সোমনাথ শুয়ে ছিল চিৎ হয়ে। মাথার ওপর পাখাটা ঘুরছে বন বন করে। সোমনাথের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমাট বেঁধে বড় বড় ঘামের ফোঁটা তৈরী করতে শুরু করেছে। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছে সোমনাথ পাশ ফিরে শোয়। আর পাশ ফিরেই মেঘার মুখটা দেখতে পায়। চোখ বন্ধ, দুটো হাত জোড় করে বালিশ আর গালের মাঝখানে রাখা; পরম শান্তিতে ঘুমোচ্ছে মেঘা। কালকের উদ্বৃত্ত কাজল এখনো চোখের কোলে রয়ে গেছে, খোলা কালো চুলগুলো গাল বেয়ে পড়েছে যেটা একটা চোখের সামনে ধোঁয়াটে একটা পর্দার সৃষ্টি করেছে।
প্রতিটা দিন সোমনাথের আতঙ্কে, আশঙ্কায় কাটে। আর আজ সেই আশঙ্কা বোধহয় সত্যি হতে চলেছে। নতুন গভর্নমেন্ট আসার পর থেকে এবং প্রথাগত ভাবে আদমশুমারী শুরু হওয়ার পর থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষণিকের জন্য অনেক ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা ক্ষণিকের জন্য উদয় হয়েই আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। জনগননার নামে নাকি মরাল পুলিসিং জাতীয় কিছু হচ্ছে; যেটা একেবারেই সংবিধান বিরোধী; কিন্তু কোনও লেখা বা রিপোর্টই ১০ মিনিটের বেশী থাকছে না সোশ্যাল মিডিয়ায়। সাইবার ক্রাইম জনিত আইন কানুন অনেক স্ট্রীক্ট হয়েছে আজকাল। বাড়িতে বাড়িতে এসে এই জনগননার কাজ চলছে। তাই রোজ সকালে ঘুম ভেঙে গেলে, মেঘাকে চোখ ভরে দেখে সোমনাথ। ঘুমোলেও অপূর্ব লাগে মেঘাকে। এখন চোখদু’টো বন্ধ তাই… খোলা থাকলে বিয়ে করা বউয়ের চোখের দিকে চাইতেও কেমন লজ্জা লজ্জা করে সোমনাথের। সারাজীবনে, ওই চোখদুটোর চেয়ে সুন্দর কিছু আর দেখেনি সোমনাথ, কোনোদিনও না। এই চোখদু’টোকে জীবনের শেষদিন পর্য্যন্ত অন্তত একবার করে দেখতে চায় সে, প্রতিদিন…

আজ তাদের পালা, জনগননার লোক আসবে তাদের বাড়িতে। অফিস থেকে তাই ছুটি নিতে হয়েছে দু’জনকেই, বাড়িতে আসা চিঠিতে সেরকমই লেখা ছিল। দু’জনকে একসাথে বাড়িতে না পেলে কিছু আর্থিক জরিমানা দিতে হবে সরকারের অমূল্য সময় নষ্ট করার জন্য।
-“কিছু হবে না তো?” সোমনাথ মুখ ফুটে বলেই ফেলে প্রাতরাশের টেবলে…
-“কি আবার হবে? এত ঘাবড়াচ্ছো কেন বলতো? উই আর বোথ আপস্ট্যান্ডিং সিটিজেনস; ট্যাক্স ফাঁকি দিই না, ব্ল্যাক মানি নেই, কোনো ক্রিমিন্যাল রেকর্ডও নেই… ঘাবড়িও না… অনেক বয়েস হল… এবার একটু স্মার্ট হও দেখি… অমন কথায় কথায় ভয় পাওয়া আমার মোটে ভালো লাগে না…”
সোমনাথ হেসে ফেলে; কোনও উত্তর দেয় না এই কথার। দু’জনে স্নান সেরে, ঘরদোর গুছিয়ে তৈরী হয়ে থাকে।
বেলা এগারোটা নাগাদ তাঁরা এলেন। দরজাটা খুলে একটু অবাকই হল সোমনাথ। দু’জন সাধারণ পোষাকের সাথে চারজন পুলিস অফিসার; দু’জন পুরুষ, দু’জন মহিলা।
তারা ভেতরে ঢুকতে, মেঘার কপালেও ভাঁজ পড়ল।
-“নাম বলুন আপনার…”
-“সোমনাথ সেন…”
-“মেঘা সেন…”
-“দু’জনের সি আই সি কার্ড দেখি…”
সোমনাথ দু’জনের সি অ্যাই সি অর্থাৎ সিটিজেন আইডেন্টিফিকেশন কার্ড দু’টো এগিয়ে দেয়।
-“আপনার নাম তো মেঘা মুখার্জি লেখা আছে…”
-“হ্যাঁ, আমার কার্ডে নামটা বদলানো হয়নি; ম্যারেজ সার্টি…”
-“মানে মেঘা মুখার্জি আপনার মেইডেন নেম? আপনি ব্রাহ্মণ?”
মেঘা বেশ বিরক্ত হয়ে উত্তর দেয়,
-“হাউ ইস দ্যাট রেলিভেন্ট? আমি কি কাস্ট সেটা…”
-“রেলিভেন্ট ম্যাডাম, রেলিভেন্ট… ইন্ডিয়ান সেন্সাস অ্যাক্ট, ২০২২ অনুযায়ী, সমস্ত ইন্টারকাস্ট ম্যারেজ নাল অ্যান্ড ভয়েড এবং পানিশেবল অফেন্স…”
-“হোয়াট ননসেন্স… এরকম অ্যাক্ট কবে চালু হল?”
-“এরকম অ্যাক্ট যদি ঢাকঢোল পিটিয়ে চালু হত, তাহলে কি দেশে আইন-শৃঙ্খলা কিছু টিকত? যাক গে, আপাতত আপনাদের ডিটেনশন সেন্টারে যেতে হবে…”
মাথায় বাজ পড়লেও বোধহয় এতটা ভয় পেত না সোমনাথ; সে উঠে মেঘার দিকে এগোতে যেতেই দু’জন পুলিস তাকে চেপে ধরে হাতকড়া পড়ায়, আর বাকী দু’জন মহিলা পুলিস চেপে ধরে মেঘাকে। সে চিৎকার করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল; কিন্তু তার আগেই তাকে হিড়হিড় করে টেনে ঘরের বাইরে নিয়ে যায়। সোমনাথ দু-একবার মেঘার নাম ধরে চিৎকার করে ডাকে, কিন্তু দরজার অপরপ্রান্ত থেকে একটা অস্পষ্ট গোঙানি ছাড়া আর কিছু শুনতে পায় না।
-“এটা বেআইনি… এটা পুরোপুরি বেআইনি…” -চিৎকার করে ওঠে সোমনাথ।
-“হুঃ… বদ্যি হয়ে বামুনের মেয়েকে বিয়ে করে, দেশের সংস্কৃতির ১০৮ করে আবার আমাকে আইন শেখাচ্ছে…”
-“আমাকে আমার ল-ইয়ারকে ফোন করতে দিন… এক্ষুণি…”
-“ও হ্যাঁ… বলে হয়নি, ইন্ডিয়ান সেন্সাস অ্যাক্ট ভায়োলেটাররা ডিটেনি, কনভিক্ট নয়, তাদের উকিল পাওয়ার কোনো অধিকার নেই, অন্তত এখুনি তো নয়ই…”
-“দিস ইজ জাস্ট রিডীকুলাস… কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমার স্ত্রী কে…”
-“বললাম না, আপার কাস্ট ডিটেনশন সেন্টারে… তুমি যাবে লোয়ার কাস্টে…”
সোমনাথ কিছু বলার আগেই তার মাথার ওপর নেমে আসে একটা কালো ব্যাগ, আর তার মাথার পেছনে জোরে একটা আঘাত হয়।
আর সোমনাথ আবার ধড়মড় করে উঠে বসে দেখে, ডক্টর সামন্ত তার সামনে গম্ভীর মুখে বসে আছেন, চুপ করে…
না, আজ আর কিছু বলব না… লেখকদের মাঝে মধ্যে দোষারোপ করা হয় তাঁরা কল্পনার খাসমহলে বিরাজ করেন; এবং কল্পনার লাগাম ছেড়ে দিয়ে এদিক ওদিক ছেড়ে দিয়ে মজা দেখেন। এই পর্বটা ধরে নিন কল্পনার সাথে দুশ্চিন্তা মিশে একটা জগাখিচুড়ি তৈরী করেছে… ওই আর কি…
শান্তির আশায়…
নীল…
সোমনাথ কে ভাবতে বলুন চিন ভূমিকম্পে ধংস হয়ে গেছে আর ভারত করোনা মুক্ত হয়ে গেছে ।
আজকের পর্বটি সম্পূর্ণ ভাবনার বাইরে, তবে বাংলায় সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে এরকম সায়েন্স ফিকশন প্রথম পড়লাম। শেষ পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
LikeLiked by 1 person
অনেক ধন্যবাদ…
LikeLike