Hope not ever to see Heaven. I have come to lead you to the other shore; into eternal darkness; into fire and into ice.
Dante Alighieri
||১৭||
এত সুন্দর আবহাওয়া, লেপচাখায় এই প্রথম পেল ওরা। রূপোলী নদীগুলো আজ কুয়াশার আড়ালে লুকিয়ে নেই; আর দু’দিন আগের বৃষ্টিতে মাজা-ধোয়া আকাশ কাচের মতই চকচক করছে। এগারোটায় লেপচাখা পৌছোনোর পর, কাজ গোছানো হয়ে যায় দেড়টা নাগাদ। তারপর প্রথমে লেপচাখা আর তারপর বক্সা ফোর্ট-এ বেশ কিছুটা সময় কাটায় সব্বাই। অনেক দিক থেকেই স্মরণীয় এই সফর কে আরো বেশী করে মনে রাখার প্রচেষ্টায় অসীমাভর ক্যামেরাটা আজ খেটে চলেছিল ওভারটাইম।
বক্সা ফোর্টের আনাচে কানাচে আপনমনে অনেকক্ষণ ঘুরে বেড়াল মৈনাক। বন্ধুদের কাছে একটা ব্যাপার সে বেমালুম চেপে গেছে; আসলে ব্যাপারটা চেপে কোনও দরকার ছিল কিনা সেটা ভেবে পায়নি; তবে যতবার মনে হয়েছে, ‘এবার বলে দিই’; ততবারই মন বলেছে, ‘এখন নয়, পরে… ঠিক সময় আসবে’।
-“তুই না, কিছু একটা চেপে যাচ্ছিস…” -পেছন থেকে শ্বেতাংশুর আবির্ভাব হয়।
মৈনাক একটু চমকেই ওঠে; অপদেবতার তো অভাব নেই চারপাশে; এখন শ্বেতাংশু কি শেষে অন্তর্যামী হয়ে উঠল নাকি ? সে হেসে উত্তর দেয়,
-“না ভাই… কি আর চেপে যাব ? চাপার মত আছেটা কি ?”
-“না না, কিছু নিশ্চয়ই চেপে যাচ্ছিস… আমার মনে হয় তিয়াসার সাথে আবার প্যাচ-আপ করে নিয়েছিস, আর অসীমের ভয়ে সেটা লুকোচ্ছিস…”
-“আরে ধুর! না ভাই… ও চক্করে আমি নেই… হ্যাঁ, জানি এত বছরের প্রেম, ভেঙে গেলে প্রথম প্রথম ফিরে পেতে মন চায়, কষ্টও হয়, কিন্তু ক’টা দিন গেলে বোঝা যায় যা হয়েছে ভালোই হয়েছে…”
-“যাক! এটা যে তোর মাথায় ঢুকেছে সেটা জেনে আমি অভিভূত, আপ্লুত ! এবার চল, অসীম একটা গ্রুপ ফটো তুলবে বলে ডাকছে।”
গ্রুপ ফটো তুলে হেলে দুলে রিসর্টে ফেরা হল বিকেল পাঁচটা নাগাদ। মাঝখানে দু’টো দিন নষ্ট হয়েছে বলে আর দেরী না করে পর পর কাজগুলো মিটিয়ে নেওয়াই ঠিক হবে, সেটা স্যার এবং তারাদা দু’জনেরই মত। তাই কালই যাওয়া হবে জয়ন্তী। তাই ঘরে ডেটার কাজও চলছে জোরকদমে; অনুপ্রিয়া আর সমীরা নিজের নিজের রিপোর্টের কাজ অনেকটাই এগিয়ে রেখেছে; অন্যরা ডেটা নিয়ে আপাতত ব্যস্ত, ভেবে রেখেছে, শেষ দু-তিন দিনে রিপোর্ট লেখা যাবেখন, এখন আপাতত এতদিনের এবং নতুন সংযোজিত হওয়া ডেটার কাজটা মিটিয়ে ফেলাই বাঞ্ছনীয়।
এর আগের দু’দিন একেবারে নির্বিঘ্নে কেটেছে; কিন্তু আজ কাটল না, রাতে আবার নামল বৃষ্টি। খুব জোরে নয়, আবার খুব আস্তেও নয়। আর বৃষ্টির মধ্যেই শোনা গেল শ্বেতাংশুর ভাষায় ‘অতীন্দ্রিয় করাতি’র শব্দ। শুধু তাই না, সেটার সাথে যুক্ত হল আর একটা শব্দ; অনেকটা কাঁচ ভাঙার মত; একটানা বার বার… যেন কেউ কাঁচের শিশি বা বোতল একটা একটা করে আছাড় মেরে ভাঙ্গছে। কিন্তু বৃষ্টির মধ্যে বাইরে গিয়ে অনুসন্ধান করার ইচ্ছে কারোরই হল না। সবাই ঘুমের দেশে পারি দেওয়ার কাজেই মন দিল।
সান্তালাবারি থেকে জয়ন্তী আর রাজাভাতখাওয়া মোটামুটি সমদুরত্বে। তাই ওটাও যাতায়াত করেই সার্ভে করা যাবে, ওখানে গিয়ে থাকার দরকার পড়বে না। রাতে বৃষ্টিটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে যায়নি বলে সকালে বেরোতে কোনও অসুবিধাই হল না। জয়ন্তী পৌছোতে সময় ও বেশী লাগল না। রাস্তা চমৎকার। এখানে যা কাজ আছে, তাতে প্রথমে তিনদিন মনে হলেও এখন বোঝা যাচ্ছে দু’দিন সময় পেলেই হয়ে যাবে। আর প্রথম দিনে বেশী কাজটা মিটিয়ে নেওয়ায়, দ্বিতীয় দিনে আবারও অনেকটা সময় বেঁচে গেল। ঘুরতে যাওয়া হলে জয়ন্তী নদীর তীরে।
ডুয়ার্সের অপেক্ষাকৃত ছোট নদীগুলোর সৌন্দর্য্য একদমই অন্যরকম সে মূর্তি হোক, সান্তালিখোলা হোক, বা জয়ন্তী। কনকনে ঠান্ডা জল, আর কাচের মতো পরিষ্কার। ছোট ছোট নুড়িতে ভর্তি গোটা নদীখাত। পার্বত্যগতি হলেও, জলের গভীরতা কম বলে জলের শক্তিও কম। তাই সেই হাঁটু অবধি ঠান্ডা জলে নেমে ছবিতোলা থেকে শুরু করে এ ওর গায়ে জল ছেটানো সবই হচ্ছিল। আকমলের জলে ভয়, তাই সে নদীর একদম পাড়ে বসেই নুড়ি ঘাঁটছিল, আর ফোন কানে নিয়ে কাউকে শোনাচ্ছিল, জয়ন্তী নদীর পাড়ে কিরকম হরপ্পা সভ্যতার নিদর্শন এবং ডাইনোসরের ডিম পাওয়া গেছে। অসীমাভ ছবি তুলছিল। ক্যামেরায় চোখ লাগালে, তার হুঁশ থাকে না অন্যদিকে। এক পা দু’পা করে এগোতে পেছোতে, তার সংঘর্ষ হয় উবু হয়ে বসা আকমলের সঙ্গে। দু’জনেই টাল সামলাতে পারে না, অসীমাভ নিজের ক্যামেরা সামলাতে সামলাতে সপাটে নদীর তীরে আছাড় খায়। আর আকমল ভারসাম্য হারিয়ে সোজা জয়ন্তীর জলে। তারা দা দৌড়ে এসে আকমলকে টেনে তোলে, কিন্তু ততক্ষণে তার মোবাইলের সলিল সমাধি ঘটেছে। ঠান্ডা জলে ভিজে সে হি হি করে কাঁপছে। অসীমাভরও লেগেছে, কিন্তু সে ব্যাথার তোয়াক্কা না করে আগে ভালো করে ক্যামেরাটা পরীক্ষা করে দেখে।
-“চিন্তা করিস না, ভাই… তোর মোবাইল ঠিক হরপ্পা সভ্যতা থেকে ডাইনোসরের ডিম খুঁজে নিয়ে আসবে…”
শ্বেতাংশুর এই টিপ্পনীর উত্তরে আকমল কিছু না বলে শুধু কটমট করে তাকায়।
আকমল আর অসীমাভর এই দূর্ঘটনার জন্য একটু তাড়াতাড়িই ফিরতে হয় আজ। ঠিক দু দিন বাদ দিয়ে তৃতীয় দিনের দিন তাদের ফেরার টিকিট। আর কাজও আজকেই শেষ; তাই ডেটা আর রিপোর্টের কাজ শেষ করেও হাতে অঢেল সময় আছে। তার মধ্যে তো মৈনাক একদিন ফিস্টের প্ল্যান করেই রেখেছে।
যখন ওরা লেপার্ডস নেস্ট-এ ঢুকলো, তখন বিকেল গড়িয়ে সবে সন্ধ্যেটা নামছে। রতন যেন তাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল, ছুটতে ছুটতে এসে বলল,
-“দা’বাবুরা… একটা বাচ্চা ঢুকেছে হোটেলের মদ্যি…”
অন্যরা কিছু বলার আগেই, তারাদা বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠে বোঝাল, কাছের যে নেপালি এবং ওঁরাওদের বস্তি আছে, সেখান থেকে মাঝে মাঝে বাচ্চা ছেলেপুলে এটা ওটা চুরির মতলবে রিসর্টে ঢুকে পড়ে, আর পরে সময়মত বেরোতে না পারলে রাতে জঙ্গলের পথে পালাতে গিয়ে বিপদে পড়লে ছেলের বাড়ির লোকজন হোটেল বা রিসর্টের বোর্ডারদের ওপরই চড়াও হয়ে থাকে। রতন দেখেছে একটা বাচ্চাকে চা বাগানের দিক দিয়ে ঢুকতে, তারপর কোথায় লুকিয়েছে, আর খুঁজে পাচ্ছে না। তার ওপরে এখন অন্ধকার নামছে দ্রুত।
তারাদার কথা মত, অসীমাভ তাদের ঘর খুলে সবক’টা ফ্ল্যাশলাইট বের করে ঘরের দরজা জানলা ভালো করে বন্ধ করে। স্যারের ঘরেও তাই করা হয়। তারপর সবাই মিলে আঁতিপাঁতি করে খোঁজা শুরু হয় গোটা রিসর্ট চত্তর। কিন্তু প্রায় দু’ঘন্টা চলে যায়, অন্ধকার গাঢ় কয়ে ঘন্টিপোকা ডাকতে থাকে, ছেলেটার কোনো চিহ্নই পাওয়া যায় না।
গেল কোথায় ? এই অন্ধকারে তো পেছনের জঙ্গল বা চা বাগান দিয়ে পালানো সম্ভব নয়, আর রিসর্টের সামনের দিকে দাঁড়িয়ে স্যার নিজে। তার চোখকে ফাঁকি দেওয়া মুশকিল।
-“হ্যাঁ রে, ঠিক দেখেছিলি তো ?” তারাদা প্রশ্ন করে রতন কে।
-“হ্যাঁ, দাদা… পস্ট দেকিচি…”
কিন্তু রতন পস্ট দেখলেও কোনো মানবসন্তানের চিহ্ন পাওয়া যায় না গোটা এলাকার মধ্যে। ছেলেটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। তন্নতন্ন করে গোটা রিসর্ট খুঁজে অগত্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ হাল ছেড়ে তারা দা চলে যায়, রতনও রান্নার জোগাড়ে লাগে।
ঘরে এসে জামাকাপড় ছেড়ে আকমল আর অসীমাভ গায়ে ভোলিনি মালিশ করে ধাতস্থ হয়ে বসে। আজ খাবার পেতে দেরী হবে বলাই বাহুল্য, তাই কাজের জিনিস খুলে বসে চারজনে। অনুপ্রিয়া আর সমীরার নাকি রিপোর্টের একটু কাজ শেষ, তাই ডেটার কাজ যা আছে, খাওয়ার আগে শেষ করা গেলে খাওয়ার পরে চারজনে নিজেদের রিপোর্টগুলো নিয়ে বসা যাবে।
এবং হয়ও তাই। রাত দশটায় খেতে যাওয়ার আগে, ডাটার কাজ শেষ হয়ে যায়, এবং খেয়েদেয়ে পুরোদমে রিপোর্ট লেখার কাজ শুরু হয়। ভেতরের ঘরে অনুপ্রিয়া আর সমীরা খেয়ে দেয়ে এসেই ঘুমোতে যায়।
তখন বাজে রাত ঠিক দেড়টা। সবাই একাগ্রচিত্তে রিপোর্ট লিখছে। আর লেখার সাথে সাথেই, মৈনাক ভাবছে, এবার সবাইকে বলে দিলেই হয় কথাটা… কিন্তু আকমলটা যে জেগে আছে… এসব ভাবছে, আর লেখা চলছে; এমন সময় দরজায় খুব পরিচিত একটা টোকা পড়ল।

এত রাতে কে ? স্যার নাকি ? টোকার ধরণটা শুনে তো সেরকমই মনে হল।
অসীমাভ উঠে দরজাটা খোলার সঙ্গে সঙ্গে দু’টো ঘটনা ঘটল। এক, কয়েক মুহূর্তের জন্য দেখা গেল দরজার বাইরে কেউ দাঁড়িয়ে নেই। আর তারপরই ঘরের সমস্ত আলো ঝপ করে নিভে গেল। শুধু তাই নয়, অসীমাভর খোলা ল্যাপটপটাও বন্ধ হয়ে গেল।
-“যাহ শালা ! পাওয়ার সার্জে ল্যাপটপটাও গেল নাকি… ওরে, কেউ আলো জ্বালা…”
এই বলে ঘরের দরজা বন্ধ করে ল্যাপটপের চার্জারটা প্লাগ পয়েন্ট থেকে খুলে নিয়ে এসে সেটা পরীক্ষা করতে থাকল সে। শ্বেতাংশু আর মৈনাক ফ্ল্যাশলাইট জ্বালাতে গিয়ে দেখল, একটু আগেও কাজ করা টর্চগুলো আর জ্বলছে না…
-“ব্যাটারি গেল নাকি ? -শ্বেতাংশু বিরক্ত হয়।
-“এত সহজে ? মনে হয় না… দাঁড়া, অসীমাভরটা দেখি…”
অসীমাভর ফ্ল্যাশলাইটও জ্বলল না। তখন দিলীপ বাবুর দেওয়া সোলার লাইটগুলোও জ্বালানোর চেষ্টা করা হল, কিন্তু না। সেগুলোও জ্বলছে না।আর অসীমাভ এতক্ষণ খুটখাট করে ল্যাপটপটাও অন করতে পারেনি।
-“দাঁড়া তো, আমার ব্যাগে মোমবাতি আছে…” এই বলে শ্বেতাংশু উঠে গেল ব্যাগ হাতড়াতে।
পল্লবী তার জায়গায় চুপ। একেবারে পাথরের মত বসে আছে। তবে সত্যি বলতে ভয় সবারই করছে; এমনকি আকমল অবধি একবার ‘মুশকিল হল’ বলে চুপ করে গেছে।
শ্বেতাংশু তার ব্যাগ থেকে একগাদা মোমবাতি আর দেশলাই বের করে একটা কাঠি জ্বালালো। সেটা জ্বলে উঠে, মোমবাতির সলতে অবধি পৌঁছোনোর আগেই নিভে গেল। তারপর আর একটা, তারপর আর একটা… ঘোড়া বিন্দুমাত্র হাওয়া না থাকা সত্ত্বেও, তিন তিনটে কাঠি এমনি এমনিই নিভে গেল। মৈনাক আর শ্বেতাংশুর যৌথ প্রচেষ্টায় চতুর্থ কাঠিটা একটা মোমবাতি জ্বালাতে সক্ষম হল ঠিকই, কিন্তু সেটাও সঙ্গে সঙ্গে দপ করে নিভে গেল।
যতবার আলো জ্বালাতে চাই নিবে যায় বারে বারে।
এই বিপর্যয়ের মধ্যেও শ্বেতাংশু এক কলি গেয়ে ওঠে। অসীমাভ ল্যাপটপটা রেখে দিয়ে এতক্ষণ চুপ করে দেখছিল। সে এবার খেঁকিয়ে ওঠে।
-“তামাশা রাখ… দরজার টোকাটা দিল কে দেখেছিলি ?”
-“আমি তো কাউকেই দেখলাম না…”
শ্বেতাংশুর কথা শেষ হওয়ার আগেই, মৈনাক হঠাৎই ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বেশ জোরে শশশশশশ করে শব্দ করে। সবাই চুপ করে যায় তার এই ভঙ্গিতে। এবার কান পাতলে শোনা যায়…
শোনা যায় ? না কিছুই শোনা যায় না… বাইরে ঘন্টিপোকার আওয়াজ নেই, হাওয়ার শব্দ নেই, একটা অপার্থিব নিস্তব্ধতা যেন আরও একবার তাদের গ্রাস করেছে। এবার সবাই সোজা সামনের দেয়ালের দিকে তাকায়, আর একবার ছাদের দিকে। ঘরে আলো নেই, থাকলে দেখা যেত, সবার মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। সবার মনে হচ্ছে, গোটা ঘরের ছাদ আর দেয়াল থকে সম্মিলিত হয়ে কিছু একটা বিরাট জিনিস যেন তাদের দিকে এগিয়ে আসছে; যেন গোটা ঘরের অন্ধকারটা সংকুচিত হয়ে একটা বিরাট বড় হাঁ করে ওদের গিলতে আসছে। এরকম অভিজ্ঞতা মৈনাকের হয়েছে, ক’দিন আগে হয়েছে শ্বেতাংশু আর অসীমাভেরও। কিন্তু সেটা ঘরের ভেতরে নয়। বাইরে, জঙ্গলের সামনে, খোলা আকাশের নিচে।
জঙ্গলের সেই জিনিসটি এখন প্রবেশ করেছে ঘরে। চারটে জলজ্যান্ত মনুষ্যসন্তানের সাথে এক ঘরে বন্দি কোনও এক অজানা অলৌকিক জীব, যে তার অতপ্রাকৃতিক শক্তির বলে যেন থামিয়ে দিয়েছে সময়, থামিয়ে দিয়েছে হাওয়া, শব্দ, নিভিয়ে দিয়েছে ঘরের আলো… শুধু সর্বগ্রাসী ক্ষুধায় গিলে খেতে চাইছে চারটি প্রাণীকে, যাদের হৃৎপিন্ড এখন কনসার্টে বেজে ওঠা ড্রামসেটকে টেক্কা দিতে পারবে অনায়াসে।
পল্লবীর সারা শরীর কাঁপছে, তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে… সে শক্ত করে ধরে আছে অসীমাভর কাঁপতে থাকা হাত। আকমলকে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু সে বিরবির করে কিছু বলে চলেছে। শ্বেতাংশুও স্থির, সে দেয়ালের দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না, যেন মনে হচ্ছে চোখ ঘোরালেই, জিনিসটা লাফিয়ে পড়বে তাদের গায়ের ওপর।
এর মধ্যেও একমাত্র মৈনাক সচল।
সে আসতে আসতে জানলার কাছে গিয়ে জানলা দিয়ে মুখ বাড়াল। ভালো করে চারদিক দেখে, আবার সেখানেই বসে পড়ল। অতিকষ্টে অসীমাভ তার শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া গলা থেকে আওয়াজ বের করল।
-“কি দেখলি ?”
-“দেখলাম… স্যারের ঘরে আলো জ্বলছে, রতনের ঘরেও। এটা পাওয়ার ফেলিওর নয়…”
-“আর…”
-“রিসর্টের জমির মাঝখানে কালো কুকুরটা বসে আছে… আমাদের কুকুরগুলো ত্রীসিমানায় নেই…”
এ কথার উত্তর কেউ দিল না। আসলে কথা বলার মত অবস্থায় কেউ নেই। পাশের ঘর থেকে অনুপ্রিয়ার নাক ডাকার শব্দ শোনা যাচ্ছে।
-“ভাই… এ তো জ্বীন-জন্নতের ব্যাপার মনে হচ্ছে…” -আকমল মুখ খোলে।
অসীমাভ একটা মৃদু হুঁ ছাড়া আর কিছু বলে না। মৈনাক শ্বেতাংশুর কাছে সরে আসে। একটু একটু করে সবাই কাছাকাছি সরে আসে। এখন সবাই বিছানাটার মাঝখানে জমাট বেঁধে বসে, সবার নিঃশ্বাস আর হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছে পরিষ্কার।
একজন কতটা ভীতু, সাহসী বা বেপরোয়া ধরণের বোকা, সেটা বোঝা যায় ভয়ের সম্মুখীন হলে। প্রচন্ড ভয়ের সম্মুখীন হয়ে কারো কারো মনের ভেতরে সাহসের সঞ্চার হয় তৎক্ষণাৎ, আবার নিজেকে হাজার সাহসী বলে দাবী করা অনেকেই ভয়ের মুখে পড়ে জ্ঞানবুদ্ধি হারায়। আর শহরে থেকে থেকে বৈদ্যুতিক আলোর চটকে ভুলে, অন্ধকারের, মানে প্রকৃত জমাট কালীগোলা নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের বড় অভাব বোধ করে সবাই। তাই হয়তো অন্ধকারের ভেতরের আদিম শূন্যতাই আমাদের মনে ভয়ের উদ্রেক করে। কিন্তু যখন মনে হয় সেই অন্ধকারটাই হাঁ করে গিলে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইছে আমার অস্তিত্বকে, তখন অতিবড় বীরপুরুষেরও গলা শুকিয়ে যায়, হৃৎকম্প জাগে।
কিন্তু ভাগ্যের কথা, কাঁপতে কাঁপাতে, চোখের জল ফেলতে ফেলতেও অজ্ঞান কেউই হয় না। বরং একসাথে একজোট হয়ে বসে মনে অত্যন্ত সামান্য পরিমাণেই হলেও সাহস জেগে ওঠে। চুপ করে স্থানুর মত বসে থাকা ছাড়া আর কোন উপায়ন্তর না পেয়ে সবাই ঠায় বসে থাকে, হাত পা নাড়তে, একটু সরে বসতেও যেন ভয় লাগে… মনে হয় জিনিসটা, সেটা যাই হোক না কেন, জমাট অন্ধকারে মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে শিকারি বাঘের মতই ওত পেতে বসে আছে, আর পলকহীন দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে যাচ্ছে ঘরের বাকী বাসিন্দাদের। যেন সামান্য একটু বেচাল দেখলেই তার প্রস্ফুটিত বিভৎসা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে; নিজের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে।
প্রথম ঝিঁঝিটা ডাকলে মনে হয়, বাইরের প্রকৃতি যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। অসীমাভ ঘড়ি দেখে, পৌনে চারটে, একটু বাদেই ভোর হবে। সবার চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে, ঘরের আলোগুলো জ্বলে ওঠে। দেখা যায় টর্চগুলোও কাজ করছে আবার। যান্ত্রিক শব্দ করে অসীমাভর ল্যাপটপটাও চালু হয়ে যায় নিজে নিজেই। শ্বেতাংশু মোমবাতি জ্বালায় না, কিন্তু সে আন্দাজ করে, এখন সেটা জ্বালতেও কোনও সমস্যা হবে না। মৈনাক উঠে গিয়ে আবার জানলা দিয়ে উঁকি মারে। কালো কুকুরটা আর নেই। আর তাদের চারটে কুকুর আবার কোথা থেকে ফেরত এসেছে। সকালে হওয়া অবধি আর আলো নেভানো হয় না, কিন্তু নেভালে দেখা যেত, ঘরের অন্ধকার দেওয়ালটা আর, বুভুক্ষু দানবের মতো ওদের গিলতে আসছে না।
একটা কথা জানিয়ে রাখা, আগেই বলেছি গল্পের খাতিরে রং আমি একটু কেন, অনেকটাই মিশিয়েছি। কিন্তু এই পর্বের ধরে নিন ৮০-৯০ শতাংশই অবিকৃত এবং প্রত্যক্ষদর্শীর মুখের থেকে শুনেই লেখা…
পরের পর্বেই শেষ হয়ে যাচ্ছে “Somewhere… In the Jungle of North Bengal…” তারপরেই আসবে একটা পরিশিষ্ট পর্ব।