ক্ষমা চাওয়া ছাড়া আমার তো আর কোনও উপায়ই নেই। তবে নতুন অফিস, তাই চাপ তো ছিল, এখনও, আছে, তবে এবার ম্যানেজেবল। তাই আশা করছি, এর পর থেকে লেখা আবার নিয়মিতই হবে। আর কথা না বাড়িয়ে চলে আসি সেমি-ফাইনাল পর্বে। একসাথে কাটানো যাক, ভুটানে শেষ রাত্রি…
একাদশ পর্ব : লাস্ট সাপার…
-“না ভাই… আমি রিসেপশনে গিয়ে নালিশ করবই। এভাবে হিমাদ্রীকে হিউমিলিয়েট করা হল, এর প্রতিবাদ করতেই হবে…”
যাই হোক, রিসেপশনে যাওয়া হল তিনজনে, আমি ধোবো আর হিমাদ্রী। যেতেই, পরিষ্কার বাংলায় হোটেলের মালকিন জিজ্ঞাসা করলেন,
-“কি? রাতে সব ঠিক ছিল তো?”
আমি একটু হেসে উত্তর দিলাম,
-“কোথায় আর ঠিক থাকলাম? রাতে তো মহা মুশকিলে…”
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই ধোবো উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল,
-“ওরে বাবারে! পুরো বডিমে হাত ফাত দে দিয়া…”
আমি হেসে ফেললাম ধোবোর এই উত্তেজনায়।
যাক গে, নালিশ জানানো সেখানেই ভোগে চলে গেল। কারণ এর পর আর নালিশ জানানোর কোনও মুখ নেই, আমার অন্তত।

আজই ভুটানে আমাদের শেষ দিন এবং রাত। কারণ, কাল সকালের বাসেই আমরা ফেরত যাব ফুন্টশোলিং এবং রাতটা সেখানে, কাটিয়ে, সকালে আবার তিস্তা তোর্ষা ধরে ঘরে ফেরা।
আর তাই আজ আমাদের পারো ঘুরে দেখার দিন। পারোতে দেখার বলতে দ্রুকেল জং, ভুটান ন্যাশানাল মিউজিয়াম।
আমার আর জ্বর নেই, কিন্তু পায়ে একটু ব্যাথা আছে বিলক্ষণ। সবাই স্নান টান করে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে গাড়ি ভাড়া করে বেড়িয়ে পড়লাম আমাদের দুই গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

প্রথমেই ভুটান ন্যাশানাল মিউজিয়াম। থিম্ফু রাজধানী হলেও, এয়ারপোর্ট থাকায় পারো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শহর এবং তাই জাতীয় সংগ্রহশালাও এই শহরেই। সংগ্রহশালা ঘুরে আমরা সিধে চলে গেলাম দ্রুকেল জং-এ। এই দূর্গটা ভুটানের বাকী দূর্গগুলোর মতো সাজানো গোছানো নয় একেবারেই। দ্রুকেল জং চীন সীমান্তের একদমই কাছে এবং চীন-ভুটান যুদ্ধের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে এখনো অবধি। দূর্গের ভাঙা দেয়ালের গোল গোল গর্তগুলো যে কামানের গোলার, সেটা বোঝাই যায়।

বৃষ্টি আজ সকাল থেকে হয়নি ঠিকই, কিন্তু রোদ আর মেঘের লুকোচুরি লেগেই ছিল সকাল থেকে। দ্রুকেল জং-এ থাকাকালীন রোদের দেখা পাওয়া গেল না। ভাঙা দূর্গ, মেঘলা আকাশ আর তার সাথে জনমানবহীন প্রান্তর; মানে আমরা যখন দ্রুকেল জং-এর গেছিলাম, তখন ত্রীসিমানায় আর কেউ ছিল না। একটা চাপা বিষণ্ণতার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল চারপাশের পরিবেশে।

দ্রুকেল জং-এর চারপাশ দিয়ে চলে গিয়েছে একটা ভাঙা পাঁচিল। এককালে এর ওপর দিয়ে প্রহরীরা পায়চারী করত, এখন ভেঙেচুরে আর আগাছা গজিয়ে এক্কেবারে যা তা অবস্থা হয়ে রয়েছে। সবার ইচ্ছে হল, সেই আগাছার জঙ্গল পেড়িয়ে, একবার সেই পথ দিয়ে হেঁটে দেখবে, চেষ্টা আমিও করেছিলুম, কিন্তু বেকায়দায় পা পড়ে কোমরে চোট লাগার পর, আর চেষ্টা করিনি।
দ্রুকেল জং থেকে বেড়িয়ে দুপুরের খাওয়া দাওয়া করা হল। এখানে একটা পূর্ব ইতিহাসের কথা বলতে হয়। ২০১০ সালে, উচ্চ মাধ্যমিকের পর, বাবা-মা এবং কানাই-এর সাথে দিল্লী এবং উত্তরাখন্ড ঘুরতে যাই। এবং দিল্লীর ওই গরমে, গান্ডেপিন্ডে গিলে, ফেরার সময় বেদম পেটখারাপ হয়। ফেরার ট্রেন, মানে উদ্যান-আভা তুফান এক্সপ্রেশ ১৯ ঘন্টা লেট করায়, আমার অবস্থা যে কি শোচনীয় হয়েছিল, সেটা এখানে না বলাই শ্রেয়।
তা সেই থেকে, আমি যে কোনও রিটার্ন জার্নির এক-দুদিন আগে থেকে আমার পৌষ্টিকতন্ত্রকে ওভারটাইম খাটানো বন্ধ করে দিই। তাই আমি পুরুষ্টু শূকর এবং গোমাংস-এর পরিবর্তে মুর্গীরর হালকা সুরুয়া দিয়ে দুপুরের খাওয়া সারলাম।

তারপর, ভুটানে ফিরে এই প্রথম, দুপুরবেলা, পারোর হোটেলে গা এলিয়ে, টিভিতে সিনেমা দেখে এবং বই পড়ে কাটিয়ে দিচ্ছিলাম, এমন সময় লাহার ফোনের ভুটানী সিমকার্ড বেজে উঠল। লাহা কানে ধরে আমার দিকে এগিয়ে দিল। হ্যালোর প্রত্যুত্তরে একটা চেনা নারীকন্ঠের আওয়াজ বলে উঠল,
-“হ্যালো, নীলোৎপল ? আমি দিব্যশ্রী বলছি রে…”
খেয়াল পড়ল, কথায় কথায় পারোতে এসে দিব্যশ্রী কে লাহার নম্বরটা পাঠিয়েছিলাম বটে। দিব্যশ্রীর বাড়ি কোচবিহারে, আমরা একসাথে ফিজিক্স কোচিং-এ পড়তাম। আর আমি নর্থ বেঙ্গল আসছি শুনে বলেছে পারলে একবার ঘুরে যেতে।
-“হ্যাঁ রে, বল…”
-“তুই কালকে ফিরছিস তো ?”
-“হ্যাঁ, কালকে ফুন্টশোলিং…”
-“শোন, একটা কাজ কর, তুই জয়গাঁও থেকে কোচবিহারের বাস পেয়ে যাবি। ধরে, আমার বাড়ি চলে আয়, সকালে এখান থেকেই তিস্তা তোর্ষা ধরে নিবি। তোর বন্ধুদের না হয় হোটেল…”
আমি ঘোরতর আপত্তি করলাম। আমি ঠিক আছে, বন্ধুত্বের খাতিরে না হয় ওর বাড়িতে গিয়ে হামলা করতেই পারি। কিন্তু আমার সহযাত্রীরা ফুন্টশোলিং-এর নাইট-লাইফ এঞ্জয় করার প্ন্যান করছে, আর সে প্ল্যানে আমি আর কি করে জল ঢালতে পারি? তাই, আমি জানিয়ে দিলাম,
-“আমি চলে যাব, চাপ নেই, কিন্তু আমার বন্ধুরা একটা রাত ফুন্টশোলিং-এ কাটাতে চাইছে…”
-“ঠিক আছে, তুই বাস ওয়ালা কে বলিস, ‘সর্বশ্রী হোটেলের সামনে নামিয়ে দিতে।“
সর্বশ্রীর সামনে দিব্যশ্রীর বাড়ি। এখন লিখতে লিখতে মনে হল, ভাগ্যিস দিব্যশ্রীর কোনও বোন বা দিদি নেই…
যাই হোক, সন্ধ্যেবেলা পারোর বাজার থেকে বাড়ির জন্য কিঞ্চিৎ কেনাকাটা করলাম। ছোটও ছোটও কতগুলো জপযন্ত্র, আর এটা সেটা। দোকানের একধারে একঝুরি কাঠের ডিলডো দেখে প্রথমে চমকে উঠে, তারপর বুঝলাম, ওটা চিমি অ্যাখাং-এর দেবতার প্রতিমূর্তি।
যাই হোক, কাল সকালে লম্বা বাসযাত্রা, তাই সেই বাবদ কিছু রসদ কিনে, খেয়ে দেয়ে আবার ঘরে গিয়ে বসা হল। ভুটানের এই শেষ রাতটা নির্বিঘ্নেই কাটল, কারণ পাশের ঘরের তৃতীয় লিঙ্গের মহাশয়রা বিদায় নিয়েছেন।
UNO খেলা চলছে, হঠাৎ অর্ঘ তড়াক করে লাফিয়ে উঠল।
গোটা ঘর তোলপাড় করার পর, সে আর্তনাদ করে উঠল,
-“ভাই ! আমার ক্যামেরা ! আমার ক্যামেরা হারিয়ে গেছে…
এই শনিবার, কোচবিহার ঝটিকা সফর করে আমাদের ভুটান সফর শেষ…
শান্তির আশায়
নীল…