দ্বিতীয় পর্ব : অনুমতি ও প্রস্তুতি…
বাড়িতে কবে বলব, এটা একটা বড় সমস্যা ছিল; কারণ সেমিস্টারের এক মাস আগে বেড়াতে যাওয়ার জন্য অনুমতি চাইতে গেলে গালাগাল খাওয়াই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু যদি সেমিস্টারের পরে, মানে তখন হয়তো জুনের ১০ তারিখ দাঁড়াবে, সে সময় যদি অনুমতি চাই, আর বলি একমাস আগে টিকিটও কাটা হয়ে গেছে; তাহলেও বিপদ। মান্না দের গানের লাইন তুলে দিলে-
জীবন করেছি আমি, শাঁখেরই করাত…
লড়ে যাও দাদা (মান্না দে)
কিন্তু ভাবলাম, না… ওসব চলবে না… সেমিস্টারের আগে এসব কথা বলা যাবে না; সেমিস্টারটা মিটে যাক, তারপর না হয় লড়াই করা যাবে। এইসব ভেবে ভুটান তখন মাথা থেকে বের করে রাখলাম। কারণ তখন বড় চিন্তা ছিল প্রজেক্ট, পরীক্ষা এবং যতই শুনতে একঘেয়ে লাগুক, হৃদয় বেদনা। যাঁরা ভাবছেন ‘আপনি কি ব্রেক আপ ছাড়া পাহাড়ে পৌঁছতে পারেন না?’ তাঁদের কাছে আমার সত্যিই কৈফিয়ৎ দেওয়ার কিছুই নেই। কারণ কপালদোষে, মৈনাকেরও ব্রেক আপ হয়েছিল নর্থ বেঙ্গল যাওয়ার আগে, আর ভুটানযাত্রার আগে আমারও ব্রেক আপ হয়েছিল। এই দুই ‘ইন্সিডেন্স’-এর আগে ‘কো’ শব্দটা না জুড়ে কোনও উপায় নেই, সে আপনারা যতই আন্দোলন করুন না কেন।
সেই সময়টার সাথে একটা অদ্ভূত মিল পাই আমি আজকের এই লকডাউনের। ঘরে মন টিকত না; কিন্তু ঘরে বসে মুখ গুঁজে কাজ করা ছাড়া কোনও উপায়ও ছিল না। কিন্তু কাজই যখন করতে হবে, তখন নিজের ঘরে বসার আর প্রীতমের মেসের ঘরে বসার আর তফাত কি? বরঞ্চ কথা বলার দু-একটা লোকও পাওয়া যাবে। তাই প্রতিদিন সকালে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বেড়িয়ে যাওয়া এবং সারাদিন কাজ করে শেষ মেট্রো ধরে বাড়ি ফেরা। বাড়ি ফিরেও খেয়েদেয়ে কাজ করা, অন্তত ল্যাপটপ খুলে রাশিকৃত ডাটার দিকে তাকিয়ে থাকা, যাতে নিজেকে যতটা পারা যায় ক্লান্ত করে ফেলা যায়, যাতে বিছানায় শুলেই, ঘুম চলে আসে, আর অন্ধকার ঘরটাতে একা জেগে কাটাতে না হয়…
যাই হোক, ইতিমধ্যে আমার সহযাত্রীদের সাথে ফেসবুক মারফত কিঞ্চিৎ পরিচয় হয়েছে; আমি আর আফরোজ ছাড়া, তারা হল আফরোজেরই ব্যাচমেট, ধ্রুব দত্ত চৌধুরী, অর্পন কুন্ডু, অর্ঘ্য ব্যানার্জী, অর্নব পাল, রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের অর্করুদ্র কর, আর প্রেসিডেন্সিরই জুনিয়ার হিমাদ্রী রায় এবং অর্ণব লাহা। সব ‘শুরু থেকে শেষ’ পদার্থবিদ্যার মাঝে এক আমি, তিনবছর পদার্থবিদ্যা পড়ে অন্যত্র নাড়া বাঁধতে বাধ্য হয়েছে যে। তখন মোবাইল ডেটা সহজলভ্য না হওয়ায় হোয়াটস্যাপের থেকে ফেসবুকের প্রয়োজন এবং প্রচলন দুটোই বেশী ছিল, তাই ‘ভুটান ট্রীপ’ নামে একটি গ্রুপ তৈরী হল, এবং সেখানে বিবিধ আলোচনা চলতে থাকল। কিছু কিছু উদাহরন আমি স্ক্রীনশট হিসাবে শেয়ার করলাম, পাঠকরা গল্পের চাখনা হিসাবে উপভোগ করতে পারবেন।

তাই বলাই বাহুল্য, গ্রুপে কাজের থেকে অকাজই বেশী হতে শুরু করল; শুধু ক’য়েকটা কাজের কথা জানা গেল, যেগুলো যাঁরা ভুটান অভিমুখে যাত্রা করেছেন কখনো, তাঁরা ভালোই জানেন। প্রথমত, আমরা যাচ্ছি ভরা বরষায়, অফ সিজনে; তাই টাকা-পয়সা বাঁচানোর জন্য আগে থেকে হোটেল বুক না করলেও, সমস্যা কিছু হবে না; দ্বিতীয়ত, ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট ভুটানে চলে না তাই ১০, ৫০, ১০০ ইত্যাদি নোটই সঙ্গে নিতে হবে। এবং এটাও জানা গেল, ভুটানে যেতে তো ‘ভিসা’ লাগে না; ‘পারমিট’ লাগে। সে পারমিট আগে কলকাতা থেকে করা গেলেও এখন ‘অন অ্যারাইভ্যাল’-এর ওপরই নির্ভর করতে হবে।
ওদিকে সেমিস্টারও গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এল। থিওরি আর প্রজেক্টের মাঝের ব্যবধান ছিল দিন সাতেকের; আর তার মধ্যে প্রেসেন্টেশন স্লাইডস তৈরী করা, একটু মহলাও দেওয়া। যাতে প্যানেলের সামনে তোতলাতে না হয়… এসব করতে করতে প্রজেক্টের দিন এসে গেল। মানে মানে এটাও কেটে গেলে হয়।
তা কেটেও গেল। খুব একটা ল্যাজে-গোবরে না হয়ে এম এস সি ডিগ্রিটা পাওয়ার পথ সুগম করে ফেললাম বলেই মনে হল। এবার আমার আর ভুটানের মাঝে দাঁড়িয়ে মূলত বাবা, এবং মা। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরের দিন, বাবার কাছে গেলাম অনুমতি নিতে। আকাশে তখন মেঘের ঘনঘটা (সত্যি করেই)।
-“বুয়া… বলছি আফরোজদের সাথে ভূটান যাব ২২ তারিখ…”
আমাদের ‘পরমা প্রকৃতি’ মাঝে মাঝে বাংলা মেগা সিরিয়ালের থেকেও ভালো ‘ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক’ দিয়ে থাকেন। আমার গোটা বাক্যটা শেষ হয়েছে কি হয়নি, কড় কড় কড়াৎ করে একটা বাজ পড়ল কালো আকাশ চীরে। বাবা আমার মুখের দিকে তাকালেন…
-“না… এই বৃষ্টি-বাদলার বাজারে, কেউ যায় নাকি পাহাড়ে?”
বাবার কথার সমর্থন করতেই বোধহয় বাইরে বৃষ্টিটা শুরু হল।
-“যখন সেকেন্ড সেমিস্টারের পর; কাঠগোদাম বাগ-এ আপ ডাউন কনফার্মড টিকিটগুলো ক্যানসেল করালে, তখনও একই যুক্তি দিয়েছিলে। আমাদের ইভেন সেম শেষই হয় বর্ষাকালে, তো কি করব?”
-“বৃষ্টিটা বড় কারণ ছিল না, তখন রেজাল্টের যা অবস্থা ছিল, সেটা নিয়ে আমার যথেষ্ট দুশ্চিন্তা ছিল।”
এখানে বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, আমার ডিপার্টমেন্টের জনৈক ব্যক্তিত্বের হস্তক্ষেপের ফলে, ফার্স্ট সেমিস্টারে আমার ২ নম্বরের জন্য ফার্স্ট ক্লাস হাতছাড়া হয়, তাই সেকেন্ড সেমিস্টার হয়ে যাওয়ার পর, বাবা কিছুতেই উত্তরাখন্ড বেড়াতে যেতে রাজি হননি। আপনারা ভাবতেই পারেন এটা নির্জলা ঢপ; পড়াশোনা না করে এখন দোষ দিচ্ছি ডিপার্টমেন্টের কোনও এক সজ্জন ভদ্রমহিলাকে, কিন্তু আমার ডিপার্টমেন্টে সেইসময় বিশেষ একজনের ‘নেপোটিজমের’ ‘নেপো’ আপনি না হতে পারলে, আপনার পাতের দই অন্য নেপোয় স্বচ্ছন্দে মেরে দিত, এবং এক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল।
যাই হোক… বাবার সাথে বেশ কিছুক্ষণ বাকবিতন্ডা হল; বাবা যেতে দেবেন না, আমিও না গিয়ে ছাড়ব না… শেষে মাথাটা আমারই আগে গরম হল, হুমকি দিয়ে এলাম,
-“আমি যাবোই… যা করবে করে নাও… পয়সা না দিলে জোগাড় করে নেব…”
এখন জোগাড় করব মানে, বাবা না দিলে কাকা… না হলে তখন তো আবার দিদিও সদ্য মার্কিন মুলুক থেকে কলকাতা ফিরেছে। কিন্তু এই যে বর্ষাকাল, এই যে মৌসুমী বায়ু; মানে মোটের ওপর যার ওপর আমার গোটা এম এস সি ডিগ্রিটা দাঁড়িয়ে আছে, সে যে এরকম ঘরের শত্রু বিভীষণ হয়ে দাঁড়াবে; তা কল্পনাও করতে পারিনি। দু-তিন দিন ধরে এমন বৃষ্টি হল, যে বাবা তার মত পরিবর্তন তো করলেন না বটেই, উল্টে মা, কাকা, দিদি সবাই আমাকে বোঝাতে শুরু করল যে এভাবে নিজের কবর নিজে খুঁড়ে তার ওপর গ্যাংনাম স্টাইলে নাচাটা নির্বুদ্ধিতা। কিন্তু আমিও বাপের ব্যাটা… আমিও নিজের জেদ ধরে বসে রইলাম।

আফরোজ যদিও প্রথমেই বলেছিল,
-“তোর বাবা তো? প্রথম থেকে না না করে শেষে মত দিয়েই দেবে…”
আর হলও তাই। শেষে বাবা গম্ভীর মুখে একটা ১০০ টাকার বান্ডিল হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
-“যাচ্ছ যাও… সেই বি এস সি-এর প্রথম দিনের মত অবস্থা হবে আবার, এই বলে দিলাম…”
এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে বি এস সি-এর ওরিয়েন্টেশানের দিন প্রথম একা বাসে চড়ার আনন্দে কায়দা করে চলন্ত বাস থেকে নামতে গিয়ে কিঞ্চিৎ আহত হতে হয়েছিল আমায়; আর সেই থেকে বাবা আমাকে আমার ‘জীবনের ভুলভাল সিদ্ধান্ত নিয়ে খোঁটা দেওয়ার সময় বার বার ওই উদাহরনটাই ব্যবহার করে থাকে।
সে যা হোক গে; তখন আমিই কে, আর দেবদাস-ই বা কে… ভুটান যাব, ট্রেক করব, ল্যান্ডস্লাইড হবে, মরে যাব… সোজা হিসেবে। মরে গেলে তো আর মনের দুঃখ থাকবে না…
তখনো আমি ট্র্যাভেল প্ল্যান নিয়ে খুব একটা ওয়াকিবহাল নই, শুধু জানি একটা ট্রেক আছে। এখন আমি নিজেকে তখন মোটেও ট্রেকার বলে দাবী করতাম না, তবে আমি আর আফরোজ আগের বছর পূজোর সময় বক্সা দুয়ার ট্রেক করে এসেছিলাম, তাই ট্রেক সম্পর্কে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধারণা আমাদের দু’জনের আছে। তাই আমরা একটার বেশী ব্যাগ নেব না, শুধু একটা রুকস্যাক; এই নীতি মেনেই তৈরী হচ্ছিলাম।
খালি প্রয়োজন ছিল একটা জুতোর; কারণ আমার দু’বছর পুরোনো ট্রেকিং শু আমায় বক্সা দু’য়ারে বেশ মুশকিলের মধ্যে ফেলেছিল। তাই একখানা জুতো কিনতে হল, এবং সেটা ক’দিন পড়ে হাঁটাহাঁটি করে, পা টা সইয়েও নিতে হল। কারণ আনকোরা নতুন জুতো পড়ে ট্রেকিং? নৈব নৈব চ।
ভূটানের ছবি ? আরে মশাই, ভূটান পৌছোতে তো দিন আগে… আসলে আগে-পিছে মিলিয়ে আমার ভূটান সফর এতোটাই ঘটনাবহুল ছিল, যে কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখবে ভেবে পাচ্ছি না… কিন্ত, কথার মেওয়া যে সবুরেই ফলবে, এ নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই…
শান্তির আশায়,
নীল…