সেই মুহূর্তে অদূরে সংকীর্ণ রাস্তার ওপারে একটি ভগ্নস্তূপ বলে যা মনে হয়েছিল তারই একটি জানালায় একটি আলোর ক্ষীণ রেখা আপনি হয়তো দেখতে পাবেন। সেই আলোর রেখা আড়াল করে একটি রহস্যময় ছায়ামূর্তি সেখানে এসে দাঁড়াবে। গভীর নিশীথ রাতে কে যে এই বাতায়নবর্তিনী, কেন যে তার চোখে ঘুম নেই আপনি ভাববার চেষ্টা করবেন, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারবেন না। খানিক বাদে মনে হবে সবই বুঝি আপনার চোখের ভ্রম। বাতায়ন থেকে সে-ছায়া সরে গেছে, আলোর ক্ষীণ রেখা গেছে মুছে। মনে হবে এই ধ্বংসপুরীর অতল নিদ্রা থেকে একটি স্বপ্নের বুদবুদ ক্ষণিকের জন্য জীবনের জগতে ভেসে উঠে আবার মিলিয়ে গেছে।
প্রেমেন্দ্র মিত্র
||৬||
প্রেমেন মিত্তির লিখে গেছেন, শনি ও মঙ্গলের যোগাযোগ ঘটলে, যে কোনো ব্যক্তিই তেলেনাপোতা আবিস্কার করে ফেলতে পারে। এখন ভাবলে, সেই বারটা শনি বা মঙ্গল ছিল কিনা, মনে পড়ে না মৈনাকের, কিন্তু সেদিন একটা কালো ফটক, যেটার ওপর বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে ‘বক্সা ফোর্ট’ সেটার সামনে দাঁড়িয়ে, মনে হয়েছিল বোধহয় সেই গপ্পোটার মধ্যেই ঢুকে পড়েছে সে।
ব্রিটিশ আমল থেকে ব্যবহার হওয়া ‘জেলখানা’-র অবস্থা এখন শোচনীয়। এক কালের নির্মম কয়েদঘর গুলো আজ জানলা-দরজাহীন গর্তগুলো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে; যেন নিজেই মুক্তির আনন্দে মত্ত। গায়ে ভরে ওঠা ছোটবড় ফাটল আর সেই ফাটলে বাসা বাঁধা বটগাছগুলোও যেন একটুও মনোবল ভাঙতে পারেনি তাদের। প্রধান ফটকের পরেই একটা স্মৃতিসৌধ, কিন্তু সেটার জরাজীর্ণ দশা দেখে মনে হচ্ছে হয়তো কিছুদিন পর, সেটার স্মৃতিতেই আর একটা সৌধ রচনা করতে হবে।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় তো লিখেই গেছেন ‘মেঘের গায়ে জেলখানা’… চারদিকে পাথর আর জঙ্গলে ঘেরা কেল্লাটার একটা আশ্চর্য্য সৌন্দর্য্য আছে, আর আস্তে আস্তে প্রকৃতি তার বেদখল সম্পত্তির অধিকার ফেরত নিচ্ছে একটু একটু করে, আর কয়েক বছর পড় হয়তো শুধু সবুজে ঢেকে যাবে এই গোটা এলাকা।
-“এখানে একটু বসে জিরিয়ে নাও। তবে যেখানেই বস বা দাঁড়াও, সাবধানে… বর্ষাকাল, সব জায়গায় জোঁক ভর্তি।”
কথাটা বলে তারাদা একটা উঁচু পাথরের চারপাশ ভালো করে দেখেশুনে, সেটার ওপর বসে আয়েসে আড়মোড়া ভেঙে একটা বিড়ি ধরালো।
পল্লবী এই ফাঁকে ম্যাপটা বের করে কিছু দেখে নিয়ে আবার সেটা গুছিয়ে রেখে অসীমের দিকে এগিয়ে গিয়ে কিছু একটা বলছিল, মৈনাক দুরে থাকায় ঠিক শুনতে পেল না। সে গুটি গুটি পায়ে তারাশঙ্করের দিকে এগিয়ে গেল।
-“তুমি কি এখানে রোজ আসো, তারা দা ?”
-“রোজ ? না না, তবে প্রায়শই আসি। এমনি টুরিস্ট তো থাকেই, তা ছাড়া…”
-“তা ছাড়া ?” -আবার প্রশ্ন করে মৈনাক।
-“তা ছাড়া… এখানে এসে আমার বসে থাকতে খুব ভালো লাগে… এই পাথরটার ওপর বসে থাকি অনেকক্ষণ ধরে… চুপ করে। আস্তে আস্তে অন্য সব শব্দ কানে সয়ে যায়, তখন চোখে লেগে থাকে এই সবুজ, এই পাহাড়… আর কানে শুধুই… পিন ড্রপ সাইলেন্স… তখন জানো তো, নিজের মনের শব্দ শুনতে পাওয়া যায়… সেই শব্দ যেন এই বক্সা ফোর্ট-এর ভাঙ্গা দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে… মানে, রেসোনেন্স তৈরী করে… ”
তারা দার পাশের একটা ছোট্ট পাথরে বসে পড়ে মৈনাক। মনে হয়, সে ও যদি তারাদার মতো রোজ রোজ এখানে এসে বসে থাকতে পারত…

-“বলছি, স্যার কি এখানে বসেই সন্ন্যাস নেবেন, না আমাদের একটু মেজারমেন্ট নিতে সাহায্য করে লেপচাখা রওনা দেওয়ার কাজটা তাড়াতাড়ি করবেন ?”
কোমরে দু’হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে প্রশ্নকর্তা অসীমাভ; পাশে কাঁচুমাচু মুখে আকমল।
-“না না, এই তো… যাচ্ছি…” বলে হন্তদন্ত হয়ে উঠে পড়ে মৈনাক। তারাশঙ্কর এবার বড় পাথরটার ওপর লম্বা হয়ে শোয়।
-“হ্যাঁ, বেশী দেরী কোর না… ফেরার সময় আলো থাকতে থাকতে ফোর্ট পেরোতে হবে… জায়গাটা ভালো না…”
-“কেন এখানে আবার কি আছে ?”
-“লেপার্ড আছে… আর ভূত…”
-“আবার ভূত ? তোমাদের এখানে তো চায়ের চেয়ে ভূত বেশী চাষ হয় দেখছি !!!”
-“আরে বাবা, পুরোনো ভাঙ্গা কেল্লা, তারপর ব্রিটিশ আমল থেকে কত লোক আটক থাকত… এখানে ভূত থাকবে না তো কোথায় ? ক’দিন তো থাকছ; জেনে যাবে কত ভ্যারাইটির ভূত আছে আশেপাশে…”
-“তাহলে তো বড় মুশকিল হল !!!”
এতক্ষণ অসীমাভ কথা বলছিল তারার সাথে, শেষ উত্তরটা দিল আকমল। সেটা শুনে অসীমাভ আকমলের দিকে এমন করে তাকাল, যেন ভষ্মই করে দেবে; আকমলও ভরকে গিয়ে, ‘ইয়ে, সরি ভাই…’ বলে মুখ নীচু করে ফেলে, যেন কত অপরাধ করে ফেলেছে। মৈনাক সেটা দেখে হেসে ফেলে, আর ওদের দু’জনের কাঁধে হাত দিয়ে ‘চল, কাজ শেষ করি’ গোছের একটা কথা বলে এগিয়ে যায়।
লেপচাখা পৌছোতে বেজে যায় প্রায় দুপুর তিনটে। ভূটান সীমান্তের কাছে, ছবির মতো এই ছোট্ট গ্রাম। ‘ডুয়ার্সের রাণী’ কথাটা যে অত্যুক্তি নয়, সেটা পাহাড়ের ওপর থেকে দুরে রুপোলী সাপের মতো এঁকেবেঁকে যাওয়া নদীগুলো দেখলেই মনে হয়। ভূটানে শেকড় গাঁথা ‘দ্রুকপা’ উপজাতির লোকেরাই এখানের বাসিন্দা। বক্সা ফোর্ট ছাড়ার পর থেকেই আকাশে কালো মেঘ একটু একটু করে জমাট বাঁধছিল; আর লেপচাখা পৌঁছোনোর পরপরই স্যার আশঙ্কিত চোখে তারাদা কে প্রশ্ন করেন
-“তারা, বৃষ্টি নামলে কি হবে ?”
-“চিন্তা করবেন না, স্যার। বৃষ্টি পড়লে তো সান্তালাবাড়ি ফেরা যাবে না, কিন্তু ফোর্ট পেরোতে হবে; ফোর্ট পেরিয়ে একটু গেলেই আমার খুড়তুতো ভাইয়ের হোম স্টে; ওর সাথে কথা বলাই আছে আমার। দরকার পড়লে রাত ওখানেই কাটানো যাবে।”
লেপচাখা পৌঁছেই যে তারাদার কথাটা সত্যি হয়ে যাবে, সেটা ভাবা যায়নি। যন্ত্রপাতি সাজিয়ে গুছিয়ে বসেছে কি বসেনি, আকাশের মেঘ গর্জন করে উঠল গম্ভীর স্বরে।
-“আরে তাড়াতাড়ি সব গুটাও… নিচে নামতে হবে, ফাস্ট, ফাস্ট…”
তারা দার কথায় সবাই সব গুছিয়ে দ্রুত নীচের পথে রওনা দেয়। যন্ত্রপাতি গুছিয়ে বক্সা ফোর্ট অবধি এসেই বৃষ্টির প্রথম ফোঁটাটা গায়ে পড়ে, খাড়াই রাস্তায় সাবধানে নামতে হচ্ছিল এমনিতেও, তবু, শেষরক্ষাটা হয়েই যায়। ট্রেকার্স হাট-এর বারান্দায় পৌঁছোনোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঝমঝম করে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমে আসে।
ট্রেকার্স হাট নামক এই হোম স্টের মালিক ইন্দ্রনাথ থাপা। তারাশঙ্করের ছোটকাকার ছেলে। হাসিখুশি লোকটি নিজে হাতেই মালপত্র তুলে ওদের ঘরে পৌছে দেয়। কাঠের ছোট্ট বাড়িটার দোতলার ঘরে মালপত্র রেখে, সেখানেই বসতে হয় ওদের। বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখার ইচ্ছে থাকলেও, তার দাপটের সামনে শরীরের একটা কণাও শুকনো থাকবে না; তাই ঘরে বসে হাবিজাবি কিছু কথা বলতে বলতেই ঘন্টাদুয়েক কাটতে হয়। তারপর বৃষ্টিটা ইলশেগুড়ির পর্যায় এলে, সবাই বেরিয়ে দাঁড়ায় বাইরের বারান্দায়। বেশ ঠান্ডা পড়েছে বাইরে। গরম জামাগুলো আবার গায়ে চাপাতে হয়ই। সন্ধ্যের অন্ধকার নেমেছে তখন। ঘন্টিপোকার দল তাদের সম্মিলিত কোরাস শুরু করেছে কিছুক্ষণ। ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে ঠিক ৬-১৫। আজ নিচে নামার আশা ত্যাগ করে এখানেই কাটাতে হবে রাতটা।
সারাদিনের ক্লান্তির পর তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়াটাই যুক্তিযুক্ত; তাই ৮টা বাজতে না বাজতেই, একতলায় চারদিক খোলা, মাথায় ছাদ দেওয়া একটা কাঠের টেবলে খেতে বসে সবাই। আর তার সাথেই বৃষ্টির পুনরাগমন ঘটে। টিমটিমে সোলার আলোর নিচে বসে রুটি আর কষা মাংস গলাধঃকরণ চলছিল; একটু পরে বসবে বলে বাইরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল শ্বেতাংশু আর মৈনাক। শ্বেতাংশু গান ধরেছিল;
“আমিও একাকি, তুমিও একাকি… আজি এ বাদল রাতে…”
গানের সুরে আবার একটু একটু করে মৈনাকের চোখের কোলটা ভিজে উঠছিল। সেটা লুকোতেই, একবার হাই তোলার ভান করে চোখটা বুজে, আবার খুলে ফেলল সে। তারপর সামনের দিকে তাকিয়ে, আবার সে দেখতে পেল, আবছা আলোয় একটা মানুষের অবয়ব, আর জ্বলন্ত দুটো চোখ…
“কাঁদিছে রজনী তোমার লাগিয়া, স্বজনী তোমার জাগিয়া…”
মৈনাক চোখের পাতা ফেলারও সাহস পাচ্ছে না… দুরে এক বাজ পড়ল… আর সেটার হালকা আলোয় আবার স্পষ্ট হয়ে উঠল একটা মানুষের বহিরাকৃতি। জ্বলন্ত চোখদুটোও নড়ছে না, যেন মৈনাকের দিকেই স্থির হয়ে আছে… লোকটাও যেন পাথরের মত স্থির…
“এ জীবন-ভার, হয়েছে অবহ- সঁপিব তোমার হাতে…”
কড়কড় শব্দে প্রচন্ড জোরে কাছেই কোথাও একটা বাজ পড়ল। পেছন থেকে একটা সম্মিলিত মেয়েলি গলায় আতঙ্কের আভাষ শোনা গেল। এক মূহুর্তের জন্য চোখ বন্ধ করেছিল মৈনাক। চোখ খুলেই দেখল, সামনে জমাট অন্ধকার ছাড়া কিছুই নেই; নেই কোন জ্বলন্ত চোখ, নেই কোনো ছায়ামূর্তি…
“বঁধূয়া… নীদ নাহি আঁখি পাতে…”
আজ সত্যি, একফোঁটা ঘুম আসবে না, মৈনাকের চোখে…
কি মনে হচ্ছে ? মৈনাক কি বার বার ভুল দেখছে ? নাকি সত্যিই এর পেছনে আছে কোনো অশুভ শক্তি ? ফলবে মশাই, ফলবে… মেওয়া ঠিকই ফলবে…
শান্তির আশায়…
নীল…
খুব নতুনত্ব লাগলো চিন্তা ভাবনা টা ।
LikeLiked by 1 person
খুব নতুনত্ব লাগলো চিন্তা ভাবনা টা । কিন্তু এতো কিছু লেখার উদাহরণ দিয়ে কি বলতে চাওয়া হচ্ছে বুঝলাম না ।
LikeLiked by 1 person
Pingback: Somewhere In the Jungle of North Bengal… Part VII – Libberish
Nice read
LikeLiked by 1 person
Thank you… I hope you’ve read the entire series…
LikeLike