The forest is a peculiar organism of unlimited kindness and benevolence that makes no demands for its sustenance and extends generously the products of its life and activity; it affords protection to all beings.
Buddhist Sutra
||১৬||
মৈনাক ফিরল বেলা ১২টা নাগাদ। অসীমাভ রেগে ফায়ার হয়েছিল তার ওপর।
-“এই যে, চাঁদু… এতক্ষণ লাগে তোমার একটা ই-মেইল করতে ? নাকি প্রিন্ট-আউট নিয়ে হাতে করে পৌছাতে গেছিলে ব্যাঙ্গালোর ?”
মৈনাক হেসে বলে,
-“আরে না রে… আসলে দিলীপবাবুর সাথে দেখা করে, মেইল করা হয়ে গেলে রতনের সাথে একটু এদিক ওদিক ঘুরছিলাম; আর তাই একটু লেট হয়ে গেল… সরি…”
-“হ্যাঁ, উনি এদিক ওদিক ঘুরছিলেন আর ওনার জন্য আমরা ঘরে বসে আছি…”
-“চল, চল, সরি…”
কোনরকমে নাকে মুখে গুঁজে রাস্তায় বেরোয় পাঁচজনে, মৈনাক, শ্বেতাংশু, অসীমাভ, পল্লবী আর আকমল। অনুপ্রিয়া এবং সমীরা রিপোর্ট লেখার কাজটা এগিয়ে রাখতে চায়; ওদের প্রকৃতি দর্শনের অত ইচ্ছা নেই।
দিলীপবাবু বলেই দিয়েছিলেন, দিনের বেলা, দল বেঁধে বেরোলেও; সঙ্গে যেন কুকুরগুলো থাকে। তাই পাঁচজনে সঙ্গে দু’টো কুকুর নিয়ে বেরিয়েছে। রিসর্টের সামনে জঙ্গলের পাশ দিয়ে যাওয়া রাস্তাটা ধরে, সোজা এগোতে থাকে সবাই। ক’দিন ধরে বৃষ্টি হয়ে একটা চমৎকার সতেজ গন্ধ ছাড়ছে জঙ্গল থেকে; বাতাসেও একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব; সেটার ওপর হাল্কা রোদটা যেন একটা অত্যন্ত মনোরম পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। রাস্তার ধারে আর একটা বাংলো চোখে পড়ল ওদের; দেখে বোঝা গেল এটা সান্তালাবারির সরকারী বনবাংলো। শ্বেতাংশু হাঁটতে হাঁটতেই গান ধরল;
“সানশাইন… অন মাই শোল্ডার মেক্স মি হ্যাপি…”
হাঁটতে হাঁটতে এবার রাস্তার দু’ধারেই শুরু হল জঙ্গল। সেই রাস্তায় যেতে যেতে ওরা গাছের মাথায় প্রথম দেখল নীলকন্ঠ; অসীমাভ ছবি তুলতে পেরে খুশি হয়ে গেল খুব। আরও কিছুদুর যাওয়ার পর দেখা গেল সামনের রাস্তাটা দু’ভাগ হয়ে গেছে। একটা রাস্তা অপেক্ষাকৃত সরু; এবং সামনে ঢালু হয়ে গেছে। অসীমাভ বলে উঠল;
-“চল, আগে সরু রাস্তাটা ধরেই না হয় ঘুরে আসি; তারপর এদিকে যাওয়া যাবে ?”
সে কথায় কেউই আপত্তি করল না; রাস্তাটা ধরে কিছুটা চলার পর, দেখা গেল সেটা ঢালু হয়ে একটা ছোট্ট পাহাড়ি নদীতে গিয়ে মিশেছে; এত বৃষ্টির পরও, জল প্রায় নেই বললেই চলে; নুড়ি আর পাথরে ভর্তি। সবাই মিলে নদীর ধারে বসে, কুকুরগুলোকে ছেড়ে দেয় তখন।
-“বাহ ! এখানে যে এরকম একটা পিকচারেস্ক নদী আছে, সে তো না এলে জানতেই পারতাম না ! এ নদীর নাম কি জানতে হবে…”
-“এর নাম ‘খড়িয়া’; আমি জানতাম না; আজ রতন বলছিল, কাছেই খড়িয়া নদী আছে…”
অসীমাভর প্রশ্নের উত্তরটা মৈনাকই দিয়ে দেয়।
-“ভালোই র্যাপো বানিয়েছিস তো, রতনের সাথে…”
মৈনাক হাসে। এমন সময় শোনা যায়, আকমল কার সাথে কথা বলছে ফোনে;
-“না না, সে তো ভারী মুশকিল হয়ে যাবে… আমি কি বলে… এক্সক্যাভেশনে এসেছি তো… না না রাজস্থানে নয়; নর্থ বেঙ্গলে; হ্যাঁ… এখানে কিছু হরপ্পা সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গেছে…”
অসীমাভর চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়, সে ফিস ফিস করেই বলে
-“এই ডাহা ডাহা গুলগুলো কাকে মারছে ভাই !”
ওদিকে আকমল গম্ভীর হয়ে কথা চালিয়ে যায়;
-“না না… ফান্ডিং এখানের না… ফান্ডিং বাইরের… হ্যাঁ, বাইরের ফান্ডিং ছাড়া আমি কাজ করি না… না না আমাদের গভমেন্ট টাকা ক্লিয়ার করতে অনেক সমস্যা করে…”
এবার ওরা হেসে ফেলে, পল্লবীও বাদ যায় না। আকমল বিরক্ত হয়েই ওদের দিকে তাকায়, তারপর আবার ফোনে ফিরে যায়,
-“কোন ইন্সটিট্যুট ? সন্ডার্স-হার্ডিম্যান ইন্সটিট্যুট অফ আরকিওলজি…”
এবার অসীমাভ বিশাল জোরে হেসে ফেলে; আর আকমল বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গিয়ে ‘পরে কথা বলছি’ বলে ফোন কেটে দেয়।
-“এভাবে হাসার কি মানে হল ?”
-“কি মানে হল মানে ? তুই টিনটিনের গপ্পের প্লট ঝেড়ে গুল দিবি, আর আমি হাসতে পারব না ? কাকে গুল দিচ্ছিলে, চাঁদু ?”
-“হ্যাঁ, খালি গুল দিচ্ছি, ওই ভেবে যা… কত কষ্ট করে একটা মেয়ে পটাচ্ছি…”
এটুকু বলামাত্র বাকী তিনজন এ-ওর গায়ে ঢলে পরে বেদম হাসতে থাকে, হাসির দাপটে কুকুরগুলো দুর থেকে ছুটতে ছুটতে ওদের কাছে চলে আসে ব্যাপার বোঝার জন্য। ওরা তখনো হেসে চলেছে। শ্বেতাংশু কোনরকমে বলল,
-“ভাই, জল দে, জল খাবো… এখানে আসা ইস্তক এত হাসিনি… ওরে মা রে মা…”
আকমল মুখটা ভার করে বলে ওঠে –“এগুলো বড্ড মুশকিল করিস…”
আর কিছুক্ষণ নদীর পারে বসে, নদীর জলে একটু পা ভিজিয়ে আর নুড়ি কুড়িয়ে আবার ফিরতি পথে চলা শুরু করে ওরা। বড় রাস্তায় ওঠার পড়ে, সেটা ধরেই আবার সামনে চলতে থাকে। আরও কিছুদুর যাওয়ার পর, দেখা যায় একটা চা বাগান। বিরাট বড় একটা সবজে গাছের কারপেট নেমে গেছে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। এখানে আসার পড় চা বাগান, চা পাতা তোলার দৃশ্য, ওরা দেখেছে, কিন্তু সবই গাড়ি থেকে; তাই পায়ে হেঁটে চা বাগানে একটু ঘোরার লোভ ওরা কিছুতেই সংবরণ করতে পারল না। তবে আশ্চর্য্যের বিষয় হল, এই চা বাগানে তখন কেউ কাজ করছে না; দেখা যাচ্ছে চা-এর বন থেকে বেরিয়ে সবাই একধারে দাঁড়িয়ে।
-“এখন হয়তো লাঞ্চ চলছে ওদের…” -এই বলে অসীমাভ যেই না বাগানের দিকে পা বাড়িয়েছে, দু’টো কুকুর পরিত্রাহি চিৎকার করতে আরম্ভ করে দিল, শুধু তাই নয়, দু’জনে মিলে এমন ভাবে রাস্তা আগলে দাঁড়ালো , যেন কিছুতেই সামনে এগোতে দেবে না ওদের। কুকুরের চিৎকারে, চা বাগানের সামনের একটা গুমটি থেকে একটা লোক বেরিয়ে এসে বলল,
-“উঁহু, বাগানে ঢুকবেন না… লেপার্ড বেরিয়েছে…”
তখনই বোঝা গেল, লাঞ্চ করতে নয়, আপন প্রাণ বাঁচাতেই, চা এর মোহ ছেড়ে রাস্তার ধারে ভীড় করেছে চাচারা…
সে যাত্রায় আর চা বাগানে ঢোকা হলনা ওদের। আর কিছুটা এগিয়ে গিয়ে, এদিক ওদিক ঘুরে আবার ফিরতি পথে চা বাগানে ঢুকে, ছবি টবি তুলে, রিসর্টে যখন ফিরল, তখন বাজছে বিকেল পাঁচটা।

তারাদা এসে বসে স্যারের সাথে গল্প করছিল; ওদের দেখে কেমন ঘোরা হল সেটা জিজ্ঞাসা করার পর, বলল,
_”কাল তাহলে আমরা ভোর ভোর রাজাভাতখাওয়া বেরোচ্ছি; সারাদিন ঘুরে, একটা ভালো জায়গায় নিয়ে যাব লাঞ্চ করাতে, আর বিকেল বিকেল ফিরব…”
আরও কথা বলতে বলতে বোঝা গেল, লেপচাখার রাস্তা প্রায় পরিষ্কার, কিন্তু কালকের দিনটা গেলে একেবারে ঠিকঠাক হয়ে যাবে রাস্তা। জয়ন্তীরও জল নেমেছে, আর বৃষ্টি না হলে এবার আর সার্ভের পথে কোনও বাধা নেই। বাকী গল্পও হল, খড়িয়া নদী, চা বাগানে লেপার্ড, সবই…
তারাদা চলে গেলেই, আকমল ‘হেবি ঘুম পাচ্ছে’ বলে ঘরে চলে যায়; স্যার এবার বলেন,
-“কি, মৈনাকবাবু ? কেমন লাগছে ? মনটা আগের থেকে ভালো তো ?”
মৈনাক এ কথায় মাথা নেড়ে হাসিমুখে সম্মতি জানায়।
-“আরে হ্যাঁ হ্যাঁ, জোয়ান ছেলে, কতই বা বয়স হল ? জীবনে এক-দুবার ল্যাং না খেলে কি আর প্রেমের বেস শক্ত হয় ? এই আমাকেই দেখ না… তোদের কাকীমার সাথে প্রেম-বিয়ে এসবের আগে কলেজে একটা কচি প্রেম আমারও ছিল… টিকেছে ? যেই মাস্টার্স পড়তে গেলাম, বিয়ে করে ভেগে গেল…”
মৈনাক একথায় লজ্জায় লাল হয়ে যায় প্রায়, শ্বেতাংশু অপ্রস্তুতের হাসি হাসে। আরও কিছুক্ষণ হাসিঠাট্টা করার পর, ওরা ঘরে ফেরত যায়। ঘরে ঢুকেই মৈনাক বলে,
-“একটা কথা জানিয়ে রাখি ভাই… সকালে দিলীপবাবুর সাথে কথা হল, ওনারা সারারাত জঙ্গলে কিন্তু কিছু খুঁজে পাননি। রাতে কাঠচেরার মত শব্দটা পেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু সেটার কোনও উৎস খুঁজে পাওয়া যায়নি; যতবার মনে হয়েছে কাছে এসে পড়েছেন, ততবার আবার যেন একটু দুরে নতুন করে শুরু হয়েছে। শব্দটা যেন লুকোচুরি খেলার মত পালিয়ে বেরিয়েছে জঙ্গলের মধ্যে।”
অসীমাভ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসে পরে ধপ করে, শ্বেতাংশু বলে-
-“শেষে অতীন্দ্রিয় কাঠুরে ?”
-“আমি তো আগেই বলেছিলাম, জঙ্গলের ওই শব্দটা আমার খুব একটা সাধারণ শব্দ বলে মনে হয়না ভাই…”
অসীমাভ বলে,
-“যাকগে, ওসবকে এখন গুলি মারো, আপাতত আমাদের কাজ ডেটা অ্যানালিসিস শেষ করা, আর কাল ভোরে আমাদের গন্তব্য রাজাভাতখাওয়া…”
সেই রাতটা একেবারেই নির্বিঘ্নে কাটে; না জঙ্গলের কোনও শব্দ শোনা যায়, না কান্নার আওয়াজ। খাওয়া দাওয়া আর ডেটার কাজটা শেষ করে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে সবাই।
বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের দু’টি মূল অংশ, জয়ন্তী যেটাকে অনেকে বক্সা-জয়ন্তীও বলে থাকেন এবং রাজাভাতখাওয়া। ভোর ভোর বেরিয়ে রাজাভাতখাওয়ার ঢোকা হল সকাল ন’টায়। বৃষ্টি না থাকলেও আজ দু’টো জীপ নেওয়া হয়েছিল। জীপে করে জঙ্গলে ঘোরা হল; নাম ‘টাইগার রিজার্ভ’ হলেও, বেঙ্গল টাইগার যে ডুমুরের ফুল, সেটা সবার আগে থেকেই জানা ছিল, তবে তার পদচিহ্ন দেখা গেল। অসীমাভ প্রশ্ন করেছিল, পায়ের ছাপ থাকলেও বাঘটা দেখা যায় না কেন; উত্তরে তারাদা বলেছিল, একটা প্রাপ্তবয়স্ক বাঘ, একরাতে শিকারের সন্ধানে প্রায় ৬০-৭০ কিলোমিটার হাঁটে, তাই জঙ্গলের অনেকটা অংশ সে হেঁটে ঘুরে ফেললেও, রাতের শেষে নিজের এলাকার গভীরতম অংশেই সে থাকতে ভালোবাসে।
তবে বাঘ দেখা না গেলেও, দেখা গেল বার্কিং ডীয়ার, স্পটেড ডীয়ার, এবং অজস্র পাখি… শখের বার্ড-ওয়াচার অসীমাভ প্রথমে গুনে গুনে পাখির ল্যাটিন নাম কপচালেও, কিছুক্ষণ পরেই খেই এবং হিসেব দুটোই গুলিয়ে ফেলল। তবে সে ছবি তোলে প্রচুর।
দুপুরে তারা দা, তার এক বন্ধুর বাড়িতে খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। সরু চালের ভাত, আনাজ দিয়ে ডাল, কষা পাঁঠার মাংশ, শেষে দই আর মিষ্টি। এক কথায় এলাহি ব্যবস্থা। খাবারের সাথে স্যালাড দেওয়া হয়েছিল, আর স্যালাডের মধ্যে ছিল ছোট্ট ছোট্ট গোল গোল লংকা। মাঝেমাঝেই ট্রেক করতে যাওয়া অসীমাভর ধারণা ছিল ওই লঙ্কায় কি মারাত্মক ঝাল হতে পারে, তাই সে ছুঁয়েও দেখেনি। কিন্তু যখন দেখল শ্বেতাংশু সেদিকে হাত বাড়াচ্ছে, সে বলল,
-“নিচ্ছিস তো… খেতে পারবি ?”
-“ভাই, রোজ লঙ্কা খাই… খেতে কেন পারব না ?”
-“ভাই, এই লঙ্কা একটা খেলে তোকে আমি নোবেল দেব, দু’টো খেলে অস্কার… আর তিনটে খেয়ে ফেললে তোর পোড়ানোর খরচ আমার…”
তাচ্ছিল্যের সাথে লঙ্কায় একটা কামড় বসানোর পর, শ্বেতাংশু যে লঙ্কাকান্ড শুরু করে সেটা থামাতে লাগে প্রায় ২ লিটার জল আর তিনশো গ্রামের কাছাকাছি দই।
এই গ্র্যান্ড লাঞ্চের জন্য সবাই তারাদা অনেক অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে রিসর্টে ফেরা হয়। আজও বৃষ্টি হয়নি ভাগ্যক্রমে, তাই শুভস্য শীঘ্রম মেনে, কালই লেপচাখার কাজ শেষ করে জয়ন্তীর জন্য তৈরী হতে হবে।
কি মনে হচ্ছে ? ঝড়ের আগে একটু নিশ্তব্ধই লাগে চারদিক… আর এই সিরিজে ব্যবহূত অনেক ছবির মতোই, এটাও শ্বেতাংশুর তোলা, অসীমাভ্র তোলা কিছু ছবিও দিয়েছি… আর দুটো পর্ব… তারপরেই যবনিকা পতন…