Wanderlust : Land of the Thunder Dragon – Part 8

অষ্টম পর্ব পারোর পথে

ভদ্রলোকের এক কথা। কিন্তু আমাদের ড্রাইভার সাহেব যে এরকম খাঁটি ভদ্রলোক, তা ভেবে আমরা আন্দাজও করতে পারিনি। সকালে উঠে বারবার ফোন করেও যখন ড্রাইভার সাহেবের পাত্তা পাওয়া গেল না, তখন বোঝা গেল, নিজের কথামতই, আমাদের অন্য গাড়ির ভরসায় ছেড়ে তিনি ভেগেছেন। তাই, অন্য ড্রাইভার জোগাড় করতে হবে। তা এবার আমি, আফরোজ, ধোবো এবং অর্ঘ গেলাম ট্যাক্সী স্ট্যান্ডে। সেখানে গিয়ে আর একটা গাড়ি ঠিক করা হল। চালকের নাম গেম্বো দজি (Gembo Dorji)।

গেম্বো দজির সাথে আমরা…

ড্রাইভার সাহেব খুবই হাসিখুশি, এবং কথা বলতে ভালোবাসেন। আমাদের আজ প্রথম গন্তব্য হা ভ্যালি (Haa Valley); যা কিনা ভুটানের শীতলতম বিন্দু। সকালে গরু খোঁজা, থুড়ি, গাড়ি খোঁজা করতে গিয়ে বেশ দেরী হয়েছিল, তাই আমরা একবার প্রাতরাশ ছাড়া আর কোথাও থামলাম না। তবে যেতে যেতে প্রচুর গপ্পো হল। কথায় কথায়, গেম্বো দজি বলল,

-“আপনারা চিমি আখাং যাননি ?”

আমরা হাসি মুখেই নেতিবাচক উক্তি করলাম। কিন্তু এর পর, গেম্বো-র মুখে চিমি আখাং এর যে উপাখ্যান শুনলাম, তাতে আমাদের চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল। যারা ভুটানের সংস্কৃতি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল, তারা ভালোই জানেন, ভুটানে ‘ফ্যালাস’ (Phallus) বা শিশ্নের পূজো ব্যাপক ভাবে প্রচলিত। এবং যৌনতার ব্যাপারে, অনেক বড় বড় প্রথম বিশ্বের দেশকে টেক্কা দিতে পারে ভুটান। এবং এই শিশ্ন পূজোর ব্যাপারটা পুরোটাই এসেছে ওই চিমি আখাং থেকে। চিমি আখাং-এর ‘ফার্টিলিটি গড’-টি আর কেউ নয়, একটি উদ্যত, রূপোর তবক বসানো পুরুষাঙ্গ। চিমি আখাং-এ ঢোকার সময় আপনাকে অভ্যর্থনা করা হবে একটি দশ ইঞ্চি লম্বা কাঠের ধ্বজ মাথায় বুলিয়ে।

নাক শিঁটকাচ্ছেন নাকি ? এ তো সবে শুরু…

সন্তানধারণে অক্ষম দম্পতিরা এখানে প্রার্থনা করতে গেলে, নিয়ম হল, গর্ভধারণে ইচ্ছুক স্ত্রীলোকটিকে তার বিশেষ অঙ্গটিকে, দেবতার রৌপ্যখচিত অঙ্গের সংষ্পর্ষে আনতে হয়।

আজ্ঞে হ্যাঁ… ঠিক শুনেছেন। বিশ্বাস করুন এর থেকে ভদ্রভাবে আর কোনোভাবেই ব্যাখা করা সম্ভব নয় এই ব্যাপারটা।

আর আমরা যেমন লেবু, এবং লঙ্কা (অসভ্য কিছু ভাববেন না মাইরি…) ঝুলিয়ে খারাপ নজরের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করি, ভুটানেও তেমনি দেয়ালে দেয়ালে নানান রঙের ফ্যালাস-এর ছবি এঁকে, একইভাবে খারাপ নজর এবং পরশির গুজব থেকে রক্ষা পেয়ে থাকে।

ধোবোই প্রথম মুখ খুলল,

-“ভাই, বলেছিলাম চল, খিল্লি হত…”

আর খিল্লি। এসব বক্তব্য শুনে হাসব না কাঁদব সেটাই ভেবে পাচ্ছি না তখনো। কথা চলতে চলতে এসে গেলাম হা ভ্যালি। গরমকাল, তাই বরফের চিহ্ন নেই, তবে হা ভ্যালি হাঁ করে দেখার মতই সুন্দর।

হা ভ্যালি থেকে বেড়িয়ে একটা জায়গায় গাড়ি থামাল গেম্বো। আমরা দেখলুম, পাহাড়ের মাথায় একটা দূর্গ। বড় সুন্দর লাগছে দেখতে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম,

-“ওখানে ঘর ভাড়া পাওয়া যায় ?”

উত্তরে গেম্বো হেসে বললে,

-“আজ্ঞে, ওটা জেলখানা…”

কি সর্বনাশ! জেলখানার এই সৌন্দর্য্য?

গেম্বো কিন্তু বলেই চলেছে, কোন রাজা ওই জেলখানা তৈরী করেছিলেন। এবং এর আগে নাকি ভুটানে একরকমই মৃত্যুদন্ড বলবৎ ছিল। অপরাধীকে বস্তায় বেঁধে খাদে ফেলে দেওয়া হত। শুনে আমার অন্তত গা টা কেমন শিরশির করে উঠল।

সেখানে একটা গ্রুপ ছবি তোলা হল গেম্বোর সাথে, তোলার পর সে বলল,

-“আমাদের ধর্মে বলে ছবি তুললে আয়ু কমে যায়…”

তাই আমার মূর্খামির জন্যই বেচারা গেম্বোর আয়ু কমে গেল। ভাবলে এখনো মনে বড় ব্যাথা লাগে।

আজ আর রাস্তায় দেখার মতো কিছু নেই, আজ পারোতে গ্যারেজ হয়ে, কাল বাঘের বাসায় ঘোগ হবার চেষ্টা করা যাবে, অর্থাৎ ‘টাইগার্স নেস্ট মনাস্ট্রীতে’ পদব্রজে ওঠার চেষ্টা করে যাবে। আর পারোতে ওঠার জন্য ধোবো হোটেল দেখে রেখেছে ইন্টারনেট থেকে, ‘হোটেল পেরিজোরলিং’। গেম্বো কিন্তু বকেও চলেছে, এবং তার নানান প্রশ্ন, আমরা হিন্দু হয়েও গোরু কেন খাই, ইত্যাদি ইত্যাদি। এই গোরুর ব্যাপারে ধোবো একবার বোঝানোর চেষ্টা করেছিল;

-“ঐসা বাত নেহী হ্যায়, জো সব কট্টর হিন্দু হতে হ্যায়…”

এত অবধি বলামাত্রই, আমরা বললাম,

-“থাম ভাই, পারো অবধি অক্ষত অবস্থায় পৌছোতে হবে, এরকম হিন্দি বললে, সমস্যা…”

তবে এখানে কথায় কথায় একটা ঘটনা ঘটল। আমরা ক্রমশ ফ্র্যাঙ্ক হচ্ছিলাম গেম্বোর সাথে; আর কথায় কথায় আমিই বললাম,

-“এখানে দু’দিন ধরে তো চোখ ভরে মেয়ে দেখে যাচ্ছি…”

তার উত্তরে গেম্বো যে কথাটা বলল, সেটা আমার গালে লেগেছিল একটা সপাটে চড়ের মতো…

-“হ্যাঁ, আমাদের ভুটানে তো শান্তি আছে, ইন্ডিয়ায় অমন করে ঘুরলে তো রেপ হয়ে যেত…”

এর উত্তর আমার কাছে সত্যিই কিছু ছিল না, রেপ কান্ট্রি, রেপ ক্যাপিট্যাল কথাটা আমরাই বিদ্রুপ করে ব্যবহার করে থাকি, কিন্তু সে’দিন বুঝতে পেরেছিলাম, নির্ভয়া কান্ডের পর, ‘সকল দেশের রাণী’ সবার চোখেই মেথরানীর পর্যায়ে নেমে গেছিল। যখন আমরা দেশের ভাবমূর্তির কথা বলি, সেখানে একটা কথা আমাদের মনে রাখা উচিত। রাজনীতির কচাকচি বাদ দিলে, দেশের ভাবমূর্তি এভাবেই তৈরী হয়। লোকের মুখে মুখে, লোকের মনে মনে।

পারো ইন্টারন্যাশানাল এয়ারপোর্ট পেড়িয়ে আমরা পারো শহরে ঢুকলাম। থিম্ফুর মতো পারো-ও সাজানো গোছানো; তবে থিম্ফুর মতো অত জমকালো নয় পারো। বেশ ছিমছাম, আলগোছা একটা ব্যাপার আছে পারো শহরের চেহারার মধ্যে।

পারো…

পারো পৌঁছে আমরা গেম্বোকে ছেড়ে দিলাম। কারণ, পারো থেকে ফুন্টশোলিং আমরা ফিরব বাসে, আর এর মধ্যে একবার খালি টাইগার্স নেস্ট-এর বেস ক্যাম্পে যেতে আসতে, আর পারো ঘুরে দেখতে গাড়ি লাগবে। তো সেটা লোকাল স্ট্যান্ড থেকে জোগাড় করা খুব একটা মুশকিল হবে বলে মনে হয় না। তাই হোটেল পেরিজোরলিং-এর সামনে আমাদের নামিয়ে, হাসিমুখে বিদায় নিল গেম্বো।

পেরিজোরলিং আকারে ছোট্ট, দামেও কম, কিন্তু দুর্দান্ত লোকেশনের একটা হোটেল। হোটেলের ঠিক পেছন দিয়েই বয়ে গেছে পারো ছুঃ, আর নদীর নামেই শহরের নাম পারো।

হোটেলে জানা গেল, ঘর দু’টো পাওয়া যাবে ঠিকই, কিন্তু অ্যাটাচড বাথ নেই, বাইরের কমন বাথরুম আছে, যেটা তিনটে ঘরের মধ্যে শেয়ার হয়।

আপত্তি টাপত্তি করে কোনও লাভ নেই, গাড়ি চলে গেছে, আর এত সস্তায় এরকম ভিউ ওয়ালা ঘর আর পাওয়া অসম্ভব। তাই আমরা সুর সুর করে ঘরে ঢুকলাম। এখানে ঘরের যা অবস্থা, তাতে ৪+৪ ভাগে থাকা যাবে না, ৫+৩ করতে হবে। তাই একঘরে পড়লুম আমি, লাহা এবং অর্ক, বাকী মূর্তিমানরা অন্য ঘরে।

হোটেলের পরিচারিকা দু’জন, মালকিন একজন, আর একজন বেহারা। তা এই পরিচারিকার মধ্যে একজনের মুখশ্রী দেখে আমাদের সক্কলেরই একবারে ‘আ কে সিধি লাগি দিল পে’ অবস্থা… এমকি হোটেলের মালকিন যখন পরিষ্কার বাংলায় বললেন,

-“আপনার রুমে যান, আমি খাওয়ার জল পাঠিয়ে দিচ্ছি…”

তখন আমি ধোবো আর অর্ঘ বলাবলি করছিলাম, ‘ভাই, কে জল আনবে বলত ?’

ঘরে গিয়ে জিনিসপত্র রেখেছি কি রাখিনি, হঠাৎই ধোবোর চিৎকার, এবং প্রায় আর্কিমিডিসের মতোই সে চিৎকারের ধরন।

-“ভাই ! একটা ফ্রী ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্ক ধরছে !!”

আমাদের ফোন খুলে দেখি, সত্যিই তো! হোটেলের পেছনে গিয়ে বুঝতে পারলাম, কেন ফ্রী ওয়াই ফাই। পাশেই যে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ… কিন্তু বাইরে বেড়িয়ে ফোনের দিকে তাকানোর ইচ্ছা আর কারোর করল না। কারণ, পারোর আকাশে তখন এক পশলা মেঘ, আর তার ফাঁক দিয়ে ফেটে বেড়িয়ে আসছে আলোর রশ্মি। সকাল থেকে নাকি বৃষ্টি হয়েছে, আর তাই আকাশে একটা রামধনুও উঠেছে। সবমিলে একটা যাকে বলে মেসমেরাইজিং ব্যাপার। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামা অবধি আমরা নদীর পাড়েই কাটালাম। তারপর, ঘরে গিয়ে জামাকাপড় ছেড়ে, একটু বাদে খেতে যাওয়া হল, পেরিজোরলিং-এরই রেস্তরাঁতে।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে, আবার ইচ্ছে করল নদীর ধারে হেঁটে আসি। তাই বেড়িয়ে পড়লাম সবাই। আকাশে মেঘ জমেছে, চাঁদের আলো নেই, রাস্তার আলোয় নদীর পাড় ধরে হাঁটতে থাকলাম। হাঁটতে হাঁটতে আমি আর লাহা সবার থেকে আলাদা হয়ে পড়লাম। অন্যদের ছাড়িয়ে অনেকদুর যাওয়ার পর, লাহা-ই বলল,

-“নীলুদা, এখানে একটু বসবে ?”

বসে পড়লুম। নদীর ধারে, স্ট্রীটলাইটের পাশে বসে, আপনা আপনিই মুখ থেকে বেড়িয়ে গেল গান…

“Of course, we have our differences
You shouldn’t be surprised
It’s as natural as changes
In the seasons and the skies
Sometimes we grow together
Sometimes we drift apart
A wiser man than I might know
The seasons of the heart…”

লাহা প্রশ্ন করল,

-“এ’টা কার গান, নীলুদা ?”

বললাম,

-“জন ডেনভার…”

তারপর গান চলল, একের পর এক কান্ট্রি মিউজিক। কথায় কথায় চোখ ভিজে গেল আমার… বলতে শুরু করলাম,

-“জানিস অর্ণব, এখানে আসার আগে আমার…”

ট্যুরের হাজার কথা মনে থাকলেও, সেদিন কি যে আবোল তাবোল বকেছিলাম, খেয়াল নেই। তবে আমার সেদিন বকার ফলাফল কি হয়েছিল, সেটা টের পেয়েছিলাম ঠিক এক বছর পরে। লাহা আমার জন্মদিনে একটা শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছিল। সেটা হুবহু এখানেই তুলে দিলাম, আশা করি অর্নব রাগ করবি না তুই…

তোমার সাথে আগের বছর জুনে আলাপ। শিয়ালদহ স্টেশনে। বাকি গল্পগুলো জানে ভুটান, পারোর নদী, ডেনভারের গান। ডায়মন্ড অ্যান্ড রাস্ট এ লুকিয়ে থাকে তারা। তারপর পাগলা গারদের জন্যে তো আরও জড়িয়ে পড়া। খুব ভালো থেকো। শুভ জন্মদিন। বাকিগল্প কলকাতায় ফিরে হবে।

আর আজ, ৫ বছর পড়েও, যখন সেই রাতটার কথা মনে পড়ে, তখন মনে হয় ভাগ্য কত ভালো থাকলে, নিজের দূর্বল মুহূর্তে ওরকম একজন বন্ধু পাওয়া যায় যে অচেনা দেশের অজানা শহরে রাত্তিরবেলা নদীর ধারে বসে একটা অচেনা লোকের বকবক শুনতে পারে ঘন্টার পর ঘন্টা।

ঘরে ফিরে আবার বসল UNO-এর আসর। অনেকেই আজ বেশ ক্লান্ত ছিল। আর সবার আগে উইকেটটা পড়ল হিমাদ্রির। সে বেশ নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে, আমরা উনো খেলছি, গান গাইছি, এখানে আমার আর ধোবোর একটা যূগলবন্দী ছিল, সেটা নিচে দেওয়া রইল।

হঠাৎ, ঘুমন্ত হিমাদ্রি, আমাদের দিকে পাশ ফিরল, ফিরে ঘুমের মধ্যেই, স্পষ্ট ভাবে বলল,

-“তুম মিলে…”

আমিও ফট করে বললুম,

-“দিল খিলে…”

কিন্তু, হিমাদ্রি আর কিছুই বলল না, সে জোরে জোরে নাক ডাকতে থাকল।

আমরা হেসে হেসে মরে যাচ্ছি প্রায়, কিন্তু হঠাৎ এই কথার রহস্য আমরা উদ্ঘাটন করতে পারলাম না। হাসতে হাসতেই মনে পড়ল, আজ সারাদিন গাড়িতে গান চালিয়ে হিমাদ্রি বোধহয় এখনও স্বপ্নের মধ্যে গান বেছে চলেছে। একচোট হাসাহাসি করে আমরা শুতে গেলাম, কাল সকালে তো আবার পর্বতারোহন করতে হবে।

সামনের সপ্তাহে তাহলে বাঘের বাসায় যাত্রা। আর এক কথায় বলতে গেলে, আমাদের ভুটান যাত্রার ‘হাইলাইট’। গোটা ট্যুরের যত কেচ্ছা, সেটা ঘটেছিল ওইদিনেই। ভুটান সফর যদিও শেষের পথে, তবু এখনো প্রচুর ঘটনা বাকী আছে…

শান্তির আশায়

নীল…

Advertisement

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.