“আলোও নয়, অমাও নয়, যায় যে দেখা
আজও নয়, কালও নয়, ভাগ্যে লেখা…”
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
||৮||
যদি পারত, তাহলে নিজের স্নায়ুর পিঠ চাপড়ে একবার বাহবা দিত মৈনাক। কিন্তু এই কাজটা করতে সে অপারক। এখন ভরসার কথা হল, ঘ্যাসঘ্যাসে শব্দটার সাথে সাথে, বাতাবরণের বাকি শব্দগুলোও ফেরত এসেছে, আর একটু আগের ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার পড়েও, ঘাড়ে চেপে বসা অস্বস্তিটা যেন নেমে গেছে।
-“শব্দটা কোনদিক থেকে আসছে, বুঝতে পারছিস ?”
পেছন থেকে অসীমাভর গলার স্বরে চমকে ওঠে সে, সেটা লক্ষ্য করে অসীমাভ বলে,
-“অমন করছিস কেন ? ভূত দেখলি নাকি ?”
-“অ্যাঁ ! না না, আরে; হঠাৎ ডাকলি, তাই চমকে গেলাম… ঠিক বুঝতে পারছি না, রে… মনে হচ্ছে ওইখানে।”
এই বলে সে জঙ্গলের একটা জায়গা নির্দেশ করে দেয় আন্দাজে।
সে দিকে তাকিয়ে একটু দেখে অসীমাভ, কি যেন একটা ভাবে। তারপর বলে,
-“দাঁড়া, স্যারকে তুলি; শ্বেতাংশুকেও ডাকি।”
-“চল, আমিও যাচ্ছি, স্যার আমাদের বাইরে দেখলে আবার…”
এই বলে অসীমাভর সাথে মৈনাকও উঠে চলে যায় ভেতরের দিকে হাতদুটো এখনো কাঁপছে; সেটা লোকানোর যথাসম্ভব চেষ্টা করে। কটেজের দিকে ফিরেই লক্ষ্য করে মৈনাক, কালো কুকুরটা উধাও; আর একটু আগে ভয়ে কাঁপতে থাকা কুকুরগুলো দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেন কিছুই হয়নি এতক্ষণ। মৈনাক তখনো একটা ঘোরের মধ্যে আছে। কি হল একটু আগে ? কি দেখল সে ? সবই কি দৃষ্টিবিভ্রম ? সত্যিই কি শহুরে সভ্যতা থেকে এত দুরে আসার ফলে তার মস্তিষ্ক তার সাথে একটা নোংরা রসিকতা করছে ? এগুলো মাথার মধ্যে চলতে চলতেই দু’জনে স্যারের ঘরের দরজায় এসে পড়ল। কলিং বেল একটা থাকলেও সেটা অকেজো, আর তাই দরজায় টোকা দিতে হল অগত্যা। স্যারের ঘুম বেশ পাতলা, তাই দ্বিতীয় টোকা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্যার উঠে এসে দরজা খুললেন।
-“কি হল রে ?”
-“শব্দটা আবার পাওয়া যাচ্ছে, স্যার। সেই করাত ঘষার মতো শব্দটা…”
স্যার একটু মন দিয়ে কিছু শুনলেন, এবং শব্দটা যে পেলেন, সেটা বোঝা গেল ওনার কথায়।
-“হুম। দাঁড়া, চশমাটা পড়ে আসি।”
এই বলে স্যার ঘরে ফেরত গিয়ে চশমা আর দিলীপ বাবুর দেওয়া একটা টর্চ নিয়ে বেরিয়ে এলেন। তিনজনে হাঁটতে হাঁটতে সেই পাথরটার দিকে যাচ্ছিল, এমন সময় ঘরে থেকে বেরিয়ে এল শ্বেতাংশু।
-“স্যার, পেলেন শব্দটা ?”
-“হ্যাঁ, চলতো দেখি…”
পাথরের কাছে গিয়ে অনেকক্ষণ জঙ্গলে আলো ফেলে সবাই মিলে পর্যবেক্ষণ করেও শব্দের কোনো উৎস পাওয়া গেল না। কানের আন্দাজ যেখানে বলছে, আলো সেখানে দেখাচ্ছে শুধুই দূর্ভেদ্য জঙ্গল। বেশ কিছুক্ষণ তবু দেখার চেষ্টা করে স্যার বললেন,
-“নাহ, কিছুই দেখা যাচ্ছে না এই অন্ধকারে। চল চল, শুয়ে পড়ি; কাল দিলীপবাবু কে বলা যাবেখন…”
-“কিসের শব্দ হতে পারে ওটা, স্যার ?”
-“সে আমি কি করে বলব ? তবে যা মনে হচ্ছে, এখানে তো চোরাগোপ্তা গাছ কাটা হয়ে থাকে, হয়তো সেরকমই কিছু…”
-“একবার একটু ভেতরে গিয়ে দেখলে হয় না ?”
-“দেখ অসীম, সাহস আর বোকামীর পার্থক্যটা তুই এখনো শিখলি না; মাতব্বরীটা একটু কম কর, আর গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে দয়া করে আমাকে উদ্ধার কর তোরা…”
এ কথাই অসীম আর কোনো উত্তর দেওয়ার সাহস পায় না। ঘরে ফিরে গিয়ে দেখে আকমল রীতিমত নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে, আর পল্লবী একমনে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে। ওদের ঘরে ঢুকতে দেখে বলল,
-“যাক এলি ? আমি শুতে গেলাম। অসীম, এখানে ডেটাশিটটা রইল। শুধু কো-অর্ডিনেট বসানো বাকি আছে, কাল সকালে বসাতে হবে। আর স্যাম্পলগুলো অ্যারেঞ্জ করতে হবে সেইমত। স্যার কি বললেন ?”
ব্যাপারটা এবার মৈনাকই বুঝিয়ে বলে। তার উত্তরে পল্লবী বলে ওঠে,
-“হ্যাঁ দিলীপবাবুকে বলাটাই বেটার। উনি জানবেন এসব কিভাবে হ্যান্ডল করতে হয়।”
পল্লবী মেয়েদের ঘরে চলে গেলে ল্যাপটপ আর যন্ত্রপাতি গুছিয়ে অসীমাভর চোখ পড়ে আকমলের দিকে।
-“কি খেয়েছে ভাই এ ? এ তো কুম্ভকর্ণের বাবাকেও টেক্কা দিয়ে দেবে !”
এই বলে সে আকমলের ব্যাগ হাতড়ে মদের বোতলটা বের করে। আর প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে,
-“মানে, লোকে কতবড় চামার হলে এত সস্তার হুইস্কি কিনে খেতে পারে ?”
শ্বেতাংশু বিদ্রুপ করে বলে ওঠে,
-“সবাই কি আর তোর মত ‘অকেশনালি’ সিঙ্গেল মল্ট খায় রে ?”
-“তুই থাম ভাই। আমাদের বাড়ির পাশের রিক্সাওয়ালাগুলো এর থেকে দামী খায়… ইসসস এবার সারারাত ওর পাশে শুয়ে আমাকে কাটাতে হবে। মালটা বডি স্প্রেও বোধহয় আনেনি।”

মুখটা বিকৃত করে আকমলের পাশে শুয়ে পড়ে অসীমাভ। তার পাশে শ্বেতাংশু, আর সবার শেষে মৈনাক। আজ বেশ ঠান্ডা আছে, তাই পাতলা কম্বলগুলো গায়ে টেনে নেয় সবাই। গলা অবধি কম্বল টেনে নিয়ে শুয়ে পড়ে, মৈনাক বলে ওঠে,
-“ভাই…”
-“বলে ফেল…” -অসীমাভ উত্তর দেয়।
-“তোরা কেউ ভূত দেখেছিস ? মানে ভূতে বিশ্বাস করিস ?”
-“ভূত দেখা আর বিশ্বাস করাটা কি আলাদা জিনিস নয় ?” – শ্বেতাংশু বলে ওঠে।
-“ইউ গেট মাই পয়েন্ট। বল না, ভূতে বিশ্বাস করিস ?”
-“না…” উত্তরটা দিয়ে অসীমাভ উল্টো পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে।
-“দেখিনি, তাই বিশ্বাস করিনা ভাই… দেখিনি বলে ভগবান, ভূত কিছুই মানি না, দেখতে পেলে সবই মানব…” – বলে ওঠে শ্বেতাংশু।
-“হুম…” বলে চুপ করে যায় মৈনাক। কিছুক্ষণ এই নীরবতা থাকার পর, হঠাৎ অসীম লাফিয়ে উঠে বসে পড়ে।
-“ওয়েট আ মিনিট… হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন ? এই মই…”
-“না কিছু না…”
-“কিছু না মানে ? তারাদা আর রামদার মুখে ভূতের গপ্পো শুনে, তুই কি ভূতে বিশ্বাস করতে শুরু করলি নাকি ?”
-“আরে না রে… মানে চারপাশের যা পরিবেশ, তাতে বেশ ভূতের গল্প জমে কিনা… তাই আরকি।”
-“কথা ঘোরাস না… কি হয়েছে বলবি ?”
শ্বেতাংশু এতক্ষণ চুপ ছিল সেও আস্তে আস্তে উঠে বসে বলে উঠল,
-“দাঁড়া, দাঁড়া… তুই কি ভূত দেখলি নাকি ভাই ?”
-“জানি না… আশপাশের পরিবেশটা বড্ড… মানে হন্টিং… রাত্রিবেলা কেমন অস্বস্তি লাগে… কেমন যেন মনে হয় চারপাশ থেকে কে যেন দেখছে… নজর রাখছে, আড়াল থেকে…”
-“দেখ জঙ্গল তো, কোলকাতা শহর তো নয়… এখন দিনরাত গাড়ির চ্যাঁ ভ্যাঁ আর ‘নিয়ন আলোয় আলোকিত যত রেস্তরাঁ’ ছেড়ে এলে, নিজেকে আউট অফ প্লেস তো মনেই হবে, তাই না ?”
অসীমাভর কথার উত্তরে শ্বেতাংশু বলে ওঠে,
-“আহা ! কেয়াবাৎ, কেয়াবাৎ…” আর তারপরই সে সুর করে গান ধরে,
“কি আছে আর… গভীর রাতের নিয়ন আলোয় আলোকিত যত রেস্তরাঁ…
সব থেকে উঁচু ফ্ল্যাটবাড়িটার, সব থেক উঁচু ছাদ…
তোমায় দিলাম আজ…”
এর উত্তরে, মৈনাকও একটু না হেসে পারে না…
তারপরই অন্ধকার ঘরের ভেতর থেকে বেসুরো অসীমাভ, আধাসুরো মৈনাক আর সুরেলা শ্বেতাংশুর একত্রে তার সপ্তকে চিৎকার শোনা যায়,
“তোমায় দিলাম… তোমায় দিলাম… তোমায় দিলাম…”
সে স্বরের দাপটে, পাশের ঘর থেকে ততধিক জোরে একবার ‘হায় দাইয়া’ শোনা যায়, আর অনুপ্রিয়া উঠে এসে ‘দিস ইজ টুমাচ গাইজ’ বলে আবার দুম দুম করে পা ফেলে ঘরে ফিরে যায়। কিন্তু এত হট্টগোলের মধ্যেও, আকমল অবিচল। অনুপ্রিয়া চলে যাওয়ার পর, বেশ কিছুক্ষণ হাসাহাসি করতে করতে তিন স্যাঙাতে ঘুমিয়ে পড়ে।
সকালে ওদের ঘুম থেকে উঠতে আজ বেশ দেরী হয় ওদের। আজ সার্ভের কাজ নেই, কিন্তু অন্য কাজ আছে; প্রথমত আগের দিনের ডেটাগুলোর কাজ শেষ করা আর স্যার আবার লেপচাখা কবে, কিভাবে যাওয়া হবে, লেপচাখা ছাড়া আর কোথায় যাওয়া হবে, সেসব প্ল্যান তৈরী করা। ঘুম থেকে উঠে দেখে, বাইরে বসে দিলীপবাবু আর স্যার গম্ভীর মুখে কিছু আলোচনা করছেন।
-“খুবই সম্ভব। পোচার আর এই বেআইনি লাম্বার… এই নিয়েই তো দিন কাটে মশাই। তা আমি একটা ওয়াচ পার্টি তৈরী করছি; আজই রাত থেকে শুরু করতে হবে…”
আলোচনা কি নিয়ে হচ্ছিল, বোঝা যায়। অসীমাভদের আসতে দেখে, দিলীপবাবু একগাল হেসে বলে ওঠেন-
-“এই যে, গুড স্যামারিটান্স… ঘুম হল ? ব্যাপারটা রিপোর্ট করতে আমার সুবিধা হল… পাহারা বসাতে পারব। যাক গে, তোমরা বস, আমি উঠি… তারা একটু পড়েই আসছে…”
ভদ্রলোক বেরিয়ে যান। প্রাতরাশ করতে করতেই তারাশঙ্কর এসে হাজির হয়। লেপচাখার কাজ শেষ করতে আরো তিনদিন লাগবে, তাই কাল আবার লেপচাখা যাওয়া হবে বলে ঠিক হয়। এ ছাড়া, সাখাম আর জয়ন্তীর দিকে কিছু সার্ভে এবং এক্সক্যাভেশন করতে যেতে হবে বলে ঠিক হয়। এসব কথা শেষ হলে অসীমাভ বলে ওঠে,
-“তারা দা, আজ তো আমরা সন্ধ্যের দিকে খালি। একটু কোথাও ঘুরতে গেলে হয় না ?”
-“কোথায় যাবে বল ? জঙ্গলে ঘুরতে ?”
-“হ্যাঁ, যদি সম্ভব হয়…”
এবার একটু রহস্যময় হাসি হেসে তারাশঙ্কর বলে ওঠে,
-“খুনিয়ার জঙ্গলে যাবে নাকি ?”
অসীমাভ সমেত সবাই চমকে ওঠে…
-“যাওয়া যায় নাকি ?”
-“কেন যাবে না ? চল… আজ তো আর পূর্ণিমা নয়, তাছাড়া, আমি সঙ্গে থাকব, জীপে করে যাব, চিন্তার কোনো কারণই নেই। স্যার যাবেন তো ?”
-“ব্যাপারটা কি সেফ হবে ?”
-“আরে বাবা, আমি গ্যারান্টি নিচ্ছি তো… এরা আমার ছোট ছোট ভাইবোনের মতো; আপনি চিন্তা করছেন কেন ?”
-“না না, চিন্তা করিনি… আর আমি তো যাবই; দায়িত্ব নিয়ে এসেছি যখন, বাচ্চা বাচ্চা ছেলেপুলেগুলোকে কি একা ছেড়ে দেব নাকি ? বেশ, তুমি যখন বলছ, তখন তাই হোক…”
অনুপ্রিয়া একটু আপত্তি করছিল, কিন্তু পল্লবী ওকে থামিয়ে দেয়। স্যার এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে বলেন,
-“বেশ, হাতের কাজকর্ম শেষ করে ফেল সারাদিনে, অরণ্যের দিন যখন দেখা হল, এবার রাত্রিটাও দেখে আসি…”
কাল লিখতে না পারার জন্য দুঃখিত। আজ অষ্টম আর কাল দোলযাত্রা এবং হোলিকা দহন উপলক্ষ্যে নবম পর্ব প্রকাশিত হবে…
বেশ ভালো…
LikeLike
Pingback: Somewhere In the Jungle of North Bengal… Part IX – Libberish