“There are events in one’s life which, no matter how remote, never fade from memory”
Jim Corbett
||৫||
-“কাঠে করাত ঘষার শব্দ বলছিস ? তুই শিওর তো ?” – প্রশ্ন করেন স্যার।
-“হ্যাঁ স্যার… আমি বেশ কিছুক্ষণ শোনার পর তবে তো শ্বেত আর অসীমকে ঘুম থেকে তুললাম, ওদেরও সেরকমই মনে হয়েছে।“ – মৈনাকের কথায় মাথা নেড়ে সায় দেয় বাকী দুজন।
-“ঠিক আছে, আজ রাতে আমিও একটু অবজার্ভ করি, তারপর নাহয় বেগতিক বুঝলে দিলীপ বাবুকে বলা যাবে… এখনই ওনাকে ব্যতিব্যস্ত করার দরকার আছে বলে তো মনে হয় না।”
ওরা মাথা নেড়ে সায় দিয়ে জিনিসপত্র গুছিয়ে তৈরী হতে যায়। ভোর পাঁচটা থেকে উঠে সার্ভে এবং ট্রেক-এর জন্য প্রস্তুতি চলছিল, আর তারই মাঝে ফাঁক পেয়ে মৈনাক রাত্রের ঘটনার কথা স্যার কে জানায়। পল্লবী ম্যাপের কাজ ইতিমধ্যেই সেরে ফেলেছে, তার ব্যাগও রাত থেকেই গোছানো শেষ। সে সক্কাল সক্কাল উঠে স্নানাদি সেরে সমীরা এবং অনুপ্রিয়ার পেছনে পড়ে রয়েছে তাদের তুলে তৈরী করার জন্য।
মৈনাকরা শুয়েছে বেশ রাত্রে। শ্বেতাংশু আর অসীমাভকে ঘুম থেকে তোলার পর, তারা অনেকক্ষণ জঙ্গলের শব্দটা শুনেছে, অসীমাভর ইচ্ছে করছিল একবার বাইরে বেরিয়ে দেখে আসে, কিন্তু শ্বেতাংশু আর মৈনাক দু’জনেই তাকে বারণ করে। তাই একটু বিরক্ত হয়েই সে শুয়ে পড়ে, এবং ঘুমিয়েও পড়ে। একটু বাদে তার সঙ্গী হয় বাকী দুই জন। অজানা জায়গায় এলে, মৈনাকের ঘুম তাড়াতাড়ি ভেঙে যায়। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সে ভোরবেলা উঠে আবার বাকী দু’জনকে ওঠায় এবং সবাই তৈরী হয়ে তবেই কুম্ভকর্ণের অবতার আকমলকে টেনে তোলে।
আকমল ছাড়া সবাই তৈরী হয়ে গেছে, ঘড়িতে বাজছে ঠিক সওয়া সাতটা। তখনই জীপে করে এসে হাজীর হয় তারাশঙ্কর। সে আসা মাত্রই, পল্লবী তার বিশাল ম্যাপটা খুলে এগিয়ে আসে।
-“তারা দা, লেপচাখা অবধি আমাদের যেতে হবে। তার মাঝে রাস্তায় স্পট কিছু আমরা দেখে নেব, কিন্তু আজ লেপচাখা পৌছোতে পারলে অনেকটা কাজ একধাপে এগিয়ে যাবে…”
-“দেখো বোন, লেপচাখা এমন কিছু কঠিন ট্রেক নয়। তোমরা যদি একটু পেস ধরে চলতে পার; তো খুব বেশী হলে চার ঘন্টায় লেপচাখা পৌছে যাওয়া কোনো ব্যাপার নয়। এবার বাকী তোমাদের কাজের ওপর নির্ভর করছে।”
-“মানে যাতায়াতে আট ঘন্টা। তাহলে তো সন্ধ্যের মধ্যে ফিরে আসা যাবে বলে মনে হয়…”
-“নামার সময় তো কম টাইম লাগবে… তোমরা আগে ওঠো তো… তারপর দায়িত্ব আমার।”

পল্লবী হাসিমুখে ম্যাপ গুটিয়ে জীপে উঠে বসে। সঙ্গে ওঠে অনুপ্রিয়া আর সমীরা আর স্যার। আর একটা জীপে উঠবে চারটি ছেলে। কিন্তু তাদের সারাশব্দ না পেয়ে স্যার একবার মৈনাকের নাম ধরে হাঁক দিতে অসীমাভ ঘরের দিক থেকে উত্তর দেয় ‘যাই স্যার !’ আর তার প্রায় ১০ মিনিট পরে তিনজনে আকমলকে একরকম টেনে হিঁচড়ে এনে জীপে তোলে। আকমলও প্রতিবাদ জানিয়ে বলতে থাকে;
-“কি মুশকিল ! আরে সকাল সকাল না হলে আমার সারাদিন খুব মুশকিল হয়, ভাই…”
-“মুশকিল হলে তখন দেখা যাবে… টানা দু’ঘন্টা ধরে হেগেই চলেছে, হেগেই চলেছে যেন চৈত্র সেল লেগেছে…”
কথাটা শুনে স্যার, আর তারাদা বেশ জোরে হেসে ফেলেন। পল্লবী মুখ টিপে হাসে, আর অনুপ্রিয়া মুখটা ব্যাজার করে ঘুরিয়ে নেয়। দুটো জীপ ওদের সান্তালাবাড়ির নির্দিষ্ট স্থানে ছেড়ে আসে, যেখান থেকে বক্সা দুয়ার/লেপচাখা যাওয়ার রাস্তা শুরু হচ্ছে। জীপগুলো ওদের জন্যই অপেক্ষা করবে; আকাশ একটু মেঘলা, তাই বৃষ্টি শুরু হলে ওরা অগত্যা আবার লেপার্ডস নেস্ট-এই ফিরে যাবে। ওপর থেকে তো আর ফোন পাওয়া যাবে না।
এবার পায়ে হাঁটা রাস্তা ধরে ওরা চলা শুরু করে। সান্তালাবাড়ি থেকে বক্সা দুয়ারের জনপদ প্রায় দু থেকে আড়াই ঘন্টার রাস্তা। সেখান থেকে বক্সা ফোর্ট হয়ে যেতে হয় লেপচাখা। ব্রিটিশ আমলে, আন্দামান-এর পর, বক্সা ফোর্টই ছিল বহুল ব্যবহূত একটি জেলখানা। তবে এখন শুধু সরকারী দেখভালের অভাবেই, সেই দূর্গ ভেঙ্গেচুরে একাক্কার হয়ে পড়ে আছে। রাস্তা লম্বা, কিন্তু অনেকাংশই বাঁধানো, তাই দু’দিন আগের বৃষ্টির পড়েও সেরকম পেছল নয়। সবার সামনে চলেছে তারাশঙ্কর, তারপর বাকী সাতজন জটলা করতে করতে, আর সবার পেছনে স্যার।
-“আচ্ছা তারা দা, নাম তো বক্সা টাইগার রিজার্ভ; আদৌ বাঘ আছে ?” প্রশ্ন করে মৈনাক।
-“বাঘ, মানে বেঙ্গল টাইগার ? সরকারী হিসেব তো বলছে আছে, কিন্তু আমি শেষ চোখে দেখেছি পাঁচ বছর আগে। তবে লেপার্ড আছে বিলক্ষণ; ভূরি ভূরি আছে। আমি তো দিন চারেক আগে ওই বক্সা ফোর্টেই লেপার্ড দেখেছি…”
এমন সময় পেছন থেকে একটা ঝগড়ার শব্দ শোনা যায়; সেদিকে তাকিয়ে এগিয়ে যায় সবাই। অনুপ্রিয়া বেশ বিরক্ত মুখে কিছু একটা বলছে, আর বার বার মাথা নাড়ছে;
-“না না না, আমার এখানেই একটা পিট স্টপ দরকার… একটানা ১ ঘন্টা হেঁটেছি আমি… এত খাড়াই… দিস ইস টু মাচ…”
পল্লবী অবাক হয়ে বলে ওঠে,
-“এক ঘন্টা ? ১০ মিনিটও তো হয়নি এখনো… ওই দেখ নিচের দিকে তাকালে জিপগুলো দেখা যাচ্ছে…”
-“দেখ পলু, সোজা রাস্তা আর পাহাড়ের রাস্তার অনেক তফাত, ও কে ? আর আমার হিমোগ্লোবিন কম, সহজেই হাইপক্সিয়া হয়ে যায়।”
-“লক্ষ্মী ভাই আমার আর একটু চল, এত সহজে আর এত ব্রেক নিলে প্রচুর সময় নষ্ট হয়ে যাবে…”
-“আমি পারছি না, ও কে ? এখানেই যদি সব এনার্জি শেষ হয়ে যায়, তাহলে ওপরে সার্ভের সময় আই’ল বি এক্সজস্টেড… আমি একটু বসছি…”
এই বলে অনুপ্রিয়া পথের ধারের একটা পাথরের ওপর বসতে গেল, তারা দা রে রে করে তেড়ে এসেও, অনুপ্রিয়াকে বসা থেকে নিরস্ত করতে পারল না; আর তারপরই, পাথরটা ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ভেঙে রাস্তার ধারে হাত পা ছড়িয়ে চিৎপাত হল সে। আর তারপরই তারাদার কথাটা সে সহ সকলের বোধগম্য হল…
-“বোসো না বোন, বোসো না… ওটা পাথর নয়, উই ঢিবি !!!”
কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে, অনুপ্রিয়াকে তাড়াতাড়ি টেনে তুলেছে পল্লবী, আর আর তার জিন্স-এ ভর্তি হয়ে রয়েছে ভেজা কাদামাটি আর থিক থিক করছে উই।
-“ওয়াক ! ইস… ও মা গো !!!”
অনুপ্রিয়া হাত পা ছুঁড়ে লাফাতে থাকে, শ্বেতাংশু আর অসীমাভ হাসতে হাসতে এ ওর গায়ে ঢলে পড়ে; মৈনাক, তারা, পল্লবী আর স্যার মিলে অনুপ্রিয়া কে ঠান্ডা করে, ঝেড়ে, একগাদা টিস্যুর শ্রাদ্ধ করে একটা ভদ্র অবস্থায় নিয়ে আসে… এমন সময় শ্বেতাংশু আবার বলে ওঠে,
-“এই অসীম, বাল্মিকীর স্ত্রীলিঙ্গ কি রে ?”
এই কথা শুনে এবার সবাই আবার বেদম হাসতে শুরু করে, এক অনুপ্রিয়া ছাড়া, সে বেশ কাঁদো কাঁদো মুখে রাগত স্বরে বলে ওঠে,
-“দিস ইজ নট ফানি, গাইজ… নট এট অল…”
অসীমাভ গম্ভীর মুখে বলে ওঠে,
-“একদম না… তুই অতগুলো বেচারা উইকে বাস্তুহারা করে দিলি, সেটা মোটেও ফানি না… এখন ওরা মামলা করলে সামলাবে কে ?”
অনুপ্রিয়া এর উত্তরে রেগেমেগে গট গট করে হাঁটতে থাকে, বাকিরা তার পিছু নেয়, তখনো সবার মুখে লেগে রয়েছে হাসি।
আকাশে মেঘ বাড়ছে, না ওপরে ওঠার দরুন সবার মেঘের কাছাকাছি চলে আসছে, সেটা অনভিজ্ঞ চোখকে ধোঁকা দিতেই পারে; কিন্তু একটু একটু করে যে আকাশে মেঘ ঘন হচ্ছে, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই একেবারেই। বক্সার রাস্তায় যারা গেছেন, তারা জানেন, এই জনপদে এখনো নগরসভ্যতা পৌছোয় নি, আর তাই হোম স্টে-ই যাত্রীদের থাকার একমাত্র উপায়। ট্রেকের রাস্তাটা বেশী খাড়াই ও না, এবং দৃশ্যপট অত্যন্ত উপভোগ্য। মেঘের চাদর সরিয়ে রঙ্গমঞ্চের সজ্জার মতোই বক্সা দুয়ার একটু একটু করে নিজেকে মেলে ধরছিল। রাস্তার পাশে, নীচের ঘন জঙ্গল থেকে ধোঁয়ার একটা কুন্ডলী আস্তে আস্তে উঠে মেঘের মধ্যে মিশে গেছে।

-“ভাই… বড় মুশকিল হল… বলছি এখানে সাইডে কোথাও বসা যাবে ?” কাঁচুমাচু মুখে প্রশ্ন করল আকমল।
-“না, এখানে হবে না, ওপরে উঠে…”
-“না ভাই… মুশকিল হয়ে যাবে… কাপড় চোপড়ে একাক্কার হয়ে যাবে পুরো…”
শ্বেতাংশু হেসে ফেলে, অসীমাভ বেশ বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে;
-“এ তো শালা আচ্ছা জ্বালা হল… একজন পাঁচ মিনিট অন্তর অন্তর বসতে চায়, একজনের ঘন্টায় ঘন্টায় হাগা পায়… এদের নিয়ে কোন ভদ্দরলোকে সার্ভেতে আসে ?”
-“আমি সক্কালবেলাতেই বলেছিলাম, আমায় এখন শান্তিতে করতে না দিলে পরে মুশকিল হবে; তখন তো শুনলি না…”
অসীমাভ আর কথা না বাড়িয়ে তারাশঙ্কর কে হাঁক দেয়…
-“ও তারা দা… এখানে একটা ঝোপঝাড়ের আবডাল হবে ?”
তারা দা ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে আসে, আর বোঝানোর চেষ্টা করে আর আধঘন্টাটাক হাঁটলেই লোকালয়, সেই টুকু সময় একটু সংযমরক্ষাই শ্রেয়। কিন্তু আকমল নাছোড়বান্দা, অগত্যা পাথর আর গাছের একটা আড়ালে একটা জায়গা দেখিয়ে দিল তারা দা, আর আকমল সেখানে ‘হালকা’ হতে গেল। তাই বাকিদের একটু অপেক্ষা করতেই হল। প্রায় পাঁচ দশ মিনিট পর, পাথরের আড়াল থেকে শোনা গেল,
-“ভাই, বড় মুশকিল হল… জলের একটা বোতল দিবি ? আনতে ভুলে গেছি…”
অসীমাভ এবং মৈনাক মুখ ঘোরাচ্ছে দেখে, বলির পাঁঠাটা শ্বেতাংশুকেই হতে হল; সে হাত বাড়িয়ে জলের বোতল আর সোপ পেপার দিয়ে আসার আরো ৫ মিনিট পর, হাসিমুখে পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল আকমল।
-“ব্যাস, আর কোন চিন্তা নেই… এবার চল…”
এই বলেই একটা পা বাড়িয়ে সে দড়াম করে আছাড় খেল।
-“কচুপোড়া খেলে যা !!!” -বলে অসীম আর মৈনাক তাকে টেনে তোলার পর সে বলল,
-“আসলে মুশকিল হয়েছে কি…”
-“আর হতে হবে না… ভাই, আজকের মতো তোর মুশকিলের কোটা শেষ… এবার আর একটাও মুশকিল আমি শুনছি না…”
আকমল ব্যাজার মুখে চলতে শুরু করে দেয়…
আরও আধঘন্টা পর, মেঘের আস্তরণ ফেটে একটু একটু করে রোদ ঢুকতে শুরু করে… পাহাড়ের একটা ছোট বাঁক পেরোতেই চোখে পড়ে একটা ছোট জনপদ। পাথরের রাস্তার একধারে ছোট ছোট কাঠের একতলা-দোতলা বাড়ি, ঠিক বিদেশী রূপকথার ছবির মতো আঁকা। আকাশে মেঘের চিহ্নমাত্র নেই, ঝলমলে রোদ পড়েছে সামনের ভেজা রাস্তায়, বাড়িগুলোর গায়ে, ছাদে… বাড়ির দু’পাশে ছোট ছোট ফুলের গাছ, তাতে রংবেরঙের ফুল ভর্তি, আর ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে চারদিকে। রাস্তার ধারে অনেকগুলো বাচ্চা ছেলেপুলে, যাদের মুখে মঙ্গোলীয় ছাপ স্পষ্ট, তারা হাসিমুখে লক্ষ করছিল একদল ওদের।
দৃশ্যটা এরকমই, যে সবার মুখে হাসি ফুটতে বাধ্য… এবং ফুটলও তাই, এমনকি এতক্ষণ চুপ করে মুখ গোমড়া করে থাকা অনুপ্রিয়া পর্যন্ত হাসিমুখ দেখাতে বাধ্য হল। মৈনাক ভাবছিল, এইসব জায়গায় বসে কবিতা লেখা যায়, আর তারপরই মনে পড়ল শেষ কবিতা সে লিখেছে দু’মাস আগে, তিয়াসার জন্য। আর ট্রেনে ওঠার পর, এই প্রথম বার, দু’চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে তার, আনেক চেষ্টা করেও আটকাতে পারে না…
খুব বেশী লম্বা মনে হচ্ছে কি ? হলে আমি দুঃখিত… আসলে লেখাটা আর আমি, পরস্পরকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি… তাই এত সহজে কেউ কারোকে ছাড়ব বলে মনে হয় না, তাই অনুরোধ, একটু ধৈর্য্য ধরে পড়ুন, আশা করছি, ভালো লাগবে…
শান্তির আশায়…
নীল…
Pingback: Somewhere In the Jungle of North Bengal… Part VI – Libberish