সপ্তম পর্ব : পুনাখা
২০১১ সালে, ভুটানের বর্তমান রাজা, জিগ্মে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক (ইংরেজী থেকে বাংলায় লিখলে এরকমই দাঁড়ায়); রাণী জেৎসুন পেমা কে বিয়ে করেন এই পুনাখা দূর্গেই। বিয়ের আগে রাণী পড়াশোনা করেছেন সেন্ট জোসেফস কনভেন্ট, কালিম্পং-এ, আর পরে আবার লরেন্স স্কুল, হিমাচল প্রদেশ-এ। তাঁদের বিয়ের যৌতুক হিসাবে ভারত সরকারের তরফ থেকে একটি চার্টার্ড ট্রেনে রাজস্থানে মধুচন্দ্রিমা যাপনের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। আর এখানে আসা ইস্তক, আমরা লোকমুখে রাজারাণীর প্রশংসাই শুনে গেছি। ভুটানে বহুবিবাহ আইনসম্মত, কিন্তু রাজা বিয়ের পরই ঘোষণা করেন, ডিউ পার্টেতে তাঁর কোনও লোভ নেই।

এই চার বছর পড়েও, তাই পুনাখা দূর্গ সেই বিয়ের জাঁকজমকের কিছু স্মৃতিচিহ্ন বয়ে নিয়ে চলেছে, তাই পুনাখা দূর্গটা আগের দেখা সবগুলো ‘আখাং’-এর থেকে অনেকটাই ঝাঁ চকচকে।
পুনাখা হল মো নদী এবং পো নদের সংযোগস্থল। দূর্গটা ভালো করে ঘোরার পর, দূর্গের পাশ দিয়ে বয়ে চলে ‘মো ছুঃ’ অর্থাৎ মো নদীর পাড়ে, বরফ ঠান্ডা জলে পা ডুবিয়ে বসা হল। এমনকি শারুক্ষাণ মার্কা পোজ টোজ দিয়ে ছবিও তোলা হল কয়েকটা।
এছাড়া আমাদের দেখার জায়গা ছিল দু’টি কিন্তু পুনাখা থিম্ফু থেকে বেশ দুর হওয়ায়, আমাদের পুনাখা সারতেই বেলা দেড়টা বেজে গেল প্রায়। তাই ঠিক হল, আগে খাওয়া, তারপর জোমোলহারি আর দোচু লা পাস। আমাদের সারথী পুনাখা থেকে অনতিদুরে একটা লোকালয়ে ছেড়ে দিয়ে বললেন এখানে খাওয়া দাওয়া করে নিন। কিন্তু দেখা গেল, প্রথমত সেখানে রেস্তরাঁর সংখ্যা সামান্য, এবং বেশিরভাগেই খাবার নেই। আমরা খিদের তাড়নায় রেস্টোরেন্ট ভেবে একজনের বাড়ির বৈঠকখানায় ঢুকে পড়লাম একবার। এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে দেখা গেল একজায়গায় মাঠে লঙ্গরখানা জাতীয় কিছু একটা চলছে। ধোবো উৎসাহিত হয়ে উঠল।
-“ভাই, ফ্রীতে কাঙালভোজন করাচ্ছে বোধহয়। চল যাই, আজকের খাবার টাকাটা বেঁচে যাবে।”
আমি আর আফরোজ মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম। এ আমাদের প্রথম বেড়াতে যাওয়া নয়, আর সেটা আমাদের শেষ বেড়াতে যাওয়াও ছিল না। যেখানেই যাই, আমরা খাওয়ার ব্যাপারে কোনও কম্প্রোমাইজ করিনি। আমাদের বেড়াতে যাওয়ার বাজেটে সবসময় খরচ ওই ক্ষেত্রেই বেশী হয়। তাই কাঙালভোজনে আমরা একেবারেই উৎসাহী নই। তবু, দলে পড়ে মাঠের দিকে যেতেই হল। গিয়ে দেখা গেল কাঙালভোজন টোজন নয়, খাদ্য মেলা চলছে, মানে পশ্চিমবঙ্গের মেলা কালচার সীমান্ত পেড়িয়ে ভুটানেও ঢুকে পড়েছে।

সেখানেই মোমো থেকে শুরু করে ফ্রায়েড রাইস, খিচুড়ি, সবই আছে। জিজ্ঞাসা করতে একজন বলে এক প্লেট ছোলা বটোরা ১০০ টাকা, তাও মাত্র দুটো, আর এক একটা বটোরার আকার দেখলে মনে হয় সেই ছিয়াত্তরের মন্বন্তরপীড়িত সময় থেকে কেউ টাইম মেশিনে করে উড়িয়ে এনেছে। তৎসহ খাওয়ার বা ধোওয়ার (ধোবো ছাড়া) কোনও ব্যবস্থাই নেই।
ধোবো এবং অর্ঘ গদগদ হয়ে আবেদন করল,
-“দাদা, আপনিও বাঙালি, আমিও বাঙালি… কিছু ডিসকাউন্ট করে দিন…”
উত্তরে লোকটি আরও গদগদ হয়ে উত্তর দিল,
-“আরে দাদা! আপনিও বাঙালি !!! ফেল কড়ি, মাখো তেল… তুমি কি আমার পর ? তবে ৫০০-১০০০-এর নোট থাকলে দিতে পারেন, ওই উবগারটা আপনার করে দেব আমি।”
সে তো করবেনই। আট জনের পেট ভরাতে ৮০০ টাকার ওপর খসে গেল। আর সে খাবারের যা স্বাদ, এক্কেবারে জঘন্য। খাওয়া শেষ হলে বিল দিতে গেছিলাম আমি আর আফরোজ। লোকটি পুনরায় গদগদ হয়ে প্রশ্ন করল,
-“খাবার কেমন লাগল, দাদা ?”
আমি বেজার মুখে বললাম,
-“দাদা, আপনার খাবারও খেলাম, আর এই টাকার নোটের দু’পিঠ একবার করে চেটেও দেখলাম, একই টেস্ট…”
লোকটা এ কথা শুনে কেমন ভেবড়ে গেল। আমরা এবার সেই স্থান ত্যাগ করলুম। স্থান ত্যাগ করে, আমাদের গাড়োয়ান-এর খোঁজ করতে থাকলুম, অনেক কষ্টে তার দেখা পাওয়ার পর, গাড়িতে উঠেই ধোবো ক্ষোভ প্রকাশ করল
-‘কাঁহা নামা দিয়া থা ? খাবার-দাবার কুছ নেহি মিলতা হ্যায়। খামোখা একগাদা টাকা নষ্ট হো গিয়া…”
ধোবোর হিন্দির বহর শুনেই হোক, বা যে কোনও কারণেই হোক, ড্রাইভার সাহেবে বেদম ক্ষেপে গেলেন। গজগজ করে যা বললেন, সেটার সারমর্ম হল এই
-“কাল থেকে আমি আর আসতে পারব না… আপনারা অন্য গাড়ি দেখে নেবেন…”
এ কথা শুনে, ধোবো এবার একটু মলম লাগাতে উদ্যত হল;
-“আরে না না… প্রচুর খিদে পায়া থা না… তাই মাথা গরম হো গিয়া…”
ড্রাইভার সাহেবের রাগ নিরসন হল বলেই মনে হল…
এবার ধোবো প্রশ্ন করল,
-“আপকো চিমি আখাং মালুম হ্যায় ? যাঁহা ফার্টিলিটি গড কা মন্দির হোতা হ্যায় ?”
ড্রাইভার সাহেব প্রথমে বললেন জানি না, আর তারপর বললেন ‘বোধহয় ওইদিকে…’।
প্রথমত ফার্টিলিটি গড, তার ওপর ড্রাইভার সাহেবের মনে সন্দেহ, আর তার ওপর ধোবোর অমন হিন্দি। সব মিলিয়ে আমরা ঠিক করলাম, আমরা চিমি আখাং আমাদের ভ্রমণসূচী থেকে বাদ দিচ্ছি।

আমরা এগিয়ে চললাম দোচু লা পাস-এর দিকে। দোচু লা পাস-এ ১০৮টি শোর্তেন সম্বলিত একটি সমাধিভূমি আছে। একরাশ মেঘ হঠাৎ সেই সমাধিভূমিতে এসে একটা রহস্যময় পরিবেশের সৃষ্টি করলেও, এর পরের স্পটে, মানে আমরা জোমোলহারি/ঝোলমুহারি/ঝালমুড়ি দেখতে পাব কিনা, সে ব্যাপারে একটা সন্দেহের জাল বিছিয়েই দিয়েছে।

শোর্তেন ঘুরে, আমার আর অর্কর একটু হালকা হওয়ার ইচ্ছা হল, তা আমরা শোর্তেন থেকে বেশ দুরে এসে, মানে যেখানে আমাদের গাড়ি রাখা ছিল, সেখানে গিয়ে একটা আবডাল খুঁজে দাঁড়িয়েছি, অমনি কোথা থেকে এক লামা বিপজ্জনক ভাবে হাত মাথা নাড়তে নাড়তে ছুটে এল, আমরা বুঝতে পারলুম,
-“এখানে প্রস্রাব করিবেন না…”
অগত্যা, আমাদের সড়ে পড়তে এল। অর্ক বেশ হতাশার সুরে বলল,
-“লামাটা মুততে দিল না ভাই…”
আমি বেশ গম্ভীর মুখে বললাম,
-“ওই লামাটার নাম জানিস?”
-“না…”
-“ওর নাম লামা মুতভাগানে… ওর কাজ এখানে কেউ মুততে এলে তাদেরকে ভাগিয়ে দেওয়া…”
এই বলে দু’জনেই বেদম হেসে উঠলাম।
দোচু লা পাস থেকে যাওয়া হল মাউন্ট জোমোলহারি ভিউ পয়েন্টে। কিন্তু গাদা গুচ্ছের মেঘ থাকায় কিছুই দেখা গেল না। এক আকাশ ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘ ছাড়া। আমরা বেশ হতাশ হয়ে পড়েছি, সন্ধ্যেও হতে চলল, কাল আমাদের আবার থিম্ফু ছাড়তে হবে, তার গোছগাছ বাকী আছে। আমরা সবাই এবার ফেরার জন্য গাড়িতে উঠব বলে তৈরী হচ্ছি, এমন সময় অর্ঘ উত্তেজিত হয়ে আকাশের দিকে আঙুল দেখিয়ে চেঁচিয়ে উঠল।
-“ঐ দেখ !!!”
আমরা তাড়াহুড়ো করে ছুটে এলাম।
-“কি রে ? ঝোলমুহাঁড়ি দেখা যাচ্ছে নাকি ?”
-“না, কিন্তু হাঁড়িতে ঝোল ফুটছে ভাই… দেখ না কত ধোঁয়া…”
আমরা আবার একচোট হেসে নিলাম।

হোটেলে ফিরে সব গোছগাছ করছি, হঠাৎ লাহা এসে আমাকে বাইরে ডাকল।
-“নীলুদা, একবার শুনে যাও…”
লাহার সাথে নেমে গেলুম হোটেলে গ্রাউন্ড ফ্লোরে। আমাদের হোটেলের সাথে একটা বার ছিল। সেটার দরজার দিকে নির্দেশ করে বলল,
-“দেখলাম, একজন করে কাউন্টারে বসছে, একটা করে মেয়ে এসে কথাবার্তা বলছে, আর তারপর বেড়িয়ে ওপরে চলে যাচ্ছে…”
-“বোঝাই যাচ্ছে কি চলছে, তোর দাবীটা কি ?”
-“চল না, একটা বিয়ারের বোতল নিয়ে বসি, দেখি কি হয়…”
-“আরে !!! ভাই, কাল দরজায় আড়ি পেতেছি ঠিক আছে, কিন্তু এত বড় ঝুঁকির এক্সপেরিমেন্ট আমি করতে পারব না, সরি… আমার অত টাকা নেই…”
-“আরে বিয়ার আমি কিনছি না হয়…”
-“বিয়ারের টাকার কথা বলিনি বাপ… ভাবনাও কো সমঝো… আর এবার ওপরে চল, ব্যাগ গোছাতে হবে।”
আমার এই কথার পর দু’জনে হাসতে হাসতে ওপরে উঠে এলাম।
রাতে আর উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটল না, মানে যে আমাদের ষড়যন্ত্রে ডজন ডজন Wild+4 কার্ড খেয়েও কিছুই বুঝছিল না, সেটা বাদ দিয়ে। থিম্ফুতে শেষ ঘুম ঘুমানোর জন্য শুয়ে পড়লাম। আসলে জানতাম না, উল্লেখযোগ্য ঘটনাটা কাল সকালে ঘটার জন্য তোলা ছিল…
কেমন লাগছে ? জানান… অপেক্ষায় রইলাম… আর তাহলে সামনের সপ্তাহে, দেখা হচ্ছে , পারোর পথে… আর পুনাখার খাবার ক্রাইসিসের ঘটনাটা আবার ভালো করে মনে করিয়ে দিল আফরোজ…
শান্তির আশায়,
নীল…
Daarun lagche… Refreshing.. tor lekha pore amar ghorar kotha gulo mone pore jache!!
Keep it up.. 👍
LikeLiked by 1 person
Good job, keep it up brother..
LikeLiked by 1 person
Pingback: Wanderlust : Land of the Thunder Dragon – Part 7 — Libberish | Mon site officiel / My official website