়িয়ে পড়ে; আর তখনই সবাই জঙ্গলের শব্দ শুনতে পায়; সে শব্দ ঘন্টিপোকার নয়, বাতাসের নয়, হাওয়ারও নয়। হাজারটা গলা একসাথে ফিসফিস করলে যেরকম শব্দ হয়, অনেকটা সেরকম। আর কোনো শব্দই নেই। অন্যদের মুখ দেখে মৈনাক আন্দাজ করে তার মতো বুক সবারই কাঁপছে…
-“ও, এইবার বুঝেছি… !”
এই বলে তারাদা আবার চলে শুরু করে, আর এবার খুব একটা বেগ না পেয়েই পৌছে যায় বাংলোর কাছে। গিয়ে দেখা যায় বিপুলবাবু তাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি একটু রাগত স্বরেই বলে ওঠেন,
-“তারা, তুই মারবি নাকি আমায় ? কলেজের বাচ্চাগুলো, সেই তুই সওয়া ছ’টা বাজিয়ে দিলি।”
-“আরে, সরি বিপুলদা, আসলে ওদের কাজ একটু বাকি থাকছিল, আমিই বললাম হাত চালিয়ে করে নাও… আর এ জঙ্গলের ব্যাপার জানোই তো… মার্কিং অবধি রাতে বদলে যায় যেন…”
-“কেতাত্থ করেছ… এবার এস…”
এমন সময় পাশেরই একটা গাছের ওপর বেশ জোরে একটা খসখস শব্দ শোনা যায়। তারাদা টর্চের আলো ফেলতেই, মুখে আলো পড়ার দরুন বিরক্ত হয়ে একটা রেড পান্ডা গাছের আড়ালে চলে যায়…”
-“আরে বাহ ! তোমাদের কপাল তো খুব ভালো দেখছি !!!” -বিপুলবাবু বলে ওঠেন।
স্যার, বিপুলবাবু তারাদা আগে এগিয়ে যায়, পেছনে পেছনে বাকীরা। বাংলোর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকার সময় অসীমাভ ফিসফিস করে শ্বেতাংশু আর মৈনাককে বলে
-“আজ তারাদা কে ছাড়ছি না… সব কথা পেট থেকে বের করব…”
Pingback: Somewhere In the Jungle of North Bengal… Part XIV – Libberish