দ্বাদশ পর্ব : নটে গাছটি মুড়োলো…

কি ভাবছেন ? ভাবছেন, “সে কি মশাই ! শুধু ক্যামেরা হারালো? এ কেমন ভ্রমণ কাহিনী, যেখানে অবৈধ প্রেম নেই, ভূত নেই, মায় একটা ছোটখাটো ‘কাহানি মে ট্যুইস্ট’ অবধি নেই ?”
নেই… সত্যিই নেই… কিন্তু গল্পটা আছে, স্মৃতিগুলো এখনো তাজা আছে, আর তাই এত ঘটা করে এত লেখা, এত আয়োজন।
অনেক খোঁজাখুঁজির পরও যখন অর্ঘর ক্যামেরা পাওয়া গেল না, তখন কি হল, সেটা আগের পর্বে ভিডিওতেই বলা আছে। কিন্তু, কাল সকালে তো বাসও ধরতে হবে, তাই অগত্যা ক্যামেরার মায়া ত্যাগ করে, সবাইকেই, ব্যাগপত্র গোছাতে শুরু করতে হল। অদ্ভূতভাবেই সেই রাতে আর কিছু ঘটল না। সকালে উঠে এগোলাম বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে।
লাগেজ তোলার সময় আমি গেলাম ফেঁসে। ব্যাগে এটা ওটা ধরছিল না বলে, আমার কিন্ডল-টা দিয়েছিলাম অর্ণবের জিম্মায়। সে করেছে কি, বাসের ছাদে দিয়েছে ব্যাগটা বেঁধে। ফলে আমাকে ফুন্টশোলিং পর্য্যন্ত গোটা যাত্রাপথটা ঘুমিয়ে, ঢুলে কাটাতে হল। টিফিনের ব্যবস্থা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তাতে আর কতক্ষণ থাকা যায়? ফুন্টশোলিং পৌছোতে পৌছোতে সেসব হজম, আর তার ওপর, আমার যাত্রা তো সেখানেই শেষ নয়, সেখানে শুরু বললে মোটেও ভুল বলা হয় না।
বাস থেকে, কোনওরকমে লাগেজ নিয়ে দৌড় দৌড় দৌড়… সেখান থেকে কোচবিহারের বাসে ওঠা, তারপর আবার ঘটর ঘটর করতে করতে চলা। সদ্য পারো থেকে ফুন্টশোলিং-এ নেমে মনে হচ্ছিল, দুনিয়ায় এত গরম কোথা থেকে এল? তারমধ্যে কোনওরকমে এসে নামলুম সর্বশ্রী হোটেলের সামনে। আর দিব্যশ্রীর বাড়ি পৌছোতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হল না।
তা সেখানে গিয়ে সবার আগে নিজের পুরোনো জামা কাপড়গুলোকে মানবসমাজ থেকে যতটা দূরে রাখা যায় রেখে, রেখে, স্নানে গেলাম। আর বিকেল ৪টে বেজে গেলেও, স্নান করে, কাকীমার হাতের রান্না দিয়ে দ্বিপ্রাহরিক(?) ভোজনটা সারা গেল।

খেতে বসেছি, এমন সময় খুব উৎসাহিত হয়ে দিব্যশ্রী বলে উঠল,
-“আমিও মায়ের সাথে রান্না করেছি…”
আমিও ততধিক উৎসাহিত হয়ে বললাম,
-“বটে? তা কি রাঁধলি?”
-“না, মানে আমি ক্যাপসিকাম কেটে দিয়েছি…”
মানে পর্বতের মুষিক প্রসব! আমি এ’কথায় একটু হেসে ফেলতে দিব্যশ্রী চটে গেল…
যাই হোক, খেয়ে দেয়ে আড্ডায় বসলাম, আমি, কাকীমা, দিব্যশ্রী আর আমাদের মধ্যমণি হল ‘টিপসি’ মানে দিব্যশ্রীর বীগল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামল গল্পে গল্পে, কাকু অফিস থেকে ফিরে এলেন বাড়ি। এবার আমি, দিব্যশ্রী এবং কাকীমা, বেরোলাম কোচবিহার সফরে। সন্ধ্যেবেলা রাজবাড়ি বন্ধ, তাই সেটা বাইরে থেকেই দেখে মন ভরাতে হল। আর গেলাম মদন মোহন বাড়িতে সন্ধ্যারতি দেখতে। সেখান থেকে সাগরদিঘী এবং জেঙ্কিন্স স্কুল।
সাগরদিঘী নিয়েও একটা গল্প প্রচলিত আছে। বিরাট বড় ওই পুকুর খননের সময় অনেক চেষ্টা করেও জল না ওঠার রাজাকে কোনও এক জেনেরিক দেবী বা দেবতা স্বপ্নাদেশ দেন যে রাজকুমারী নিজে হাতে অঞ্জলী দিলে মাটি চিরে বেরিয়ে আসবে জল। তা সেই আদেশমতো রাজকুমারী পুকুরের গর্ভে নেমে গেলে, জল বেরিয়ে আসে, এবং রাজকুমারীর সলিল সমাধি হয়। তবে সাগরদিঘী আকারে বিরাট বড়, রাজকুমারী কোনওদিন চান করতে গিয়ে ডুবে যাওয়ার পর, এরকম গল্প প্রচার হলেও আশ্চর্য্য হব না…
তবে, জেঙ্কিন্স স্কুলের দেয়ালে বুলেটের দাগ দেখে স্বভাবতই কৌতুহল হল। দিব্যশ্রী সেটার উত্তরে আমাকে একটা গল্প বলতে শুরু করল,
-“বুঝলি, ওটার সাথে একটা নক্সাল আমলের স্মৃতি…”
এটুকু বলার পড়েই কাকীমা ধমক দিয়ে বলল,
-“খালি ভুলভাল বলে… মোটেই নক্সাল রিলেটেড ঘটনা নয়…”
এই বলে কাকীমা যে ঘটনাটা বললেন, সেটা সেই নক্সাল আমলের হলেও, সত্যিই নক্সাল সংক্রান্ত নয়, ঘটনাটা ১৯৭৪ সালে, এবং অত্যন্ত মর্মান্তিক। একবার টিফিন টাইমে একদল ছাত্র বাইরে থাকাকালীন, বি এস এফ-এর দু’টি দলের মধ্যে বচসা শুরু হয়, এবং এই বচসা শেষমেষ দু তরফে গোলাগুলি ছোঁড়ার পর্যায়ে চলে যায়। সে গুলিতে কোন ছাত্র নিহত না হলেও, ছাত্রদের উদ্ধারে আসা এক শিক্ষকের মৃত্যু হয়। সে গুলির দাগই আছে ওই স্কুলের দেয়ালে।
সবার শেষে রামকৃষ্ণ মিশনে বসে একটু ধ্যানের চেষ্টা করে বাড়ি ফিরলাম।
ফিরে আবার ল্যাপটপ খুলে ছবি টবি নিয়ে একটু দেখা চলছিল, এমন সময় আমাকে ফেসবুকে মেসেজ করল সাত্ত্বিক। আমার আর দিব্যশ্রীর মাথায় একটা রসিকতার আইডিয়া খেলে এল সঙ্গে সঙ্গেই। এখানে বলে রাখি, সাত্ত্বিক আমার কলেজের বন্ধু, আর আমরা অনার্স টিউশনও পড়তাম একসাথে; আমরা মানে আমি, সাত্ত্বিক, দিব্যশ্রী এবং সুপর্ণা।
সাত্ত্বিক তখন থাকত নারকেলডাঙ্গা রেল কোয়ার্টার-এ, শেয়ালদা স্টেশন থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে। বহুক্ষণ দিব্যশ্রী আমার অ্যাকাউন্ট থেকে সাত্ত্বিকের সাথে কথা বলতে বলতে মোটামুটি প্রতিষ্ঠা করে ফেলল যে আমি কলকাতা ফিরে এসেছি, ও আমার বাড়িতে, আর রাতে ট্রেন ধরবে বলে আমিই ওকে স্টেশনে ছাড়তে এসেছি। আর তারপরই দিব্যশ্রী ব্রহ্মাস্ত্রটা ছাড়ল;
-“একবার আয় না স্টেশনে… দেখা হয়ে যাবে…”
একটু দোনামোনা করার পর, সাত্ত্বিক আমার ফোনে ফোন করল। আর সেটা তুললও দিব্যশ্রী। ফলে সাত্ত্বিক বুঝে গেল, আমরা একসাথেই আছি। তারপর সে জানাল, যে সে বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে এবং স্টেশনে আসছে।
এ পর্য্যন্ত ঘটনা ঘটার পর, আমরা খেতে বসলুম। খাওয়ার অর্ধপথে পৌঁছেছি, এমন সময় সাত্ত্বিকের ফোন।
-“ভাই, তোরা কোন প্ল্যাটফর্মে ?”
আমি সটান উত্তর দিলাম,
-“আমি তো দিব্যশ্রীর বাড়িতে ভাই, কোচবিহারে… প্ল্যাটফর্মে কেন থাকতে যাব?”
তা এর পর, আমাদের বেশ বাছা বাছা ক’য়েকটা বিশেষণ শুনতে হয়েছিল। যাই হোক, যদিও সেদিনের পর সাত্ত্বিকের কাছে ক্ষমা আমরা চেয়েছি, তবু আজ আবার বলছি, ভাই, সেদিনের সেই লেগ পুলিংটার জন্য অত্যন্ত দুঃখিত…
খাওয়া দাওয়ার পর, রাতে বিছানায় শুয়ে, ওপরে বনবন করে ঘুরতে থাকা পাখাটার দিকে তাকিয়ে মনে হল, কাল কোথায় ছিলাম, আর আজ কোথায় আছি… আর ভুটান ছেড়ে ভারতে যে পৌছে গেছি, এবং সফরের যে এই শেষ, সেটাও স্পষ্ট টের পাচ্ছিলাম।
এখন প্রশ্নটা হল কেন? পাঁচ বছর আগের স্মৃতি কেন হঠাৎ ধুলো ঝেড়ে এভাবে গুছোতে ইচ্ছে হল?
কারণটা আসলে খুবই সোজা। এই করোনার বাজারে, এইরকম ট্রিপের মুখ যে আবার কবে দেখব, তার কোনও আশ্বাস নেই। কিন্তু হেমকুন্ড ট্রেকের মত, ভুটানের এই কটা দিন, আমার কাছে অন্যরকম ছিল। আর তাই এই গল্পটা সবার সামনে আনার এই সুবর্ণ-সুযোগ আমি ছাড়তে পারলাম না।
প্রতিটা ট্রিপ, প্রতিটা ঘর ছেড়ে বেরোনোর পেছনে নেহাত Wanderlust ছাড়াও একটা কারণ মাঝে মাঝেই থাকে হয়ত, আর প্রতিটা ট্রিপের পরে একটা নতুন বন্ধু, একটা নতুন উপলব্ধি নিয়ে ঘরে ফেরা হয়।
ভুটান ট্রিপও তার বিকল্প ছিল না; হ্যাঁ, মেনে নিচ্ছি, ওই এক সপ্তাহের পর আমি আমার প্রাক্তনকে এক্কেবারে ভুলে মেরে দিয়ে পিছন ফিরে আর তাকাইনি, সেরকম হয়নি মোটেই, আমি ওই ব্যাপারে পরেও ছড়িয়েছি, খুচরো এবং পাইকারি দরে; কিন্তু সে কথা অন্য একদিন বলব’খন। তবে, ভুটানের ক’টা দিন সামনের পথে এগোতে অনেক সাহায্য করেছে, অবশ্যই।
অর্ণব লাহা-এর সাথে মাঝে মাঝেই কথা হয়, ওটা একটা বড় প্রাপ্তি আমার, বন্ধুখাতে। হিমাদ্রী এখন প্রফেশনাল শেফ এবং ইউটিউবার, ওর চ্যানেলের লিংক দেওয়া রইল নীচে, দেখে নেবেন…
লেখাটা শুরু হওয়ার পর, দু’দিন অর্ঘর সাথেও কথা হল, কথা হল আফরোজের সাথেও। আর দিব্যশ্রীর সাথে যদিও ট্যুরে গিয়ে আলাপ হয়নি, তবু এই ট্যুর-টা আমাদের বন্ধুত্বটাকে আরও গভীর করে তুলেছিল। এই শেষ পর্ব লেখার জন্য আমি তাইওয়ানে বসে থাকা দিব্যশ্রীকে ফোন করে, কথা বলে তারপর এই উপসংহার টেনেছি।

আর সবশেষে বলি সেই দেশটার কথা, যার নাম ‘ল্যান্ড অফ দ্য থান্ডার ড্রাগন’; ভুটান সরকার ‘হ্যাপিনেস ইন্ডেক্স’ বলে কিছু একটা পরিসংখ্যান-এর উদ্ভাবন করেছে, এবং তাদের দাবী অনুযায়ী ভুটান হল পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশ। আমি কোনকালেই ওইসব পরিসংখ্যানের ধার ধারতাম না, কিন্তু দেশটাকে অত কাছ থেকে দেখে আমার মনে হয়নি কোনও কিছু তলায় চাপা পড়ে আছে। মনে হয়নি, যাকে সকল দেশের রাণী বলে আমরা গলা ফাটাই, তার মতো ভুটানের বুকেও কোথাও লুকোনো আছে হিংসা, দ্বেষ এবং হানাহানি…
মনে হয়েছে এই সুন্দর ছবির মতো দেশটা সত্যিই যেন স্বপ্নের তুলিতে আঁকা, কল্পনার রঙে রাঙানো। মনে হয়েছে, আর একবার… আর একবার ফিরে আসব, এই পাহাড় আর ঝর্ণার দেশে…
অনেক অনেক দেরী হলেও, অবশেষে শেষ হল আমাদের ভুটান সফর। এবার চেষ্টা করব, আবার নিয়মিত হওয়ার। সঙ্গে থাকুন, আগেও অনেক উৎসাহ দিয়েছেন, ভবিষ্যতেও দেবেন আশা করি… ভালো থাকবেন…
শান্তির আশায়…
নীল…