পঞ্চম পর্ব : থিম্ফু দর্শন
নিজের ঘর ছেড়ে বেড়োলেই আমার সক্কাল সক্কাল ঘুম ভেঙে যায়। তাই বেড়াতে গিয়ে আমার জন্য অন্তত কারোর কোনওদিন দেরী হয়নি। সকালে ঘুম ভাঙল তখন বাজছে প্রায় সাতটা। সকাল ন’টায় গাড়ি বলা আছে, আর অন্য কেউ ওঠেনি দেখে, আমি তাড়াতাড়ি স্নানটা সেরে নিলাম, বেড়িয়ে দেখলাম আমার বাকী রুমমেটরাও উঠে পড়েছে।
আমি পাশের ঘরে গিয়ে দরজা ধাক্কাধাক্কি করতে হিমাদ্রী এসে খুলল, আর আমি ঘরে ঢুকে দেখলাম, হিমাদ্রী আর অর্ণব ছাড়া সবাই অঘোরে ঘুমোচ্ছে। আমি ঘরে ঢুকে একটা হাঁক মারলাম,
-“ওরে, উঠে পড়, গাড়ি আসবে তৈরী হয়ে নে…”
আমার এ হুঙ্কারে সবার আগে ধড়মড় করে উঠে বসল ধোবো। সে রাতে চশমা পড়ে শোয়নি, (বোধহায় খালি চোখেই স্বপ্ন দেখতে পায়) আর উঠে আমার দিকে তাকিয়েই আর্তনাদ করে উঠল;
-“তুই কে? কে তুই??”
আমি হেসে উত্তর দিলাম, -“আমি নীলোৎপল…”
-“কে নীলোৎপল ?”
-“তোর কি নেশা কাটেনি? মাতাল কোথাকার…” এই বলে আমি হাসতে হাসতেই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলাম।
তখনো বাকীদের তৈরী হতে সময় লাগবে, তাই আমি ভাবলাম, যাই, একটু ঘুরে আসি এদিক ওদিক। চলে গেলাম নিচে। নিচে গিয়েই প্রথম দেখা হয় সারমেয় সন্তানটির সাথে। তাকে বেশ ভালো করে আদর করে নিচে হোটেলের সামনে থেকে ঘুরে এলাম। সত্যি কথা বলতে কি, ‘শৈলশহর’ বলতে যা বোঝায়, তাতে আমার আসা এই প্রথম। আমি এর আগে দার্জিলিংও যাইনি একবারও। আর থিম্ফু অত্যন্ত সুন্দর, সাজানো গোছানো একটা শহর।

নিচের দিকে তাকালে রাস্তা, গাড়ি, বাড়িঘর, আর একটু ওপরে চোখ তুললেই পাহাড়ের সারি। এখনো ভাবলে মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়, গায়ে কাঁটা দেয়।
ক্লক টাওয়ারে দেখলাম, বাজছে সকাল ৮টা ১৫, ভাবলাম যাই, বাকীদের হাল-হকিকত জেনে আসি। ভেতরে ঢুকে ওপরে উঠতে যেতেই, ম্যাস্টিফনন্দন আমার পেছন পেছন লাফাতে লাফাতে ওপরে উঠে এল। এখন ধোবো-র কুকুরে বেদম ভয়। তাই আমার পেছনে কুকুর দেখেই সে দড়াম করে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল। তবে তার চেহারা দেখে মনে হল, স্নান হয়ে গেছে।
আমি আমার ঘরে ঢুকে দেখলাম, আফরোজ আর লাহা তৈরী, অর্ক স্নানে ঢুকেছে। এমন সময় বাইরে থেকে ধোবো-এর আর্তনাদ শোনা গেল,
-“নীলোৎপল !!!!!!!!!!!!!!!!!!”
আমি তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেড়িয়ে দেখলাম, দরজার ফাঁক থেকে উঁকি মারছে ধোবোর চশমা পড়া মুখ, সে চোখে আতঙ্ক। আর তার ঠিক সামনে বসে মহানন্দে ল্যাজ নাড়ছে কুকুরটা। আমাকে দেখতে পেয়েই ধোবো আবার আর্তনাদ কর উঠল;
-“কুকুরটা ভৌ করছে !!!!”
আমার কথার উত্তরটা অর্ঘ দিল ঘরের ভেতর থেকে,
-“শালা সক্কালবেলা ভাঁট বকতে শুরু করেছে। কুকুরে ভৌ করবে না তো কি হাম্বা করবে নাকি ? বন্ধ কর দরজা… মাতাল কোথাকার…”
ওদিকে ধোবোর চিৎকারে হোটেলের লোকজন ছুটে এসে কুকুরটা কে টানতে টানতে নিয়ে গেল।
সবাই তৈরী হয়ে সাড়ে ন’টা নাগাদ নিচে নেমে দেখলাম সারথি হাজির। সবার আগে যাওয়া হল থিম্ফু পারমিট অফিসে। ফুন্টশোলিং থেকে আমাদের যে পারমিট দেওয়া হয়েছিল, সেটাতে আমরা শুধু থিম্ফু অবধিই ঘুরতে পারি, কিন্তু পুনাখা, হা ভ্যালি এবং পারো যাওয়ার জন্য আমাদের অন্য পারমিট লাগবে। তাই কাগজপত্র জমা দিয়ে দেওয়া হল। থিম্ফু শহরে গাড়ির স্পিড লিমিট ২০-৩০ কিমি/ঘন্টা। প্রতিটা রাস্তার পাশে গাড়ির অ্যাঙ্গুলার পেইড পার্কিংয়ের জায়গা আছে। আর গোটা শহরে, হর্ন নিষিদ্ধ। রাস্তা এমনিতেই ফাঁকা, তার ওপর গাড়ি চললেও হর্নের বিকট প্যাঁ পোঁ শোনা যাচ্ছে না। অফিসে, দোকানে যে বা যারা কাজ করছে, যারা ট্যাক্সি বা গাড়ি চালাচ্ছে, তাদের সবার পরনেই কিমোনো। এটা নাকি আইন। তুমি যতক্ষণ অফিস আওয়ার্স-এ, কোনও জীবিকা নির্বাহ করছ, মানে সকাল ৯টা থেকে ৫টা এবং শীতকালে ৯টা থেকে ৪টে, এই সময়টা কিমোনো পড়া বাধ্যতামূলক। এবার তার আগে বা পড়ে তুমি যা খুশি পড়।
সেখান থেকে বেড়িয়ে একটা দোকানে ঢোকা হল, প্রাতরাশ করতে, আর তখনই প্রথম অর্ক প্রতিবাদ জানাল,
-“ভাই, সব দোকানে অফিসে রাজা-রাণীর ছবি কেন টাঙ্গানো থাকবে?”
তার উত্তরে অর্ঘ গম্ভীর ভাবে বলল,
-“আঙুল দিয়ে পয়েন্ট করিস না, আঙুল কেটে নেবে…”
অর্ক চট হাতটা নামিয়ে নিয়ে, একটু হেসে বলল,
-“না, মানে এইভাবে মনার্কি…” -তার কথা শেষ হওয়ার আগেই অর্ঘ আবার একই রকম গাম্ভীর্যের সাথে বলল,
-“ওভাবে তাকাস না, চোখ গেলে নেবে…”
তাই অর্ক-র এইরকম ‘ফ্যাসিজম’ বা ‘মনার্কি’-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো আর হল না, কারণ তার প্রতি বাক্যের উত্তরেই অর্ঘ তাকে শরীরের বিভিন্ন অংশ কাটা পড়ার হুমকি দিতে থাকল।
আমাদের প্রথম গন্তব্য ‘বুদ্ধ পয়েন্ট’। বুদ্ধ পয়েন্ট থেকে গোটা থিম্ফু দেখা যায় এবং সেখানে একটি প্রকান্ড বুদ্ধমূর্তি আছে। ছবিটা আপনারা আমার ওয়েবসাইটের কভারেই দেখতে পাবেন, আর আবারও এখানে দিয়ে দিলাম। তা বুদ্ধ পয়েন্টে বেশ ভালো একটা ফটো সেশন হল, বুদ্ধদেবের কাঁধে হাত দিয়ে, তারপর এদিক ওদিক। ভিউ পয়েন্ট বলে সেরকম দেখার কিছু ছিল না, থিম্ফুর শোভা এবং বুদ্ধমূর্তি ছাড়া।

তাই আমরা পৌঁছে গেলাম পরের গন্তব্য, ন্যাশানাল মেমোরিয়াল শোর্তেন-এ। আমার মতো যারা ছোটবেলা থেকে তিব্বতে টিনটিন গোগ্রাসে গেলেন নি, তাদের জানিয়ে রাখি, শোর্তেনে লামাদের চিতাভষ্ম রাখা থাকে। এবং, শোর্তেনের বাঁদিক দিয়ে গেলে দূর্ঘটনা ঘটে; সেটা লক লোমন্ডের বোতল ভেঙে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন ক্যাপ্টেন হ্যাডক। আর পারোতে ট্রেকিং-এর দিন যা যা ঘটেছিল, তাতে এখন সহজেই আন্দাজ করতে পারি কে কে সেদিন বাঁদিক দিয়ে শোর্তেন পেরিয়েছিল।

কি হল ? ভাবছেন ছেলেটার কত কুসংস্কার ? একেবারেই না মশাই। আমাকে হাজারটা জিনিস মানতে বলুন, মানব না, কিন্তু টিনটিন, অ্যাস্টেরিক্স, টেনিদা? সেটা একেবারেই অন্য ব্যাপার। এই আমিই, ভুটান ভ্রমণের এক বছর পড়, যখন দার্জিলিং যাই, তখন একটা রেস্তরাঁর মেনুতে ‘শাম্পা’ দেখে তৎক্ষণাৎ অর্ডার করি, কারণ টিনটিন তিব্বতে যাওয়ার পথে শাম্পা খেয়েছিল।
তাই হ্যাঁ, কুসংস্কার আমার একেবারেই নেই, তবে মাথায় গন্ডগোল আছে কিনা, সেটা আলাদা প্রশ্ন।
এরপর চলে গেলাম মটিথাং টাকিন প্রিজার্ভে। টাকিন ভুটানের জাতীয় পশু, তবে সত্যি করে, বাঘ যে দেশের জাতীয় পশু, তারা যদি ‘বিদেশে’ গিয়ে দেখে সে দেশের জাতীয় পশু একটু গ্ল্যামারাস ছাগল ছাড়া আর কিছুই নয়, তাহলে একটু হতাশ হতে হয় তো বটেই।

-“এ মা… এ তো কেমন গোদা মার্কা ছাগল রে, ধুর…”
-“আরে ভাই তুই তো বললি কিসব অ্যান্টিলোপ না কি… এ তো একটা রামছাগলকে রং চং করিয়ে ছেড়ে দিয়েছে মনে হচ্ছে…”
যাই হোক, এই হতাশাব্যঞ্জক ঘটনার পড়, সকাল থেকে চা, বিস্কুট আর কেক খেয়ে থাকা আমরা এবার দুপুরের খাওয়াটা সেরে ফেলব ভাবলাম, আর গিয়ে পৌছোলাম একটি ভোজনশালায়।
কাল রাতে যখন গোমাংশ ভক্ষণ করেই ফেলেছি, তখন আর ভাবনা কিসের? অম্লানবদনে অর্ডার করলাম,
-“পর্ক চাওমেইন…”
এবং খাওয়া দাওয়ার পর, ভাবা হয়েছিল তাশি ছো জং (Tashi Chho Dzong), যেটাকে ‘থিম্ফু জং’ও বলা হয়ে থাকে; যাওয়া হবে, কিন্তু সেদিন বোধহয় বন্ধ ছিল না কিছু একটা সমস্যা ছিল, ঠিক মনে পড়ছে না। তাই যাওয়া হল চংগংখা আখাং (Changangkha Lhakhang), ‘জং’ আর ‘আখাং’ কথাদুটো তিব্বতী এবং এদের অর্থ যথাক্রমে ‘দূর্গ’ এবং ‘মঠ’। চংগংখা আখাং ঘুরে যাওয়া হল ‘সিমপ্লি ভুটান’।

এই সিমপ্লি ভুটান হল গিয়ে একটা ছোট্ট এলাকাকে ভুটানের ট্র্যাডিশনাল গ্রামের মতো করে সাজিয়ে রাখা আছে, একটা বাড়িতে মুর্তি বানিয়ে, দেখানো হয়েছে, আগে ভুটানের গ্রাম্য জীবনযাত্রা কেমন ছিল। এখানের ছবি নেই, কারণ তোলা নিশেধ।
কিন্তু ধোবো তখন রেবেল মোডে।
-“আরে, টুক করে ছবি তুলে নেব ফোনে কেউ কিচ্ছু বুঝতে পারবে না, তোরা একটু গার্ড করে দাঁড়া।”
তা দাঁড়ালাম আমরা, আর ধোবো আধা অন্ধকার ঘরে ছবি তুলতে গিয়ে দুম করে ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে দিল এবং তারপরেই আধ হাত জিভ কেটে ফেললেও আশেপাশেই থাকা সিকিওরিটি গার্ড সেটা দেখে ফেলেছে। আপনি বাঁচলে বাপের নাম, তাই আমরা তৎক্ষণাৎ ‘রেবেল ধোবো’ কে পরিত্যাগ করলাম, করে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে ওপরে উঠে গেলাম। মিনিট পাঁচেক বাদে বেজার মুখে ধোবো ওপরে উঠে সে বলল,
-‘খিস্তি দিল ভাই…”
আমরা সেটার উত্তরে খ্যা খ্যা করে হেসে নিলুম বেশ কিছুটা।
জানি, আমিও ভেবেছিলাম, একদিনেই থিম্ফুর গোটা দিন রাতের ঘটনা লিখে ফেলব, কিন্তু থিম্ফুতে দ্বিতীয় রাত অনেক বেশী স্মরণীয় ছিল, তাই সেটার জন্য একটা আলাদা পর্ব লিখতেই হবে। তবে সেই পর্বেই হয়তো আমরা পুনাখাটাও ঘুরে আসতে পারি।
শান্তির আশায়,
নীল…
পুনশ্চ, আজকের ছবিগুলো আমার, হিমাদ্রির এবং আফরোজের তোলা…
Pingback: Wanderlust : Land of the Thunder Dragon – Part 5 — Libberish | Mon site officiel / My official website