Somewhere In the Jungle of North Bengal… Part XV

||১৫||

রতনের সাথে কথা বলে মোটের ওপর খুব একটা কিছু লাভ হয় না ওদের। ডেটার কাজ কিছুটা করে দুপুর নাগাদ ঘুমিয়ে উঠে বিকেলে উঠতেই দেখে, তারাদা এবং দিলীপ বাবু এসে হাজির। হাসিখুশি দিলীপ বাবুর মুখ আজ অনেকটাই গম্ভীর। ওদের কথায় জানা গেল কাল রাত থেকে ওই প্রচন্ড বৃষ্টিতে  লেপচাখার রাস্তায় ধস নেমেছে, আপাতত দিক দু-তিনের জন্য রাস্তা বন্ধ; অন্যদিকে জয়ন্তীতেও জল বেড়ে গেছে; তাই ওই দু জায়গাতেই আপাতত সার্ভেতে যাওয়া যাবে না। এর মধ্যে যদি আবার ওইরকম বৃষ্টি হলে, সেটা সমস্যাটাকে আরো বাড়িয়ে দেবে।

এটা একদিকে ভালো কারণ এই দু-তিন দিন বৃষ্টি না হলে একটু এদিক ওদিক ঘুরে দেখা যাবে; আর খারাপ খবর হল সার্ভের কাজে দেরী হচ্ছে, আর যদি অনেকদিন দেরী হত পারে ভেবেই ফেরার টিকিট কাটা হলেও; সেই আন্দাজের বেশী দেরী হয়ে গেলে তখন সেই টিকিটও বেকার হয়ে যাবে।

স্যার বললেন,

-“অত উৎফুল্ল হওয়ার কিছু নেই; আপাতত যাও, ডেটার কাজ শেষ করে ফেল, তারপর তোমরা তারাশঙ্করের সাথে আলোচনা করে নিও এই দু’দিন কিভাবে ব্যবহার করা যায়।”

তবে আলোচনার দরকার পড়ল না; তারা দা নিজে থেকেই বলে উঠল;

-“কাল আমার হবে না, একটা কাজ আছে থাকব না, পরশু তোমাদের রাজাভাতখাওয়া ঘুরিয়ে আনছি। কাল বরং তোমরা আশেপাশে ঘুরে দেখে নিও দিনের বেলা… ঠিক হ্যায় ?”

ঠিক হ্যায় তো বটেই; বিকল্প তো কিছু নেই। এখন এই দু’দিন বৃষ্টি না হলেই বাঁচোয়া। না হলে কাজের তো দেরী হবেই, উপরন্তু ঘর থেকে বেরোনোও যাবে না। সবাই বসে আড্ডার প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন সময় মৈনাক কোথায় উধাও হয়ে যায়। অসীমাভ সেটা খেয়াল করলেও প্রথমে কিছু বলে না, তারপর স্যার সেটা খেয়াল করে হাঁকডাক করতে মৈনাক এসে হাজির হয়, রতনের ঘরের দিক থেকে।

-“কোথায় গেছিলি ?” -স্যার প্রশ্ন করেন।

-“ওই তো স্যার, রতনকে জিজ্ঞাসা করতে গেছিলাম ও কোথা থেকে বাজার করে… ভাবছি কাজ মিটে গেলে ফেরার আগে একদিন জমিয়ে এখানেই একটু ক্যাম্পফায়ার আর পিকনিক করব।”

-“বাহ ! এ তো উত্তম প্রস্তাব ! তা আমি আর তারা নেমন্তন্ন পাবো তো ?” -হাসি মুখে জিজ্ঞেস করেন দিলীপবাবু।

এ কথার উত্তর মৈনাকের বদলে অসীমাভই দেয়;

-“সে আর বলতে কাকু !?  যত বেশী লোক, ততই তো আনন্দ !”

-“এটা এক্কেবারে খাঁটি কথা বলেছ হে…” -সম্মতি জানান দিলীপ বাবু।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে কেটে যায় হাসি-ঠাট্টা আড্ডায়। দিলীপবাবু জানান, আজ রাতে ওনারা আবার সার্চ পার্টি নিয়ে জঙ্গলে ঢুকবেন; কাঠ-চোরের সন্ধানে। কথাটা শুনে মৈনাকরা একবার মুখ চাওয়া চাওয়ি করে নেয় শুধু।

দিলীপবাবু আর তারাশঙ্কর বিদায় নেওয়ার সময় মৈনাক একটা অদ্ভূত প্রশ্ন করে।

-“আচ্ছা কাকু, এ দিকে সাইবার ক্যাফে আছে কোথাও ?”

-“সাইবার ক্যাফে… নাহ… এ তল্লাটে নেই… কেন, কি দরকার ?”

-“ওই আমার একটা মেইল করার ছিল…”

-“মেইল করার ছিল ? তো তুমি একটা কাজ কর, কাল সকালের দিকে আমার অফিসে চলে এস; ওখান থেকে করতে পারবে…”

ওরা চলে যাওয়ার পর, অসীমাভ মৈনাককে জিজ্ঞাসা করে,

-“কাকে মেইল করবি, ভাই ?”

-“বলব, বলব, সব বলব… এখন চল তো… ঘরে যাই…”

সেদিন সন্ধে থেকে রাতে খাওয়া পর্যন্ত, মৈনাক মুখ বুজে কাজ করে যায়; অস্বাভাবিক রকমের গম্ভীর দেখায় তাকে। শ্বেতাংশু আর অসীমাভ বার বার জিজ্ঞাসা করলে একই উত্তর দেয়;

-“কিছু না রে… একটা জিনিস ভাবছি…”

-“কি জিনিস ?”

-“সে পরে বলব’খন…”

রাতে খাওয়া দাওয়ার পরও মৈনাক একইরকম গম্ভীর মুখে কাজ করে থেকে যায়।

-“তোর কি হয়েছে বলবি কি ?” -এবার বেশ রেগেমেগেই বলে ওঠে অসীমাভ।

-“আরে কিছু না রে ভাই… মনটা হঠাৎ করে খারাপ লাগছে; তাই আর কি। কিন্তু তুই চাপ নিস না, কাউকে ফোন বা মেসেজ করব না; তোর দিব্যি।”

-“থাক থাক… অকালে এরকম দিব্যি গেলে দিস না… মরে যাব পট করে… আর কাকে মেইল করতে যাবি রে ?”

একগাল হেসে মৈনাক বলে; আরে আমিই ভুলে গেছিলাম… যাওয়ার আগে একটা ওয়ার্কশপের ইনভাইট এসেছিল; সামনের মাসে IISc ব্যঙ্গালোর-এ… আসার আগে রিপ্লাই করতে হত; পরশু লাস্ট ডেট।

কথাটা যদিও অসীমাভর মনোঃপূত হল না, তবু সে চুপ করে গেল। কাজ চলতে থাকল, এমন সময় আবার রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে শুরু হল সেই ঘাঁষষ্যাঁষে আওয়াজ। কাজ বন্ধ করে চারজনে চুপ করে শোনে সেই শব্দ।

-“আজ দিলীপবাবুরা জঙ্গলে যাবেন বললেন না ? -প্রশ্ন করে পল্লবী।

-“হুঁ। এটার অন্তত কোনও উৎস পাওয়া গেলে হয়। -অসীমাভ স্বগতোক্তির মত করে বলে কথাটা।

মৈনাক উঠে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। অসীমাভ আর শ্বেতাংশু এসে দাঁড়ায় তার পাশে। বাইরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর প্রথম অসীমাভই বলে,

-“যাবি নাকি একবার বাইরে ?”

কেউ এর উত্তর দেওয়ার আগেই পেছন থেকে পল্লবী বলে ওঠে,

-“কেন ভাই ? এত পুরকি কিসের তোদের ? চুপচাপ বস না…”

অসীমাভ বলে,

-“আরে টুক করে যাব আর আসব, তুই একটা কাজ কর; দরজার একটা পাল্লা খুলে দাঁড়িয়ে থাক। ভূতে তাড়া করলে দৌড়ে ঢুকে আসব…”

-“হ্যাঁ, সেই… তোরা বড় হনু, বাইরে বাইরে ঘুরবি, আমি ঘরে বসে থাকব।।”

-“আচ্ছা, ঠিক আছে, ঠিক আছে, ঠিক আছে… একটা কাজ করি, মৈ আর অসীম যা, আমি আর পল্লবী দরজা আগলাচ্ছি…”

সন্তর্পণে দরজা খুলে মৈনাক আর অসীমাভ বাইরে বেরোয়। চারপাশ দেখে নিয়ে আস্তে করে দরজার বাইরে পা রাখে। দরজাটা পেরিয়ে একটু যেতেই দু’জনের চোখে পড়ে, মৈনাকের বর্ণণায় ‘হাউন্ড অফ বাস্কারভীল’-এর মত কুৎসিত, ভয়ঙ্কর চেহারার একটা কালো কুকুর চুপ করে বসে আছে সামনে। আর ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট-এর একটি কুকুরেরও কোথাও দেখা নেই।

-“মাইরি… কি কদাকার কুত্তা রে ভাই !”

-“হুঁ, কদাকার… কিন্তু ওখানেই বসে থাকে… নড়ে চড়ে না…”

কুকুরটার থেকে নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে রিসর্টের মূল দ্বারের দিকে এগোতে থাকে দু’জনে।

প্রথম যেদিন, যে পাথরটার ওপর বসে মৈনাক অতীন্দ্রিয় পায়ের শব্দ আর ছাপ প্রত্যক্ষ করেছিল, সেটার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় দু’জনে। জঙ্গলের শব্দটা বেশ স্পষ্ট। ভালো করে শুনলে সত্যিই মনে হল, যেন কাঠে কেউ করাত চালাচ্ছে। দু’জনেই অনেক চেষ্টা করে জঙ্গলের মধ্যে কিছু দেখা যায় কিনা । জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ অসীমাভই প্রথম দেখতে পায়, দু’টো জ্বলজ্বলে চোখ। না, সেই মানুষের ছায়ামূর্তির জ্বলন্ত চোখ নয়, মানে জঙ্গলে জানোয়ারের চোখ যেরকম জ্বলে, সেরকম। অসীমাভ মৈনাককে ডেকে দেখায় সেটা।

-“বাঘ নাকি রে ?”

-“বাঘ ? আমার মনে হচ্ছে না… বাঘ এত কাছে এলে গন্ধ পেতাম না ? খুনিয়ায় যেদিন বাইসন দেখলাম, সেদিনও কেমন বোঁটকা গন্ধ পেয়েছিলি, মনে নেই ? আর বাঘ এত কাছে বসে আছে, তার কোনো গন্ধ নেই ?”

-“তাহলে কি ওটা ? ধুর ! ফ্ল্যাশলাইটও আনা হল না ! একটা কাজ কর; আমি এখানে দাঁড়াই, তুই গিয়ে…”

অসীমাভকে কথা শেষ না করতে দিয়েই মৈনাক বলে উঠল

-“না। একদম না… কথা হয়েছিল কোথাও একা যাব না; তো দু’জনেই যাব, গিয়ে টর্চ নিয়ে আসব…”

অগত্যা, দু’জনকেই আবার ঘরের দিকে ফিরতে হয়। ফেরার সময়েও দেখে, কালো কুকুরটা চুপ করে বসে আছে তখনো। ঘরে থেকে টর্চ নিয়ে আবার আগের জায়গায় ফিরে, আর চোখদু’টোকে দেখতে পায় না ওরা; ইতিমধ্যে, জঙ্গলের শব্দটাও থেমে যায় আস্তে আস্তে।

বেশ নিরাশ হয়েই দু’জনে ঘরে ফিরে আসে। ফেরার পথে দেখে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট-এর কুকুর গুলো এদিক ওদিক থেকে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে বেড়িয়ে আসছে আর কালো কুকুরটা উধাও।

রাতে আর কিছুক্ষণ কাজ করে, শুয়ে পড়ল সবাই। ঘড়িতে বাজছে তখন রাত দেড়টা। ক্লান্তি যথেষ্টই ছিল, তাই শুয়ে শুয়ে অন্যদিনের মত আর গল্প করা হল না ওদের। শুয়ে কয়েকবার এপাশ ওপাশ করতে করতেই ঘুম এসে গেল।         

 অসীমাভর ঘুম ভাঙল বেলা ন’টা লাগাদ। সুন্দর রোদ উঠেছে, শ্বেতাংশু তার পাশেই বসে আছে, তার ঘুম কাটেনি তখনো পুরোপুরি। আকমল তখনো নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। ঘরে মৈনাক নেই।

-“মৈনাক কোথায় গেল রে ?”

-“জানি না ভাই… আমি তো এই একটু আগে উঠলাম। উঠে থেকে দেখছি ছেলে ঘরে নেই…”

দু’জনে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বাইরে বেরিয়ে স্যারের কাছে জানতে পারে, মৈনাক একটু আগেই, রতনকে সঙ্গে নিয়ে বেড়িয়েছে।

-“কাল বলছিল না, ওর মেইল করার আছে… বলল একটু পরেই ফেরত চলে আসবে। তোরা তৈরী হ’ না… ও তো ব্রেকফাস্ট করেই বেরিয়েছে।”

শ্বেতাংশু আর অসীমাভ ঘরে ফিরে আসে, তৈরী হবে বলে…

<<———————– Read Previous Installment

সবাই কে জানাই ১লা বৈখাশের একাকিত্বের অভিনন্দন। ঘরে বসে বসে পড়ে ফেলুন; আজকের পর আর মাত্র তিনটি অধ্যায়, আর তার পরেই আপাতত উত্তরবঙ্গ কে বিদায় জানাতে হবে। গল্প শেষ হলে বাস্তবের সাথে যোগসূত্র কিছুটা টেনে দেব আমি; কিন্তু আমার হাত পা বাঁধা, কারণ গল্পের চরিত্রগুলোর আসল পরিচয় আমি গোপন রাখতে বাধ্য। কিন্তু দেখুন, শেষটা কেমন লাগে…

2 thoughts on “Somewhere In the Jungle of North Bengal… Part XV

Leave a comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.