Wanderlust : Land of the Thunder Dragon – Part 9

নবম পর্ব : বাঘের বাসা

বৌদ্ধ গুরু রিমপোচে বা আমাদের ভাষায় বললে ‘পদ্মসম্ভব’ ভুটানে এসে একটি উড়ন্ত বাঘিনীর পিঠে চড়ে উড়ে যান, দূর্গম পাহাড়ের একটি গুহায় তপস্যা করতে। এবং সেখানেই তৈরী হয়েছে তাকসাং বা ‘টাইগার্স নেস্ট’ মনাস্ট্রী।

পদ্মসম্ভব মহাপুরুষ ছিলেন; বলা হয় গৌতম বুদ্ধ তাঁর দেহে দ্বিতীয়বার জন্মগ্রহন করেন। কিন্তু, আমরা তো ঘোর পাপী? তাই আমাদের কপালে বাঘ, হাতি ঘোড়া কিছুই জুটবে না, কেবল এগারো নম্বর বাস ছাড়া। রাতে হোটেলে ফেরার আগে, কিনে আনা হয়েছিল মাথাপিছু ২ ক্যান করে রেডবুল, ট্রেকের উপাদান হিসাবে। আগেই বলেছি, আমার আর আফরোজের এটা দ্বিতীয় ট্রেক, এবং বক্সার তুলনায় তাখসাং অনেকটাই কঠিন, অন্তত তাই শোনা যায়। তা মানসিক প্রস্তুতিতে যে এভাবে সক্কাল সক্কাল বৃষ্টির জল পড়ে যাবে, সে তো ভাবিনি। ঝমঝম করে নয়, কিন্তু এক্কেবারে ঝিরঝিরেও নয়।

কিন্তু, আবার কবে ভুটানে আসব, আবার কবে পারোতে আসব, সেইসব ভেবেই, ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে গিয়ে একটি গাড়ি জোগাড় করা হল। আর পারো শহরের কেন্দ্র থেকে প্রায় ১৯ কিলোমিটার দুরের বেস ক্যাম্প-এ পৌঁছে গেলাম ঘন্টাখানেকের মধ্যেই।

আমার আর লাহার কাঁধে ক্যামেরার ব্যাগ, আর সবার কাছেই একটা একটা করে ব্যাগ, সঙ্গে আছে মাথাপিছু একটা করে ২০০ মিলি জলের বোতল আর অবশ্যই রেডবুলের ক্যান। বেস ক্যাম্প-এ একগাদা বাস-গাড়ির মেলা, লোকজন পাহাড়ে চড়ার তোড়জোড় করছে। আমাদের অবশ্য ড্রাইভার বলেছিল, যে আগে থেকে বলে রাখলে সে এসে আমাদের নিয়ে যাবে সামান্য অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে; কিন্তু ট্যুর অপারেটর ধোবো-এর সেটা অতিরিক্ত বিলাসিতা বলেই মনে হয়েছে, এবং তাকে সসম্মানে নাকচ করে দিয়েছে।

তাই, আমরা ৮ খানা হন্টন দন্ড কিনে এগোতে শুরু করলাম ওপরের দিকে। কারণ প্রফেসর ক্যালকুলাস বলেছেন, পশ্চিমে যাও, আরও পশ্চিমে…

হাঁটা পথের উচ্চতা, পারো শহরের সাপেক্ষে ৯০০ মিটার; আর দৈর্ঘ্য মোটামুটি ৪ কিলোমিটার। মোটামুটি আধঘন্টা হাঁটার পর, আমরা গভীরভাবে অনুভব করলাম, এ বড় কঠিন ঠাঁই। গ্লুকোজের প্যাকেট অর্ধেক ফাঁক। ঠান্ডা ভালোই আছে, কিন্তু টি-শার্টের ওপরে পড়া উইন্ডচিটার-কাম-রেইনকোট টাকে কোমরে জড়িয়েছি, তবুও দরদর করে ঘেমে চলেছি সবাই। ডেফিনিটের ভাষায়,

-“জ্যায়সে পাসিনে কা বান খোল দিয়া কিসি নে…”

কিন্তু এত সহজে ধৈর্য্য হারালে চলবে না… ভালার মর্ঘুলিস…

তখন আমার আর অর্ঘর মুখে একের পর এক পপ কালচার রেফারেন্স, ফুটে ফুটে বেরোচ্ছে।

-“We Ride for Victory, We Ride for Gondor !!!”

-“For Frodo !!!”

-“Winter is Coming…”

-“We do not sow…”

আমাদের হাবভাব দেখে আশেপাশের লোকগুলো ভেবেছিল, আমরা নিশ্চয়ই যুদ্ধে যাচ্ছি। কেদারনাথ ট্রেক করে আসা অর্কর মুখে তখন তালা ঝুলছে। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছে হিমাদ্রী, অর্ণব এবং আফরোজ। বৃষ্টির দাপট নেই ঠিকই, কিন্তু ঝিরঝিরে বৃষ্টি চলছে তখনো। দুপুর একটা থেকে দু’টো অবধি তাখসাং-এ লাঞ্চ ব্রেক। আমাদের ইচ্ছে ছিল, লাঞ্চ ব্রেক এর আগেই যদি পৌঁছে যাওয়া যায়, তাহলে লাঞ্চ ব্রেক হয়ে গেলেই নেমে পড়তে পারব।

যেতে যেতে এক প্রৌঢ় মার্কিন দম্পতির সাথে আলাপ হল, তাঁরা দু’জনে স্কুলশিক্ষক। তাঁদের সাথে গপ্পো টপ্পো করে এগোতে শুরু করলাম আবার। সামনের পথ অনেক লম্বা। এখন থামলে লাঞ্চ ব্রেকের আগে পৌছোনো যাবে না…

তাখসাং-এর রাস্তাটার মাঝে একটা কাফে আছে, সেখানে পৌঁছে আমরা একটু বিশ্রাম নিয়ে, একটা করে রেডবুল গলাধঃকরন করে আবার চলতে শুরু করলাম। এই কাফেতে চা এবং কফিরও ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু এক কাপ চা বা কফির দাম ১৫০ টাকা হওয়ায় আমরা সেদিকে এগোইনি। এই মিডওয়ে কাফে-এর পরে, রাস্তা আছে সামান্যই। কিন্তু সিঁড়ি আছে, প্রায় ৩০০-৩৫০।

যাদের টাইগার্স নেস্ট যাওয়ার সুযোগ হয়েছে, তারা জানেন, বেশ কিছুটা ওঠার পর, যখন পাহাড়ের মাথা থেকে যখন গোটা পারো শহরটা দেখা যায়, আর সেদিন হালকা মেঘ আর ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি একটা চাঁদোয়ার মত জিনিস তৈরী করেছিল। রেইনকোটে গা-মাথা ঢেকে, ক্যামেরার ব্যাগ সামলে উঠতে উঠতে, সেদিকে চোখ পড়লে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হয়। মনের ক্লান্তি কোথায় চলে যায়। মনে হয় এতক্ষণের খাটনি সার্থক।

সেখান থেকে মনাস্ট্রীটাও দেখা যায়। মনাস্ট্রির কাছেই একটা ঝর্ণা। আর সবুজে ঢাকা পাহাড়, সত্যি বলছি, ‘পাহাড়ে যাব, মরে যাব’ এই যে মানসিকতা নিয়ে বাড়ি ছেড়েছিলাম, সেই মানসিকতার বদলে তখন ইচ্ছে করছিল, ওই দিকে তাকিয়ে বসে থাকি, দিনের পর দিন, ওই দৃশ্যটা বার বার করে দেখার জন্যই বেঁচে থাকি আরও অনেক অনেক দিন।

অবশেষে সেই ৩০০ সিঁড়ির অর্ধেক পেড়িয়ে এসে পৌছালাম ঝর্ণাটার সামনে। পাহাড়ি ঝর্ণার বরফের মতো ঠান্ডা জল ছিটে লাগছিল মুখে গায়ে। সেই অনুভূতি লিখে প্রকাশ করার মতো নয়। লামাদের দেখা দেখি সেই ঝর্ণার জল আমরাও বোতলে ভরে খেলাম। খাঁটি মিনারেল ওয়াটার যাকে বলে। ঝর্ণার পরে বাকী সিঁড়ি পেড়িয়ে টাইগার্স নেস্ট এর দরজায় এসে পৌছালাম।

গাছে তুলে মই কাড়ছি না। তবে, ওঠার থেকে আমাদের নামাটাই ছিল বেশী ঘটনাবহুল, তাই নামার জন্য একটা গোটা এপিসোড বরাদ্দ না করে পারছি না…

শান্তির আশায়,

নীল…

Advertisement

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.