“…যাবে তো যাও নীলপাহাড়ী,
সেথায় নড়ে সবুজ দাড়ি।
সেইখানেতে ঝাউ বাংলায়
(লেখা নেইকো বুড়ো আংলায়)
গান ধরেছে হাঁড়িচাঁচায়,
কুন্ডুমশাই মুন্ডু নাচায়।”
শ্রী ঝুমুরলাল চৌবে চক্রবর্তী
||৭||
-“খুব সোজা উত্তর… কালচারাল শক…”
-“কালচারাল শক ?”
-“তুই এর আগে, কখনো এরকম জঙ্গলে এসে রাত কাটিয়েছিস ? এত সমস্যার মধ্যে ?”
-“না স্যার…”
-“আসলে আমাদের মত শহুরে ভূতেরা সভ্যতার ছোঁয়ার বাইরে এলে অনেক সময়ই অপ্রাকৃতিক জিনিসপত্রের সম্মুখীন হয়ে থাকে… সেটাই কালচারাল শক। এ ব্যাপারটা আমি আগেও অনেকের মধ্যে দেখেছি; মনে হয় সব উল্টোপাল্টা হচ্ছে… দ্যাট ইনক্লুডস ভূত দেখা, এমনকি জঙ্গলে জন্তু জানোয়ার দেখা। তুই এখানে এসেছিস একটা অত্যন্ত ইমোশনালি ভালনারেবল স্টেট নিয়ে, তারপর লাগাতার ভূতের গল্প শোনা, আর এরকম একটা সুন্দর অথচ অবস্কিওর জায়গায় হঠাৎই রাত কাটানো… সব মিলিয়ে মনের মধ্যে একটা জগাখিচুড়ি তৈরী হচ্ছে তোর। তবে হ্যাঁ, জঙ্গলে কি একটা শব্দ পাচ্ছিলি বললি, সেটা আজ রাতে পেলে আমায় ডাকিস, শুনব।”
এ কথাটার কোনো উত্তর দিল না মৈনাক। ট্রেকার্স হাট-এর সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে সে এবং স্যার দু’জনে উদীয়মান সূর্য্যটার অপেক্ষা করছিল। আভাটা দেখা যাচ্ছে, শুধু সূয্যিমামার দেখা পাওয়ার দেরী। আস্তে আস্তে আলো ফুটছে, আর তার সাথে সাথে মনের কোণে দানা বাঁধতে থাকা সন্দেহ আর চাপা ভয়টা একটু একটু করে কর্পূরের মতই উবে যাচ্ছে যেন। ত্রৈলোক্যনাথ তো লিখেই গেছেন “জল জমিয়া যেমন বরফ হয়, তেমনি অন্ধকার জমিয়া ভূত হয়…” সারারাত সবাই একসাথে হাসিঠাট্টা, গান-বাজনা করার সময়ও সেই চেহারাটা ভাসছিল মৈনাকের চোখের সামনে; এক এক করে সবাই নিদ্রাদেবীর আরাধনায় মত্ত হলেও মৈনাক সারারাত হেডফোন লাগিয়ে গান শুনে কাটিয়েছে। সকালে স্যার ঘুম থেকে ওঠামাত্রই কথাটা বলা একদম ঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। স্যারের বদলে অসীমাভ বা শ্বেতাংশুকে বললে হয়তো হাসির খোরাক হতে হত। স্যারকে বলতেও একটু দোনামোনা হচ্ছিল, কিন্তু শেষমেষ বলে ফেলে আর স্যারের উত্তরে মনের মেঘটা কাটতে থাকে সহজেই।
-“আমাকে ডাকলি না কেন রে ?”
আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে এসে প্রশ্ন করে অসীমাভ। এর উত্তর স্যার বা মৈনাক দেওয়ার আগেই অসীমাভ সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে, তারপরই দৌড়ে ভেতরে ঢুকে যায় এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যামেরা নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসে। অসীমাভর ক্যামেরাতে খচ খচ করে শব্দ হতে শুরু করে। এক এক করে সবাই বেরিয়ে আসে। সূর্য্যোদয় দেখে, এবং চা পানের পর আবার রওনা হওয়া হয় লেপচাখা। রাতের ঘুম কারোর ভালো করে হয়নি ঠিকই, কিন্তু হাতের কাজটা সেরে ফেলে ঝাড়া হাত পা হওয়ার তাগিদে সবাই খুব তাড়াতাড়িই অনেকটা কাজ শেষ করে ফেলে। একদিনের কাজ নয়, তা ছাড়া লেপচাখা ছাড়াও ওদের অন্যদিকে যেতে হবে, জয়ন্তীর দিকেও কিছু জায়গা স্যার দেখিয়ে দিয়েছেন ম্যাপ-এ…
তারা দা ঠিকই বলেছিল, ওঠার চেয়ে নামতে সময় অনেকটাই কম লাগে। শুধু ফেরার পথে একবার ট্রেকার্স হাট-এ থামতে হয়েছিল আকমল আর চাপতে পারছিল না বলে। দুপুর দেড়টা নাগাদ ওরা সান্তালবাড়ি এসে হাজির হয়, জীপগুলো রাতে ফিরে গেলেও, সকালে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল, তাই লেপার্ডস নেস্ট-এ ফেরত যেতে সময় খুব একটা লাগে না। তারা দা সেদিনের মতো বিদায় নেয়। রতন কাঁদো কাঁদো মুখে এসে জানায়, একা হাতে চারটে কুকুর সামলানো তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না, ‘পরের বার যেন দাদা-দিদিরা কুত্তাগুলোকে লিয়ে যান’। আসলে তারাদাই বলে ওপরে কুকুর নিয়ে যাওয়াটা বিড়ম্বনা, তাই কুকুরগুলোকে রতনের জিম্মায় রেখে যাওয়া হয়েছিল। স্নান খাওয়া দাওয়ার পর অসীমাভ আর পল্লবীর খুব ইচ্ছা ছিল মেজারমেন্ট এর ডেটা নিয়ে বসার। এবং ল্যাপটপ খুলে দু’জনে বসেও ছিল; কিন্তু ক্লান্তি বাধ মানল না, বাকিদের মতো ওরা দুজনেও ঘুমিয়ে পড়ল।
বিকেলের মুখে আবার স্যার ডেকে তুললেন ওদের। আবার আগের দিনের মতো জোনাকি দর্শন করতে যাওয়া হল। এই দৃশ্যটা এমনই যে দিনের পর দিন, ঘন্টার পর ঘন্টা দেখলেও আশ মেটে না, একঘেয়েও লাগে না। সন্ধ্যের মুখে সবার একটু ইচ্ছে হয়েছিল আশেপাশে ঘুরে আসতে, কিন্তু স্যার এককথায় সেটা নাকচ করে দিলেন। তাই রিসর্টের এককালের লনে বসে তাস পিটিয়ে খাওয়া দাওয়া করে রাত ৯টা নাগাদ ঘরে গেল সবাই। দুপুরে ঘুমিয়ে পড়ার ফলে অসীমাভ এবার ডেটার কাজ নিয়ে বসতে বদ্ধ পরিকর। সে আর পল্লবী বিছানায় বসেছে ল্যাপটপ, মেজারমেন্ট চার্ট আর জিপিএস খুলে। শ্বেতাংশু আর মৈনাক পাশেই বসে ছিল, একটু দুরে বসে আকমল তার ব্যাগ হাঁতড়াচ্ছিল, আর দু-একবার মৃদু স্বরে ‘মুশকিল হল’ বলার পর একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে চুপ করে গেল। একটু বাদে একটা ঝাঁঝালো গন্ধের আবির্ভাবে বোঝা গেল, আকমল সুযোগ বুঝে কারনে মন দিয়েছে।
ঘড়িতে তখন ঠিক সাড়ে ন’টা; বাইরে জমাট অন্ধকার। কাজ করতে করতে বাইরের দিকে তাকাল মৈনাক। আজ কিসের যেন একটা অভাব মনে হচ্ছে বাইরে। কেমন একটা চাপা অস্বস্তি আবার যেন দানা বেঁধেছে মনের ভেতর। উঠে জানলার কাছে গেল মৈনাক। বাইরে তাকাল। একটা অদ্ভূত নিস্তব্ধতা চারদিকে। অন্যদিন কানে তালা ধরিয়ে দেওয়া ঘন্টিপোকাগুলো আজ একেবারে চুপ। হাওয়ার অভাবে জঙ্গলের, এমনকি রিসর্টের সীমানার মধ্যের গাছগুলোর পাতাও নিশ্চল। মৈনাক বাইরে যাওয়ার দরজার দিকে এগিয়ে গেল, আর দরজাটা খুলল। অসীমাভ আর শ্বেতাংশু সঙ্গে সঙ্গে মুখ তুলল;
-“কোথায় যাচ্ছিস ?”
-“একটু… পাঁচ মিনিট বাইরে থেকে ঘুরে আসছি…”
-“এখন ? বাইরে থেকে ?”
-“চিন্তা করিস না, রিসর্টের বাইরে যাব না, তাছাড়া চার চারটে গাব্দা কুকুর আছে বাইরে…”
অসীমাভ একটু আস্বস্ত হল বলে মনে হল।
-“তোরা বস, আমি ঘুরে আসছি, দরজাটা ভেজিয়ে গেলাম।”
দরজার থেকে বেরিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দু’পা এগিয়ে গেল মৈনাক। স্যারের ঘরে আলো নেভানো, মানে স্যার ঘুমিয়ে পড়েছেন। নিশ্চিন্ত হয়ে দু-তিনপা এগিয়ে তাদের কটেজের সীমানাটা পেরোনোর পরই সে থমকে গেল একটা জিনিস দেখে। একটা কুচকুচে কালো কুকুর। আকারে সাধারণ ভারতীয় কুকুরের থেকে একটু বড়ই, গায়ে ঘন অপরিচ্ছন্ন লোম ভর্তি। তাদের কুকুর গুলো কোথায় ? আর দু-এক পা এগোতে, বোধহয় পায়ের শব্দ পেয়েই কুকুরটা মুখ ফিরিয়ে তাকাল মৈনাকের দিকে। চোখদু’টো জ্বলজ্বল করছে আর জ্বলন্ত সেই চোখের পেছনে যেন একরাশ জীঘাংসা। মুখটা খোলা, শ্বদন্ত দুটো বেরিয়ে আছে। মৈনাকের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, এক পা পিছিয়ে গেল সে; কুকুরটা কিন্তু তার জায়গা থেকে নড়ল না, মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে আবার চুপ করে বসে রইল। মৈনাক যেন বুকে বল পেল একটু। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনেই নিজেকে বোঝাল,
“কিছু না… ওসব কিছু না… কালচারাল শক… আর কিছু না… জংলী কুকুর, তাই ওরকম বদখৎ দেখতে।”

চুপ করে আসতে আসতে সামনের দিকে এগিয়ে গেল, সত্যিই, কোনো হাওয়া নেই, কোনো শব্দ নেই, জঙ্গলের রাতের যে শব্দ সে গত তিনদিন ধরে শুনে এসেছে, সেটাকে কোনো অদৃশ্য বোতাম টিপে কে যেন মিউট করে দিয়েছে বেমালুম। দুটো জীপ যেখানে পার্ক করা আছে, সেখানে এগিয়ে যায় মৈনাক, আর এবার আর একটা অদ্ভূত দৃশ্য দেখতে পায়। দুটো জীপের মাঝখানের জায়গাটাতে একসাথে কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে চারটে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট-এর ট্রেনিং পাওয়া কুকুর, যাদের মধ্যে একটি নাকি একবার দিলীপবাবুকে লেপার্ডের হাত থেকে বাঁচিয়েছে। চারটে কুকুর পাতার মত কাঁপছে, থরথর করে, আর গলা থেকে একটা মৃদু ‘কুঁই কুঁই’ শব্দ বের করছে। মৈনাক পেছনে ঘুরে দেখল, কালো কুকুরটা এখনো পাথরের মূর্তির মতোই স্থির হয়ে বসে আছে। অজান্তেই মৈনাকের পা টা একটু কেঁপে গেল যেন…
কুকুরগুলো ওরকম করছে কেন ? কিসে ভয় পেয়েছে ?
এক পা এক পা করে জীপদুটো পেরিয়ে রিসর্টের সীমানার কাছে একটা উঁচু পাথরের ওপর বসল মৈনাক। খুব ঠাহর করে জঙ্গলের শব্দ শোনার চেষ্টা করল। কিন্তু না, সত্যিই… ঝিঁঝি, বাদুর, হাওয়া, গাছের পাতা… একটাও শব্দ নেই আজ। অন্ধকারের সাথে সাথে গোটা জঙ্গলটাকে কে যেন নিশ্তব্ধতার চাদরে মুড়ে ফেলেছে আজ।
মৈনাক যে পাথরটার ওপর বসে ছিল, সেটার ঠিক পাশেই একটা মরা চিলানি পাতার গাছ… মানে এখনো মরেনি, কিন্তু একটা একটা করে পাতা খসিয়ে একটু একটু করে রসকষহীন একটা কংকালে পরিণত হওয়ার দিকে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। গাছটার ডালগুলোর দিকে তাকিয়ে মৈনাক একটা অদ্ভূত জিনিস উপলব্ধি করল, তার মনে হল গোটা আকাশটা যেন একটু একটু করে তার মাথার ওপর নেমে আসছে। একটা অকল্পনীয় অনুভূতি আকাশ, বা আকাশের মতন বৃহদাকার একটা অজানা বস্তু যেন নেমে আসতে চাইছে তার মাথার ওপর, পিঠের ওপর। মৈনাক দ্রুত চোখ বন্ধ করে ফেলে, আর মুখটা নামিয়ে, জোরে জোরে মাথা নাড়তে বেশ জোরে জোরেই বলতে থাকে,
“না না… কালচারাল শক… না না… এসব কিছু হচ্ছে না… সব মনের ভূল… সব মনের ভূল… আমি স্ট্রেসড বলে সব কল্পনা করছি… সবটাই অলীক…”
আরও হয়তো কয়েকবার কথাটা বলত সে, কিন্তু হঠাৎ সমস্ত নিস্তব্ধতা খান খান করে ভেঙে দিয়ে একটা শব্দ শোনা যায়। একটা পায়ের শব্দ। মৈনাক চুপ করে যায়, চোখ খোলে আর শুনতে পায় একটা ভারী পায়ের শব্দ, তার পেছন দিক থেকে এগিয়ে আসছে। একটু একটু করে। মৈনাক ভয়ে পাথর হয়ে গেছে, তার পেছনে দেখার মতো সাহসটুকুও নেই… পায়ের শব্দটা খুব কাছে এসে পড়ল, একদম কাছে, এবার মৈনাকের হাতদূটোও একটু একটু কাঁপছে… কি হতে চলেছে এবার ?
যেটা হল, সেটাকে অনেক চেষ্টা করেও মৈনাক ভুলতে পারেনি। পায়ের শব্দটা তাকে পেরিয়ে সামনে চলে এল, আর তারপরই একটা ‘মচ’ শব্দে মৈনাকের সামনে পড়ে থাকা একরাশ পাতা গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিয়ে একটা অদৃশ্য পায়ের পাতা সমেত শব্দটা রিসর্টের সীমান পেড়িয়ে সামনের জঙ্গলে মিলিয়ে গেল, আর তারপরই জঙ্গলের ভেতর থেকে শুরু হল ঘ্যাঁষঘ্যাঁষে বিরক্তিকর সেই করাত ঘষার মত শব্দ।
কালচারাল শক ? বটে ?