তরঙ্গ – সপ্তম পর্ব

-“চা খাও… ভালো লাগবে… মনের ওপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে…”

সোমনাথ উঠে টানা পাঁচ মিনিট কোনও কথা বলেনি।

এবার সে মুখ খুলল…

-“আমার এরকম লাগছে কেন… মনে হচ্ছে…”

-“মনে হচ্ছে দু’টো জীবন একসাথে বেঁচে আছ, তাই না?”

সোমনাথ মাথা নাড়ে।

-“যখন কেউ অতীতে যায়, তখন সে রাস্তাটা একটাই। কারণ, তার বর্তমানের সাপেক্ষে তার অতীত আগেই ‘ঘটে গেছে’। কিন্তু নিজের বর্তমানের সাপেক্ষে ভবিষ্যতে যাওয়ার ফল মারাত্মক। অনেকটা লুডোর ছক্কা চালার মতো। মানুষের বর্তমানের সিদ্ধান্ত বা চয়েসের ওপরই নির্ভর করে তার ভবিষ্যত। আমাদের অনেকগুলো ‘বাস্তবতা’ মানে রিয়ালিটি আছে; এবং এরা একে অপরের সাথে সমান্তরাল, তাই ‘প্যারালাল রিয়ালিটি’ কথাটা চালু আছে। আর অসংখ্য প্যারালাল রিয়ালিটি মিলিয়েই তৈরী হয় ‘ফ্যাব্রিক অফ রিয়ালিটি’।

জ্যানিস-এর সন্ত্রাসবাদীরা ২০২০ থেকে তাদের অতীতে, ১৯৮০ তে ফিরেছিল, আর আবার তাদের বর্তমানে, অর্থাৎ ২০২০ তে ফিরেছে; কোনও সমস্যাই নেই… কিন্তু তাদের সাথে তুমি, চলে এসেছ তোমার ভবিষ্যতে। আর ছক্কা চালার ফলাফলের মতই, তুমি তৈরী করেছ একটা নতুন রিয়ালিটি, যাতে তোমার জীবন পারফেক্ট; চাকরী, বউ… সব ছবির মতো…”

-“তাহলে এই প্যারালাল রিয়ালিটিতে…” সোমনাথের এই কথাটা শেষ করতে না দিয়েই ডক্টর সামন্ত বলে ওঠেন;

-“প্যারালাল নয়, সোমনাথ… ওটাই তো সমস্যা। তোমার জন্ম ১৯৫৩, কিন্তু এই রিয়ালিটিতে তুমি নিজের জন্মকে এগিয়ে এনেছ ৪০ বছর! তোমার অতীতের ঘটনা, তোমার জীবনের বেশিরভাগ অংশই তোমার আসল বাস্তবতার অংশ, তাই তোমার এই নতুন রিয়ালিটি আর সমান্তরাল নেই, একদমই না… অন্যান্য রিয়ালিটির সাপেক্ষে তোমার এই রিয়ালিটি এখন… এককথায় বললে ট্যানজেন্সিয়াল…”

-“তাতে সমস্যা কি?”

-“সমস্যা কি ? ফ্যাব্রিক অফ রিয়ালিটি, সৃষ্টির জন্মলগ্ন থেকে আছে, সেটার তৈরী হওয়ার একটাই নিয়ম; বাস্তবতাগুলো একে অপরের সাথে সমান্তরাল। এখন তোমার এই একটি অসমান্তরাল রিয়ালিটির জন্য, সময়ের যে রিপল বা তরঙ্গ তৈরী হয়েছে, সেটার ধাক্কায় গোটা ফ্যাব্রিকটাই ধ্বংস হতে চলেছে।”

-“মানে… এই রিয়ালিটি… এর জন্য…”

-“গোটা ব্রম্ভান্ড, ধ্বংস হতে চলেছে…”

-“কিন্তু কেন? আ-আমি কি করে সৃষ্টি করব…”

-“হিউম্যান মাইন্ড, সোমনাথ… ইউম্যান মাইন্ড… প্রথমেই বললাম না মানুষের মনের ক্ষমতার কথা কেউ ভাবে না, কেউ আন্দাজও করতে পারে না… তোমার অবচেতনের বাসনা, তোমার না পাওয়ার কষ্ট, সেটাই এই রিয়ালিটিকে তার চেহারা দিয়েছে…”

সোমনাথ চুপ…

-“রাস্তায় তোমার যে জায়গাগুলো দেখে ফাঁকা মনে হচ্ছে, সে জায়গাগুলোতে একটা একটা আস্ত মেট্রো স্টেশন ছিল। তোমার আসল রিয়ালিটিতে তুমি কলেজ থেকেই চেইন স্মোকার; তোমার বাড়ির কাছে যে মাঠটা দেখে তোমার আউট অফ প্লেস মনে হয়, সেখানেই ছিল তোমার মেসবাড়ি… আর তোমার তৈরী এই রিয়ালিটিতে কোনোদিন মেট্রোর কাজ শুরুই হয়নি তাই তুমি রেলে কাজ করো… তোমার প্রেম, তোমার স্ত্রী মেঘা যার সাথে তোমার কলেজে দেখা হয়েছে, তার অস্তিত্ব শুধুমাত্র এই বাস্তবতাতেই…”

এবার সোমনাথ মুখ খোলে…

-“আমি বিশ্বাস করি না… আপনি আমাকে ভুল বোঝাচ্ছেন সব…”

-“আমি ভুল বোঝাচ্ছি না, তুমি নিজেই নিজেকে একটা অলীক কল্পনার দাস করে সত্যটাকে গোপন করে রাখতে চাইছ; তুমি নিজেও জানো আমার কথাগুলো ১০০% সত্যি।”

Photo by Oladimeji Ajegbile on Pexels.com

সোমনাথ মাথা নাড়তে থাকে, জোরে জোরে, ডক্টর সামন্ত এগিয়ে এসে তার দু’কাঁধ চেপে ধরেন…

-“সোমনাথ, গোটা সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাবে, তুমি ফিরে না গেলে… হাতে সময় নেই… তোমার এই বাস্তবতা ক্রমে ক্রমে গ্রাস করছে তোমার আসল বাস্তবতা কে। একবার, যদি একবার তুমি ভুলে যায় কি ছিল তোমার জীবন, আমি হাজার চেষ্টা করলেও তোমাকে ফেরত পাঠাতে পারব না; আর এই রিয়ালিটির ‘ব্রাঞ্চিং’ টাও বন্ধ হবে না, সময়ের ওই তরঙ্গকেও রোখা যাবে না, আর বছর পাঁচেকের মধ্যেই সব শেষ, সব শেষ, সবাই শেষ…”

সোমনাথ জীবনে প্রথমবার চিৎকার করে ওঠে বিশাল জোরে…

-“যাক না!!! যাক!!! আমি কোনও সুপারহিরো নই যে গোটা পৃথিবীকে রক্ষা করার ঠেকা আমি নিয়েছি… গোটা জীবন একা কাটিয়েছি, একা… আর সেদিন ওই ঘটনা না ঘটলে মেঘাকে পেতাম না কোনোদিন, কোনোদিন ভালোবাসার কাউকে পেতাম না… একা জীবন কাটিয়ে একাই মরে যেতাম… চাই না আমি সে জীবন… চাই না…”

ডক্টর সামন্ত কোনও উত্তর দেন না… সোমনাথ কেঁদে ফেলে,

-“পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে? যাক… যাক… আমি আর মেঘাও তো মারা যাব, ধ্বংস হয়ে যাব… কিন্তু একা আবার ওই জীবনে ফিরে গিয়ে বাঁচতে চাই না আমি।”

ডক্টর সামন্ত আবার মুখ খোলেন,

-“তাহলে তুমি মেঘার সাথে বাঁচতে চাও; এই পাঁচ বছর, তাই তো? সব শেষ হয়ে যাওয়ার আগে অবধি?

-“হ্যাঁ…”

ডক্টর সামন্ত মৃদু হেসে গুন গুন করে গান গেয়ে উঠলেন…

-“শুধু একদিন ভালোবাসা, মৃত্যু যে তারপর, তাই যদি হয়… আমি তাই চাই… চাইনা বাঁচতে আমি প্রেমহীন হাজার বছর…”

সোমনাথ কোনও উত্তর দেয় না, সে কেঁদে চলেছ… তার ইচ্ছে করছে এক্ষুণি ছুটে মেঘার কাছে গিয়ে তার বুকে মাথা লুকোতে।

-“রিয়ালিটি, জিনিসটা বড্ড অঙ্কের হিসেব মেনে চলে, জানো সোমনাথ… তাই একে একে দুই-ই হয়, তিন হয়না কখনো। হিসেব সে মিলিয়েই ছাড়ে… দেখবে, তোমার ভবিষ্যত? না না… ভবিষ্যতে যেতে হবে না… ছক্কা চালার সুযোগ তোমায় দিচ্ছি না তোমাকে। দেখবে, যেভাবে চলছে, যদি সেইভাবেই চলে সব, তাহলে কি আসতে চলেছে তোমাদের ভবিষ্যতে ?”

সোমনাথ মুখ তুলে তাকায়…

-“দেখবে? আজ থেকে দু’বছর পর, কি ঘটতে চলেছে তোমাদের জীবনে? হিসেব মেলানোর খেলা?”

-“হ্যাঁ…”

-“বেশ, এসো তাহলে…”

আবার সোমনাথের কপালে ইলেক্ট্রোডগুলো লাগিয়ে যন্ত্রের বোতাম টিপে দেন অজিতেশ…”

ভবিষ্যতের হিসেব মেলানোর খেলা দেখা যাবে পরের পর্বে; আর ঠিক তিন পর্বে সমাপ্ত হবে “তরঙ্গ” তার আগে এবং পড়ে গল্প নিয়ে কোনও প্রশ্ন থাকলে, জানান আমায়… চেষ্টা করব, উত্তর দেওয়ার…

Leave a comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.