Wanderlust : Land of the Thunder Dragon – Part 4

চতুর্থ পর্ব : থিম্ফুতে প্রথম রাত

তখন গাড়ি চালাতে জানতাম না ঠিকই, কিন্তু পাহাড়ে বাঁক ঘোরার মুখে যে গাড়িতে বার বার হর্ন দিতে হয়, সেটুকু সাধারণ জ্ঞান আমার ছিল। কিন্তু আমাদের ড্রাইভারসাহেব হর্ন একেবারেই ব্যবহার করছেন না দেখে, সামনে বসা আফরোজই জিজ্ঞাসা করল,

-“আপনি হর্ন ব্যবহার করছেন না কেন?”

উত্তরে নির্বীকার মুখে ড্রাইভারসাহেব উত্তর দিলেন,

-“আমার গাড়ির হর্ন খারাপ…”

গাড়ির সবাই সে উত্তরে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল, আমি একবার মুচকি হেসে চোখ বুজলাম। পেছনের সীটে জানলার ধারে বসেছি, মুখে ফুরফুর করে হাওয়া লাগছে, আর তাতেই সারারাত ট্রেনযাত্রার ক্লান্তিটা আরও যেন চেপে বসেছে শরীরে। আর গাড়ির হর্ন যে নেই, সে নিয়ে বিন্দুমাত্র দুশ্চিন্তা আমার নেই, কারণ-

১) হেঁটে থিম্ফু যাওয়া যাবে না।

২) অন্য গাড়িও পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।

৩) এখন পিছু ফেরার প্রশ্নই ওঠে না।

৪) আমাদের থেকে আমাদের গাড়োয়ান এই রাস্তা ঘাঁতঘোঁত অনেক ভালো চেনেন…

ঘুম…

তাই, আমি অচিরেই ঘুমিয়ে পড়লাম। বেশ কয়েক ঘন্টা পর যখন ঘুম ভাঙ্গল, তখন রাস্তার পাশে একটা জায়গায় থেমে মুত্র বিসর্জনের পালা চলছে। দেখলাম, অর্ক, ধ্রুব বেশ গভীরভাবে আলোচনা করছে,

-“ভাই, আর একটু ধারে গেলেই, গাড়ি নিশ্চয়ই খাদে নেমে যেত…”

-“হ্যাঁ ভাই, জল দে… আমার গলা শুকিয়ে আছে…”

আমি সে কথা শুনতে পেয়ে বললাম,

-“তোদের এত ফাটছে কেন বলত ?”

-“শোন, তুই তো ঘুমাচ্ছিলি… দেখিস নি, চাকাটা কিরকম বিপজ্জনক জায়গায় চলে গেছিল… ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে…”

-“আহা, চলে গেছিল… খাদে নেমে তো যায়নি… আগে খাদে গাড়িটা গড়াতে শুরু করুক, তারপর না ভয় পাওয়া যাবে টাবে।”

আমার এ কথার উত্তরে দু’জনে কি প্রতি-উত্তর দেবে, ভেবে না পেয়ে চুপ করে গেল। গাড়ি চলতে শুরু করল আবার। এক পশলা ঘুমের পর, আর আমার ঘুম আসছে না। জানলার ধার দিয়ে রাস্তা দেখতে দেখতে যাচ্ছি। ফুন্টশোলিং-এ রোদে, এবং গরমে মনেই হচ্ছিল না যে নর্থ বেঙ্গলে আছি; এখন আস্তে আস্তে তাপমাত্রা নিম্নগামী হচ্ছে এবং হাওয়ায় তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এতক্ষণে বেড়াতে এসেছি বলে মনে হচ্ছে।

গাড়ি আবার থামল একটি ‘মিডওয়ে ক্যাফে’-তে। তখন বাজছে প্রায় আড়াইটে। বেশ ঠান্ডা পরে গেছে, তাই গায়ে গরমজামা চাপাতে হল। ধোবো-এরও এবার আর শুধু মাফলারে কাজ হল না, সেও একটা জ্যাকেট চাপাল।

মিডওয়ে ক্যাফে…

মিডওয়ে ক্যাফেতে খেতে বসলাম। এখানে একটা কথা বলি, আমি ক্লাস টুয়েলভ থেকে এতদিন অবধি ঘোরতর নিরামিষাশী ছিলাম। জানি, আমার জীবনের একটা কালো অধ্যায়, এবং প্রচুর লোককে জ্বালিয়েছি সেজন্য। কিন্তু ছিলাম। তাই আমি পনীরের সাথে ভাত বা রুটি জাতীয় কিছু নিলাম। ঠিক মনে নেই।

খেয়ে নিয়ে গাড়ীতে ওঠার আগে আবার জায়গাটার চারপাশ ভালো করে দেখে নিলাম। মিডওয়ে ক্যাফের সামনেই পেট্রল পাম্প, পেট্রল পাম্প পেরিয়ে রাস্তা, আর রাস্তার পাশেই পাহাড়ের সারি।

একটু পড়ে, সবার খাওয়া দাওয়া হলে, আবার বেড়িয়ে পড়া হল। এবার সবার মনই হলিডে মোডে। গাড়িতে গান চলছে অনুপম রায়ের,

“হম চলে বাহারো মে, গুনগুনাতি রাহো মে, ধড়কনে ভি তেজ হ্যায় অব ক্যায়া করে

ফুরফুরে ঠান্ডা হাওয়ায় পেছনে ফেলে রাখা রাস্তা যেন নিমেষে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। আলো কমতে থাকার সাথে সাথে উইন্ডস্ক্রীনে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিরও আগমল ঘটল। অল্প আলো থাকতে থাকতেই পৌঁছে গেলাম থিম্ফু। তখন ভালোমতোই বৃষ্টি শুরু হয়েছে।  ড্রাইভারকে ছেড়ে দিয়ে, তাকে পরদিন সকালে আসতে বলে এবার আমরা চললাম হোটেলের সন্ধানে।

আটজন আছি, তাই চেষ্টায় ছিলাম, ফোর বেডরুম পাওয়া গেলে ভালো হয়, দুটো ঘরে হয়ে যাবে, ট্যাঁকেও টান পড়বে না। এদিক ওদিক ঘুরে টুরে দু’একটা হোটেলে চেষ্টা করলাম; ১২০০-১৫০০ টাকার মতো এক একটা ঘরের ভাড়া। শেষে একটা হোটেল পেলাম, তারা বলল যে ফোর বেডরুম নেই, তবে থ্রি বেডরুম আছে, আর তার যা খাটের চেহারা, তাতে চারজন অনায়াসে ধরে যাবে, ঘরভাড়া ৮০০ টাকা। আমরা গিয়ে ঘর দেখে এলাম। নাহ, নেহাত মন্দ বলেনি, হয়তো চারজন হাতপা ছড়িয়ে শুতে পারব না, কিন্তু মোটের ওপর রাত্রিবাসের জন্য উপযুক্ত। ধোপদুরস্ত না হলেও, আমার হোটেলে ঢুকেই হোটেলটা পচ্ছন্দ হয়ে গেছে, কারণ হোটেল মালিকের একটা পোষা টিবেটান ম্যাস্টিফের বাচ্চা আছে, আর যারা নিজের চোখে টিবেটান ম্যাস্টিফ দেখেননি, তাদের অনুরোধ করব, একবার কষ্ট করে গুগল করে দেখে নিন। ৩ মাস বয়সী শিশুটির আকার ছিল প্রায় একটা প্রমাণ সাইজের জার্মান শেফার্ডের মতো। তাই আমি কুকুর ঘাঁটছিলাম, আর বাকিরা কথাবার্তা বলে আমাদের চেক ইনের বন্দোবস্ত করছিল।

থিম্ফুর ক্লক টাওয়ার… রাতে…

হোটেলে চেক ইন করে ঘরে গিয়ে স্নান করলাম, সকাল থেকে স্নান করা হয়নি। আর স্নান করে আমাদের মধ্যেই কেউ একজন গেল ভুটানি হুইস্কির সন্ধানে। আমি, আফরোজ, লাহা আর অর্কও বেরোলাম, আমাদের হোটেলের সামনেই একটা ক্লক টাওয়ার ছিল, সেখানে গিয়ে বসলাম। তখন দোকানপাট বন্ধ, রাস্তা শুনশান। বেশ কিছুক্ষণ পর, ঘরের যাব বলে হোটেলে ঢুকে রিশেপশানে খাওয়ার জল চাইছি, এমন সময় দেখতে পেলাম, একটা কাগজে প্রিন্ট করে দেয়ালে লাগানো ছোট্ট বিজ্ঞপ্তি;

“Condoms are available in the reception”

বটে? ফুর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ! আফরোজ কে ডেকে দেখালুম। আফরোজ একটা ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হাসল। যাই হোক, যারা মদিরা সংগ্রহে গেছিল, তারাও ততক্ষণে ফিরে এসেছে। সবাই মিলে এবার খেতে যাওয়ার কথা ঠিক হল। বাইরে বেড়িয়ে, হেঁটে কিছুদুর গিয়ে একটা রেস্তরাঁতে গিয়ে বসা হল। সবাই মিলে মেনু দেখে অর্ডার দেওয়া হল, আমিও ভালো করে আগাপাশতালা দেখে, গত পাঁচ বছর ধরে ঘোর নিরামিষাশী সেই আমি, অর্ডার দিলাম ‘বিফ চাউমেইন’। সেটা দেখে সবাই, বিশেষ করে আফরোজ আমার দিকে বেশ অবাক হয়ে তাকাল, সত্যি কথা বলতে কি, অর্ডার দেওয়ার সময় আমারও কেমন মনে হচ্ছিল, খেতে পারব তো? গা গুলোবে না তো?

যাইহোক, খাবার আসার পর, এবং সেটা মুখে প্রথম তোলার পর, বেশ সুস্বাদুই লাগল, এবং কারোর সাহায্য ছাড়াই, খেয়ে ফেললাম পুরোটাই। তারপর, হেঁটে হেঁটে হোটেলে ফিরে, আবার UNO নিয়ে বসা হল।

এবার একটা কথা বলি, মোট আটজন ছিলাম, গল্পের প্রথমে বলেছিলাম ঠিকই, লুকোবো না, তাই হুইস্কির কথাটা লুকোইনি; কিন্তু কে কে সে রসে বঞ্চিত, এবং কে কে একের পর এক ‘নীট’ পেগ গলাধঃকরন করেছে, সে প্রসঙ্গ এখানে আনছি না; যদিও এ ব্যাপারে আমি মৌচাকের উত্তম কুমারেরই মতাদর্শী, যে ‘মদ খেলে চরিত্র খারাপ হয় না, লীভার খারাপ হয়’। কিন্তু “সমাজের” চোখে কার চরিত্র ভালো (বা খারাপ), অন্তত এ ব্যাপারে, সেটা প্রতিষ্ঠা করতে আমি নারাজ। তাই ভুটানি হুইস্কি সহযোগে UNO খেলা শুরু হল, কেউ কেউ খেলল এবং গলা ভেজাল, আর কেউ কেউ শুকনো মুখেই UNO-কার্ড পেটাল।

কিন্তু এবার ঝগড়া শুরু হল অন্য কারণে। কেউ একটা ভুল কার্ড খেললে, বা নিয়ম ভুলে গেলেই, তাকে দু’রকম গালাগাল খেতে হচ্ছিল,

সে যদি একবিন্দু হলেও মদ খেয়ে থাকে, তাহলে তাকে বলা হচ্ছিল,

-“তোর কি নেশা চড়ে গেছে, যে ভুলভাল দান চালছিস? মাতাল কোথাকার…”

আর সে যদি মদ না খেয়ে থাকে, তাহলে,

-“দুর শালা… মদ খাচ্ছে ওরা, তোর কি করে নেশা হয় রে ? মাতাল কোথাকার…”

তা এই ধরণের ‘পোলারাইজিং’ অনেক ঝগড়া ঝাঁটির পর, খেলা গুটিয়ে শুতে যাওয়া হল, তখন প্রায় ১২টা-১টা।

একটা ঘরে আমি, আফরোজ, লাহা আর অর্ক, অন্য ঘরে অর্ঘ্য, ধোবো, অর্ণব আর হিমাদ্রী…

বিছানায় শুতে যাব, এমন সময় জনাব আফরোজ এহসানের আবিস্কার;

-“ভাই, এই দ্যাখ…”

এই বলে সে ঘরের অচল টিভির মাথা থেকে যে জিনিসটা তুলে দেখাল, সেটা একটা ফলস আইল্যাশ…

-“এ শালা কোন হোটেলে উঠলাম, আমরা ?”

আমি বললাম,

-“চাপ নেই, শুধু আইল্যাশ তো… গোটা মেয়েটা ঘরে থাকলে একটা সমস্যা ছিল… শুয়ে পড়; কাল সক্কাল সক্কাল বেরোনো আছে…”

এই বলে ঘরের আলো নিভিয়ে চারজনে বিছানায় গাদাগাদি করে শুয়ে, চোখটা বুজেছি, আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে এক্কেবারে ঘুমিয়ে কাদা।

ভুটান পৌঁছে গেলাম অবশেষে… এবার থিম্ফু ভ্রমণ… শনিবার থিম্ফু-র দর্শনীয় স্থানগুলো ঘোরা যাবেখন…

শান্তির আশায়…

নীল…

Advertisement

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.