Pain… You made me a you made me a believer, believer…
“Believer” – Imagine Dragons
||১৮||
অনেকের প্রেমে পড়ে রাতের ঘুম উড়ে যায়, অনেকের প্রেম ভেঙে গেলে রাতে ঘুম আসেনা। আবার প্রচুর লোকে ভূতের ভয়েও রাতে জেগে বসে থাকে। কিন্তু অভিযোজন এবং মানুষের মস্তিষ্কের কিছু সহজাত তথ্য শরীরকে বোঝাতে সক্ষম হয় বিশ্রাম এবং ঘুমের প্রয়োজনীয়তা। তাই সারারাত যুদ্ধ করে শত্রুশিবিরের একেবারে নাগালের মধ্যে ঘাঁটি গাড়া সৈনিকদেরও ঘুম আসে, ফাঁসীর আগের রাতেও শান্তিতে ঘুমায় কয়েদি।
আর তাই ঐ বিভীষিকাময় রাতের পরেও, ওদের চোখে ঘুম আসে। দিনের আলোটা ভালো করে ফুটলে ওরা ঘুমোতে যায়, দরজা হাট করে খুলে। স্যার একবার এসে ঘুরে গেলেও ঘুম ভাঙ্গান না ওদের ঘুমের বহর দেখে।
যখন ঘুম ভাঙে তখন চারদিকে রোদ খাঁ খাঁ করছে। বেলা প্রায় সাড়ে এগারোটা। স্যার মৃদু তিরস্কার করেন ওদের, রাত জাগার জন্য। তার উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে সবাই। প্রাতরাশ করার সময় প্রথম মুখ খোলে মৈনাক।
-“তোদের সাথে কিছু কথা আছে। খাওয়ার পর চ’ একবার খড়িয়া-এর ধারে যাই।”
এ কথার উত্তর কেউ দেয় না। খাওয়া হয়ে গেলে, স্যারের অনুমতি নিয়ে পাঁচজনেই নদীর ধারে যায়। আকমল সঙ্গ ছাড়ে না। নদীর ধারে বসে মৈনাক বলতে শুরু করে…
-“আমি একটা জিনিস লুকিয়ে গেছি তোদের থেকে…”
-“সেটা আমি আন্দাজ করেছি… হঠাৎ তোর মেল করার কি দরকার পড়ল, বুঝিনি…” উত্তর দেয় অসীমাভ।
-“হুঁ… আসলে তোদের এতদিন বলব বলব করেও বলিনি কারণ, পুরোটাই আমার অনুমান, তার সাথে লোকের মুখের কথা আর লোকাল লেজেন্ড জুড়ে… কিছুটা কানেক্টিং দ্য ডটস, কিছুটা অন্ধকারে ঢিল…”
-“অনেক গৌরচন্দ্রিকা হল, এবার ভেতরে ঢুকবি কি ?”
মৈনাক কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে, তারপর একটা গলা খাঁকড়ি দিয়ে শুরু করে;
-“আমার মাথায় প্রথম খটকাটা লাগে তারাদার কথায়। মনে আছে, সাখাম যাওয়ার দিন তারাদা বলেছিল জঙ্গলের প্রাণ আছে, একটা নিজস্ব সত্ত্বা আছে ?”
-“হ্যাঁ… মনে আছে…”
-“তারপর তুই রতনকে জেরা করলি। রতন বলল রাতে ভয় পেলে গরাম ঠাকুরের নাম করে। তোরা সেটা নিয়ে বিশেষ কিছুই ভাবিস নি, কারণ এইসব ট্রাইবাল এলাকায় প্রচুর পেগান গড-এর পূজো হয়ে থাকে। কিন্তু আমি ভাবলাম রতন কে একটু জিজ্ঞাসা করি। করলামও পরের দিন। রতন শুধু বলল, গরাম ঠাকুর ওঁরাও-দের ভগবান, ওঁরাও বস্তির কাছে একটা মন্দির গোছের জিনিস আছে। সে গরাম ঠাকুর নিয়ে আর বিশেষ কিছু বলতে পারল না। তবে বলল, ‘খগেনদাদু জানে’।”
-“খগেন দাদু মানে? সেই খগেন, যে মাঝে মধ্যেই দুমদাম কোর এরিয়ায় ঢুকে যায় ?” -প্রশ্ন করে শ্বেতাংশু।
-“কারেক্ট। জীবিত ওঁরাওদের মধ্যে প্রবীনতম খগেন ওঁরাও, বয়সের গাছ পাথর নেই, পরে দিলীপ বাবুর কাছ থেকে জেনেছিলাম নাকি একশ’রও ওপরে বয়স। গরাম ঠাকুরের ব্যাপারে তার থেকে ভালো কেউ জানবে না। কারণ ওঁরাও রা এখানে এসেছে মূলত ব্রিটীশ আমলে, ছোটনাগপুরের নানান এলাকা থেকে, তাই তারা নিজেরাও তাদের শুরুর ইতিহাসটা ঠিক করে জানে না, দু-একজন ছাড়া। এখন সমস্যা হল ভাষা। খগেন পাক্কা ওঁরাও, বাংলা একটু একটু বুঝলেও, বলতে পারে না। তার ভাষা হল কুরুখ আর এন্দেরমেন্দের।”
-“অ্যাঁ ! এসব কি ভাষা ?”
-“কুরুখ এসেছে দ্রাবিড় স্ক্রীপ্ট থেকে, কিন্তু এন্দেরমেন্দের ? একেবারেই লোকাল ল্যাঙ্গুয়েজ, লোকাল ডায়ালেক্ট। ফরচুনেটলি ফর মি, ওঁরাও আর মুন্ডাদের সাথে বড় হওয়া রতন, দু’টো ভাষাই বলতে এবং বুঝতে পারে। আমি গেলাম বীট অফিস যাওয়ার নাম করে ওঁরাও বস্তিতে। খগেনবুড়ো মিশুকে লোক, হাসিমুখে কথা বলল, আমিই তাকে গরাম ঠাকুরের কথা জিজ্ঞাসা করলাম। সেটা শুনে সে একটু গম্ভীর হয়ে গেল ঠিকই, কিন্তু উত্তর সবই দিল।”
-“কি বলল…”
-“আমরা যারা আজ গাছ লাগাও, গাছ বাঁচাও বলে চিৎকার করি, তাদের পক্ষে বোঝা সম্ভবও নয়, জঙ্গলের মধ্যে বেড়ে ওঠা এইসব উপজাতিগুলোর সাথে অরণ্যের সম্পর্কটা কতটা সিমবায়োটিক। অরণ্যকে কতটা শ্রদ্ধা করে তারা। তারা জঙ্গল থেকে যেমন ন্যাচারাল রিসোর্সেস পায় যেমন কাঠ, মহুয়া, গালা, রজন… তেমনই যত্ন করে জঙ্গলের প্রতিপালনও করে থাকে; আর গরাম ঠাকুর হল এই অরণ্যের দেবতা। ‘স্পিরিট অফ দ্য উইল্ডারনেস’ বা ‘গড অফ দ্য ফরেস্ট’… যা ইচ্ছে নাম দিতে পারিস। ইন ফ্যাক্ট শুধু গরাম ঠাকুর কেন, দেশে দেশে, বিভিন্ন কালচারে এরকম অনেক দেবতার, অনেক ডেইটির উল্লেখ রয়েছে। যেমন সুন্দরবনের দক্ষিণরায় বা বনবিবি। আবার ডুয়ার্সের অন্য অঞ্চলে ধর্মেশ বা ধর্ম ঠাকুর। এমনকি নর্স মাইথোলজিতে ‘ভিডার’।”
-“বলিস কি ? তোকে খগেনবুড়ো নর্স মাইথোলজির গল্প শোনালো ?”
-“এত ভাট বকে কি পাস, শ্বেতাংশু ? আমি ফেরার পথে বীট অফিস গিয়েছিলাম, খগেনদাদুর মুখের কথাগুলো অনেকটাই ইন্তারনেট থেকে ভেরিফাই করেছি।
-“দোষ হয়ে গেছে… তুই তারপর বল। -শ্বেতাংশু বলে।
-“তা এই গরাম ঠাকুর হলেন কাঁচাখেকো দেবতা, ওঁরাওরা এখনো ১২ বছরে একটা করে নরবলি দেয় তার কাছে। আর আমি দিলীপবাবুর অফিসে ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখেছি, এখানে শেষ নরবলি হয়েছে ২০০১ সালে…”
-“মাই গড !!!”
-“তোর না, ওঁরাও-দের গড… ”
-“ওই হল… কন্টিনিউ…”
-“হ্যাঁ…
-“তা গরাম ঠাকুর তাঁর জঙ্গলে কোনও অনাচার সহ্য করতে পারেন না। যতদিন কাঠকল ছিল, এবং কাঠকলের মালিক সর্বেশ্বরবাবু প্রতি সপ্তাহে গরাম ঠাকুরের পূজো দিতেন, ততদিন কোনও অশান্তি ছিল না… অশান্তি শুরু হল রতনের দাদা মারা যাওয়ার পর থেকে। লোকজন পলিটিক্স আর ইউনিয়নবাজী করে স-মিল লাটে তুলে দিল, ভদ্রলোক বাধ্য হয়ে সব বেচে বুচে… তার পরের ঘটনা তোরা জানিস… তার পর থেকে, মানে ওঁরাওদের বিশ্বাস গরাম ঠাকুরের রোষে, ওই জমিতে আর কেউই টিকতে পারেনি। পাঁচজন গ্যাংরেপ কেসটার সাথে জড়িত ছিল, সঞ্জয় লাহোটি আর চারজন লোকাল লোক। সঞ্জয় বড়লোকের কুপুত্তুর, সে পালিয়ে বেঁচেছে, কিন্তু বাকী চারজন জেলে ছিল, তাদের একজন জেলেই আত্মহত্যা করে; আর গত বছর ১৫ই আগস্ট ভালো ব্যবহারের জন্য ছাড়া পেয়েছিল বাকি তিনজন। ছাড়া পেয়ে বস্তিতে ফিরেছে, রাতে শুয়েছে, দরজা জানলা বন্ধ করে। সকালে দেখা গেছে, তিনজনে তিনটে আলাদা জায়গায় হার্ট ফেইল করে মরে কাঠ হয়ে পড়ে আছে। সেটাও নাকি গরাম ঠাকুরের রোষ; তার জঙ্গলের স্যাংটিটি নষ্ট করার শাস্তি। তাই লেপার্ডস নেস্ট-এ আমাদের অবাধ অনুপ্রেবেশও সহ্য হয়নি গরাম ঠাকুরের।”
-“মানে, ওই জিনিসটা… মানে যেটা কাল আমাদের ঘরে ঢুকেছিল… সেটা ওই গ-গরাম ঠাকুর ?” -অসীমাভর গলাটা কেঁপে ওঠে যেন…
-“গরাম ঠাকুর বল, স্পিরিট অফ উইল্ডারনেস বল, জঙ্গলের আত্মা বা সত্ত্বাও বলতে পারিস…”
-“কিন্তু এ ব্যাপারে তুই শিওর হচ্ছিস কি করে ?”
-“আরে ! আমি কখন বললাম আমি শিওর ? আমি তো প্রথমেই বলেছিলাম এটা আমার আন্দাজে ঢিল মারা; আর আমি অনেক আগে এও বলেছিলাম ভূতের পেছনে কি আর কেন জোড়াটা আমার ধাতে সয় না। এক্সপ্ল্যানেশন তো তুই চাইলি… এখন সেটা পাওয়ার পর শিওরিটির কথা তুলছিস… তবে… এর পেছনে আমার আর একটা যুক্তি অবশ্যই আছে।”
-“কি যুক্তি ?”
-“সব পেগান গডদের একটা করে প্রতিক বা টোটেম থাকে। জানিস, গরাম ঠাকুরের টোটেম কি ?”
-“কি ?”
-“কালো কুকুর…”
-“আচ্ছা, বোঝা গেল। কিন্তু, একটা জিনিস ক্লীয়ার কর, তুই ব্যাপারটার সূত্র তো প্রথম তারাদার কাছ থেকেই পেলি; তাহলে তুই গরাম ঠাকুর নিয়ে তারাদা কে প্রশ্ন না করে সিধে খগেনবুড়োর কাছে চলে গেলি কেন ?”
-“তিনটে কারণে। এক, রতনের সাথে কথা বলার পর তারাদার সাথে আমার দেখা হয়েছিল একদিন পড়ে, রাজাভাতখাওয়া যাওয়ার দিন; আর সত্যি করেই আমার তর সইছিল না ভাই… গরাম ঠাকুরের নাম শোনা ইস্তক আমার মনে হচ্ছিল এই ধাঁধার একটা বড় সূত্র হল গরাম ঠাকুর। আর দুই, যেখানে ওঁরাওরাই নিজেরাই নিজেদের ইতিহাস ঠিক করে বলতে পারে না, সেখানে তারাদা খুব একটা হেল্প করতে পারবে বলে আমার মনে হয়নি। আর তিন, নিজের চোখে একটা ১০০+ বছর বয়সী লোককে দেখার কৌতুহল দমন করতে পারিনি…”
-“একটু পায়ের ধুলো দে, ভাই। মাইরি বলছি, জিওলজি নয়, তোর অ্যান্থ্রোপলজী নিয়ে পড়া উচিত ছিল।”

এরপর নির্বীঘ্নেই কেটে গেছে একটা দিন। প্রথমে একটু ভয় ভয় করলেও, রাতে আলো নিভিয়েই শুতে পেরেছে সবাই। আজ সকাল থেকেই সাজো সাজো রব। কাল বিকেলের সরাইঘাট এক্সপ্রেস ধরে কোলকাতায় ফেরার পালা। এত দিনের পরিশ্রম, এত দিনের কষ্ট, এবং এত আতঙ্কের পরও, মনটা সবারই বেশ খারাপ। দিলীপবাবু সক্কাল সক্কাল হাফডজন বনমূর্গী পাঠিয়ে দিয়েছেন, আর জানিয়ে দিয়েছেন বিকেলে এসে মাংসটার তদারকি তিনি নিজেই করবেন। গোছগাছ করা, ছবি তোলা আর বাকী রিপোর্টটুকু লিখতেই দিনটা কাবার হয়ে যায়।
বিকেলে রতনের সাথে অসীমাভ আর মৈনাকও হাত লাগায়। এসে পড়েন দিলীপবাবু, তারা দা, এবং দুই জিপের ড্রাইভার। হৈচৈ, ক্যাম্পফায়ার করতে বেশ রাত হয়ে যায়। স্যার-দিলীপবাবু-তারাদা আগে খেয়ে নিলেও মৈনাকরা খায়নি। পরে পরে করতে করতে আবার শুরু হল বৃষ্টি। পরি কি মরি করে মাংস আর ভাতের থালা সমেত সব ঘরে ছুটল সব্বাই। খাওয়া দাওয়া করে দরজার বাইরে একগাদা মাংসের হাড় সহ থালাগুলো রেখে শ্বেতাংশু বিছানায় বসেছে কি বসেনি, দরজায় টোকা পড়ল।
-“আমি খুলছি না…” শ্বেতাংশু ঘোষণা করল।
আবার টোকা…
-“কে ?” -অসীমাভর প্রশ্নে কোনও উত্তর নেই।
মৈনাক বলে,
-“আরে ভাই, চল… একসাথে যাই…”
অনুপ্রিয়া বলে ওঠে
-“হোয়াই আর ইউ গাইজ বিয়িং উইয়ার্ড… আমি খুলছি…”
অনুপ্রিয়াকে কিছু বলার আগেই সে উঠে গিয়ে সটান দরজাটা খোলে এবং ‘ও মা গো’ বলে দু’পা পিছিয়ে আসে।
অসীমাভ আর মৈনাক প্রায় দৌড়ে যায়। গিয়ে দেখে দরজার বাইরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই কালো কুকুরটা, আর দু-এক মিনিট আগেই নামিয়া রাখা সবার এঁটো হাড়ের বিশাল স্তুপটা উধাও। কালো কুকুরটাকে দেখেই অসীমাভ দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। তারপর ঘরটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে দেখে। না, আলো নেভেনি, অস্বাভাবিক কিছুই হয়নি। একটা হাঁফ ছেড়ে, এবার সে অনুপ্রিয়ার দিকে তাকিয়ে খেঁকিয়ে ওঠে

-“এই যে, বাংলা মায়ের অ্যাংলো মেয়ে, একটা কুকুর দেখে ভয় পেয়ে মুখ দিয়ে বাংলাই বেরোলো তো ? যত্তসব।”
একটু পড়ে, মেয়েরা মেয়েদের ঘরে শুতে চলে যায়। মৈনাকরাও শুয়ে পড়ে, তবে শুয়ে পড়ার পর অসীমাভ দু-একবার টর্চ জ্বালিয়ে ঘরটা দেখে নিচ্ছিল। সেটা দেখে মৈনাক বলে,
-“চাপ নিস না… গরাম ঠাকুর গুডবাই বলতে এসেছিল…”
কথাটা শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে অসীমাভ। তারপর টর্চটা রেখে চোখ বুজে বিড়বিড় করতে থাকে
-“জয় বাবা গরাম ঠাকুর… শাপমুন্নি কোরো না বাবা, মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছি…”
ভারতীয় রেলের ঐতিহ্য মেনে সরাইঘাট এক্সপ্রেস মাত্র দু’ঘন্টা লেট করে চলছিল, তাই স্টেশনে বসে মাছি তাড়াচ্ছিল মৈনাক আর অসীমাভ। শ্বেতাংশুও কিছুক্ষণ মাছি তাড়াবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু একটা নাছোড়বান্দা মাছি বার বার ফিরে এসে তার নাকের ডগাতেই বসতে থাকার পর সে হাল ছেড়ে দিয়ে ব্যাজার মুখে গান ধরেছিল।
“জিন্দেগীনে, জীন্দেগীভর ‘গম’ দিয়ে…”
এমন সময় পিঠে রুকস্যাকধারী একটি ছেলে এসে শ্বেতাংশুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
-“আরে ! শ্বেত ! তুই এখানে ?? খবর কি ?”
শ্বেতাংশু লাফিয়ে উঠে ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরে, আর কুশল বিনিময় করার পর পরিচয় করিয়ে দেয়,
-“ভাই, এটা আমার ছোটবেলার, স্কুলের বন্ধু নীলাদ্রী…”
অসীমাভ আর মৈনাকও আলাপ করে। জানা যায় ছেলেটি এসেছিল মহাকাল গুহা ট্রেক করতে, কিন্তু বৃষ্টির জলের জন্য নিরাশ হয়েই ফিরতে হচ্ছে তাকে। কথায় কথায় জানা যায়, ছেলেটির সিটও শ্বেতাংশুদের কাছেরই ক্যুপে। ট্রেন আসতে বেশ দেরী আছে, তাই গল্পের আসর বসে যায় স্টেশনেই। কথায় কথায় শ্বেতাংশু বলে,
-“আমার কাছে একটা হেব্বি গল্প আছে ভাই… কলকাতায় চ’ বলব… ট্রেনে ঠিক জমবে না…”
দু’ঘন্টারও বেশ কিছুটা দেরী করে আসে ট্রেন। আর স্টেশন ছাড়তে ছাড়তে আবার সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসে। সবাই মিলে হৈহৈ করতে করতে যাওয়া হচ্ছে, মৈনাকের মন অনেকটাই ভালো এখন। যে মানসিক অবস্থা নিয়ে সে এসেছিল, সেই ভাঙাচোরা, দূর্বল মৈনাকটাকে সে বোধহয় উত্তরবঙ্গের জঙ্গলেই ফেলে রেখে এসেছে।
অন্ধকারের বুক চিরে এগিয়ে চলেছে ট্রেন… জালনার কাচে ভালো করে চোখ লাগিয়ে বাইরে দেখে মৈনাক… নাহ, জমাট বাঁধা অন্ধকার ছাড়া, আর কিছুই দেখতে পায় না সে…
তিন দিন পর…
-“কেমন কাটল তোর নর্থ বেঙ্গলের ক্যাম্প ?”
-“ভালো কাটল, বাপি… খুব ভালো…”
-“তোরা কোথায় ছিলি রে, ওখানে ?”
-“ওই তো, বক্সায়, সান্তালাবারির কাছে ‘লেপার্ডস নেস্ট’ বলে একটা রিসর্ট…”
-“ও বাবা, সেটা এখনো চলছে নাকি ? লেপার্ডস নেস্ট ?”
-“না, চলছে না, আসলে ফরেস্ট ডিপার্ট্মেন্ট-এর প্রপার্টি এখন…”
-“তাই বল… আমি তো শুনেছিলাম সেই ঝামেলার পর বন্ধ হয়ে গেছিল…”
-“কোন ঝামেলা ? আমি তো…”
-“ও, অবশ্য তোর তো তখন জ্ঞানই হয়নি। কত বয়স হবে ৩ কি ৪… আমি আর তোর মা একটা তোকে নিয়ে নর্থ বেঙ্গল গেছিলাম, আমার কোম্পানি থেকে প্রমোশনাল ইভেন্টে। দু’রাত ছিলাম ওই লেপার্ডস নেস্ট-এ। এলাহি ব্যবস্থা। কিন্তু দ্বিতীয়দিন রাতে নাকি, হোটেলের যে ওনার, সে দল পাকিয়ে দু’টি মেয়েকে… যাই হোক, পরের দিন দুপুরে চেক আউট করার কথা, পুলিস এসে আটকে দিল, জেরা করল, ট্রেন…”
বাবার এর পরের কথাগুলো আর একদমই কানে যায় না মৈনাকের। তার ফের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সে ‘কী’ ও ‘কেন’র উত্তরগুলো কেমন না চাইতেই পেয়ে যাচ্ছে; তাহলে নর্থ বেঙ্গলের ওই রহস্যের শেষ সূত্র কি সে নিজেই ? না চাইতেও ওই ভয়ঙ্কর অপরাধের সময় উপস্থিত থাকতে হয়েছিল লেপার্ডস নেস্ট-এ, তাই কি এত দুঃস্বপ্ন, তাই কি সে-ই প্রথম টের পায় অলৌকিকের অস্তিত্বের ? আর তাই কি গরাম ঠাকুর জলন্ত চোখে তাকে আড়াল থেকে লক্ষ্য করে গেছে, তাড়া করে বেরিয়েছে লেপার্ডস নেস্ট থেকে বক্সা ? এর উত্তর মৈনাকের কাছে অন্তত নেই, থাকলে আছে উত্তরবঙ্গের জঙ্গলের কোথাও একটা, যেখানে এখনো রাত হলে এক অলৌকিক শক্তি মানুষের কাছে তার অস্তিত্ব জানান দেয়; বুঝিয়ে দেয় এই জঙ্গলের অধিপতি সে, রক্ষাকর্তাও সে…
-সমাপ্ত-
আমাদের নর্থ বেঙ্গল সফর আপাতত শেষ। কাল এই লেখার পরিশিষ্ট লিখলেই ষোলকলা পূর্ণ হবে। এই পর্বের সাথে সাথে আমি সব পর্বের লিংক একসাথে নিয়ে আবার পোস্ট করছি; পড়ুন, পড়ে জানান কেমন লাগল… মোট ২৬,৭৩২ শব্দ এবং ৭৫ পাতার পর শেষ হয়েছে গল্প… কমেন্ট করুন, ফেসবুকে বলুন, হোয়াটস্যাপ-এ বলুন… সামনের শনিবার কি লিখব, সেটা জানিয়ে দেব কাল-পরশুই… আপাতত বিদায়…
শান্তির আশায়…
নীল…