Somewhere, In the Jungle of North Bengal… Part IV

হেথা দিনেতে অন্ধকার,

হেথা নিঃঝুম চারিধার…

হেথা ঊর্দ্ধে উঁচায়ে মাথা দিল ঘুম,

যত আদিম মহাদ্রুম !

-সত্যজিৎ রায়

||৪||

-“এই যে লাইন দেখছো, এখন পড়ে থেকে থেকে নষ্ট হচ্ছে, এককালে চা এবং লাম্বার বওয়ার কাজে প্রুচুর ব্যবহার হত। সেটা লেপার্ড’স নেস্ট-এর পেছন দিয়ে চলে গেছে রাজাভাতখাওয়ার জঙ্গল হয়ে গরুমারার দিকে, আর তার মাঝেই এটা ঢুকেছে খুনিয়ার জঙ্গলে; গভীরে নয়, কিন্তু জঙ্গলের ভেতরে নিশ্চয়ই। এবার এই খুনিয়ার নামটা এসেছে একটা কারণেই; সেটা হল হাতির উপদ্রব। গোটা ডুয়ার্সের ৮০ পারসেন্ট হাতি বা হাতিজনিত মৃত্যু ঘটে থাকে এই খুনিয়া বা তার আশেপাশের অঞ্চলেই। আর তার সাথে যোগ হয়েছে ভূতের গপ্পো…”

এইটুকু বলেই তারাদা একটা বিড়ি ধরানোর জন্য ব্রেক নিল।

রাতে দিলীপবাবু আবার আসেন, এবং তারা দা কে সঙ্গে করে নিয়ে, এসে তার যে পরিচয় দিলেন, তাতে স্যার সহ সকলেরই চোখ কপালে উঠে গেল। তারা দা, মানে তারাশঙ্কর থাপা, এই অঞ্চলের সবচেয়ে অভীজ্ঞ গাইড। জঙ্গল ‘নখদর্পণে’ বললে বরং কমই বলা হয় ওনার সম্পর্কে। স্থানীয় উপজাতির দু-তিনিটে ভাষা ছাড়াও তিনি চোস্ত ইংরাজি, হিন্দি, বাংলা, ফ্রেঞ্চ এবং রাশিয়ান বলতে পারেন। গোটা ট্যুরে মৈনাকদের সর্বত্র পথপ্রদর্শকের কাজটা তিনিই করবেন। তারা দার কিঞ্চিৎ রাজনৈতিক কার্যকলাপও আছে, তাই এখানে প্রভাব এবং প্রতিপত্তি, কোনোটারই অভাব নেই।

দিলীপ বাবুর কথাবার্তার মধ্যেই স্যার সেই খগেন নামক ব্যক্তির কথা জিজ্ঞাসা করেন, যে নাকি খুনিয়ার জঙ্গলে ঢুকে পড়েছিল শুনে দিলীপবাবু হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যান। সে কথায় একটু বিরক্তির সুরেই দিলীপবাবু এবং তারাদা দু’জনেই বলে, যে খগেন নামক ব্যক্তিটির এটা একটা নিত্তনৈমিত্তিক কাজ। মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন অবাঞ্ছিত জায়গায় ঢুকে পড়ে; সে খুনিয়ার জঙ্গলই হোক, বা রাজাভাতখাওয়ার কোর এরিয়া। কিন্তু আশ্চর্য্যের ব্যাপার হল, এত জায়গায় দুমদাম ঢুকে পরার পড়েও, তার গায়ে একটু আঁচড়ও লাগেনি। দিলীপবাবু চলে যাওয়ার পর, মৈনাকরা ঘিরে ধরল তারাদা কে, আর কথায় কথায় উঠে এল খুনিয়ার কথা, আর তখনই একটা রহস্যময় হাসি হেসে, গুছিয়ে গপ্পো বলতে বসল তারাশঙ্কর থাপা।

বিড়ি ধরানোর পর তাকে মুখ খোলার সুযোগ না দিয়েই অসীমাভ বলে উঠল,

-“আচ্ছা, হাতির উপদ্রব যে বলছ, সেটা ঠিক কিরকম ? আর খুনিয়া নিয়ে ভূতের গপ্পোটাই বা কি ?”

-“হাতির উপদ্রব কিরকম ? ধরে নাও, রাতে হাতির দল একটা গ্রামের মধ্যে দিয়ে গেল, সকালে সেটার শ্মশানের চেয়েও খারাপ অবস্থা হয়। বাড়িঘর আস্ত তো থাকেই না, উপরন্তু লোকও কটা আস্ত থাকে, বলা মুশকিল। পা দিয়ে পিশে, কাউকে আছাড় মেরে… দাঁড়াও, এ ব্যাপারে আমার থেকে ভালো বলতে পারবে রাম।”

এটা বলেই, তারাদা দু’বার ‘রামলাল! রামলাল!’ বলে হাঁক দিলেন। একটা জীপের ড্রাইভার, যে তারাদাকে নিয়ে যাবে বলে বসেছিল, সে এগিয়ে এল। তারাদা তাকে স্থানীয় কোনো ভাষায় কিছু একটা বলতে, সে মৃদু হেসে, বুকে জ্যাকেটের চেইন খুলে, বুকের বাঁদিকের পাঁজরের কাছে একটা বিরাট বড় ক্ষতস্থান দেখাল। তারপর জামা ঠিক করতে করতে বলতে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় বলতে শুরু করল,

-“তাও প্রায় দেড় বছর হতে চলল। একদিন রাতে উপায়ান্তর না দেখে খুনিয়ার পাশ দিয়েই ফিরছিলাম। কপালটাই এমন, সাইকেলের চেইন গেল পড়ে। চেইনটা ঠিক করতে করতে দেখতে পেলাম, জঙ্গল থেকে বেরিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে ‘লস্কর’, তামাম ডুয়ার্সের সবচেয়ে খুনে দাঁতাল। আর তখন আমার সামনে সাইকেল, পেছনে একটা মোটা গাছ, কোথাও পালাবার পথ নেই। তবে, কপালটা একটু ভালো বলতে হবে; কারণ শুঁড়ের একটা হালকা বাড়ি মেরেই ছেড়ে দিয়েছিল সেদিন। তবে তাতেই বুকের দু’টো পাঁজর ভেঙে গেছিল…”

কথাটা শুনে সমীরা বেশ জোরেই ‘হায় দাইয়া !’ বলে চেঁচিয়ে উঠল। অসীমাভ সেটা মুখটা একটু ব্যাজার করল সমীরার আর্তনাদে। শ্বেতাংশু বলে উঠল;

-“আর ভূত ?”

তারাদা আবার একটু হেসে রামলালের দিকে তাকাল আবার। রামলাল আর একটু গম্ভীর হয়ে আবার বলতে শুরু করল,

-“খুনিয়া আমরা ড্রাইভাররা, রাতে একটু এড়িয়ে চলতেই ভালোবাসি। আর বিশেষ করে পূর্ণিমার রাতে। যদি একান্ত যেতেই হয়, তাহলে বাঁদিকে তাকাই না, আর রিয়ার ভিউ মিররও বন্ধ করে চলি।“

-“কেন ?”

-“পরী বলব, না পিশাচ বলব ? অনেকেই দেখেছে একটা সুন্দরী মেয়ে… দাঁড়িয়ে আছে গায়ে সাদা কাপড়, আর গায়ের রং থেকে যেন জ্যোৎস্না ঠিকরে বেড়োচ্ছে। কিন্তু সেই রূপে ভুলে কেউ যদি গাড়ি থামায়, বা গাড়ি থেকে নামে তো সেই মূর্তি তাকে ডেকে নিয়ে যায় গভীর জঙ্গলে, আর তার পরের দিন হাতির প্রভাবে মৃত্যুর নিদর্শন সমেত তার লাশ পাওয়া যায় জঙ্গলে…”

-“এই পরী, মানে এই মেয়েটিকে তুমি নিজের চোখে দেখেছ ?”

-“দেখিনি, কিন্তু অনুভব করেছি… আমার এক মামাতো ভাই; বন্ধুদের সাথে বাজি ধরেছিল, রাতে বাইক নিয়ে ওই খুনিয়ার জঙ্গলের পাশ দিয়ে ঘুরে আসবে। প্রচন্ড জেদী ছেলে, কারোর কথা শোনে না, শেষমেশ অনেক বোঝাতে একা না গিয়ে আমাকে সঙ্গে নেয়। সেদিন খুব জ্যোৎস্না ছিল, মানে আকাশে মেঘ নেই, গোল চাঁদ ঝলমল করছে। ওর বাইকের পিছনে বসে প্রায় খুনিয়ার সীমানা পার হয়ে গেছি, এমন সময় দেখলাম, ও রিয়ার ভিউ মিররের দিকে তাকাল, আর তারপরই, কেমন বেকায়দায় আমাকে আর বাইক নিয়ে সজোরে পড়ে গেল রাস্তায়। মাথায় হেলমেট ছিল দুজনেরই, দেখলাম, ও মাটিতে পড়ে, উঠেই উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করল, কলের পুতুলের মতন। আমি ডাকলাম, শুনল না। আমার পায়ে খুব জোরে লেগেছিল পড়ে দিয়ে, আমি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ওর সামনে কোনোরকমে গিয়ে ওর পথ আটকালাম। বললাম,

-“কি রে ? পড়ে গেলি কেন ? ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস ?”

সেটার উত্তরে বিড়বিড় করে আমাকে বলল,

_”ও… আমায় ডাকছে… আমায় ডাকছে…”

আমি পেছনে ফিরে কাউকে দেখতে পেলাম না, কিন্তু ভাই তখন কোনো কথাই শুনছে না… খালি একই কথা বলছে, আর এগোচ্ছে… গায়ে যেন দানবের শক্তি; আমি আমার সর্বশক্তি দিয়েও তাকে আটকাতে পাচ্ছি না। কিছুক্ষণ এরকম চলার পড়, আমি ওর দু’গালে দু’টো ঠাস ঠাস করে চড় মারলাম আর উপায় না দেখে। ও কেমন হকচকিয়ে থমকে গেল… বাকি রাস্তা ওকে পেছনে বসিয়ে আমিই বাইক চালিয়ে বাড়ি নিয়ে এলাম…”

এটা শোনার পর একটা অদ্ভূত নীরবতা নেমে এল গল্পের আসরে। এমনকি সমীরাও ‘হায় দাইয়া’ অবধি বলতে ভুলে গেল। এবার হঠাৎ মৈনাকই মুখ খোলে,

-“তারা দা, তোমার খুনিয়ার জঙ্গলে কোনো অভিজ্ঞতা নেই ?”

এবার আকাশ ফাটানো একটা অট্টহাসি হাসে তারাশঙ্কর। হাসি থামলে বলে,

-“বুঝলে ছোটভাই, আমি ৯ বছর বয়স থেকে অনাথ, জলে-জঙ্গলে বনে-বাদাড়ে হেন জায়গা নেই যেখানে ঘুরিনি। যা দেখেছি, তা মুখ ফুটে স্বীকার করি, কিন্তু বানিয়ে গপ্পো এই তারা থাপা বলে না। তাই সৌভাগ্যই বল, বা দূর্ভাগ্যই বল, খুনিয়ার জঙ্গলে রাতের বেলা কোনো সুন্দরী মেয়ের পাল্লায় আমি পড়িনি আজ অবধি। আরে দূর, সেরকম সুন্দরী মেয়ে পচ্ছন্দ হল না বলে বিয়েই করলাম না আজ পর্যন্ত !!!”

এবার একটা মৃদু হাসির গুঞ্জন ওঠে। এবার স্যার বলেন,

-“আমি অবশ্য এই পূর্ণিমার রাতের ব্যাপারটা জানতাম না… আমি ভাবতাম, খুনিয়ার জঙ্গল মানেই বিপদ…”

-“সে তো স্যার বিপদ অবশ্যই, হাতির ভয় সব সময়ই আছে, কিন্তু তা বলে কি আর লোকে কাজকর্ম সব শিকেয় তুলে দেবে ? কাজের জন্য তো লোকে যাতায়াত করেই থাকে তবে খগেনের ব্যাপার আলাদা, একে তো বয়সের গাছপাথর নেই, কত কেউ জানে না, যারা আন্দাজ করতে পারে, তারা বলে ১০০-র ওপর। ও যেন ইচ্ছে করেই জঙ্গলেই বিপদসঙ্কুল জায়গাগুলোয় ঢোকে…”

কথাটা বলতে বলতে ঘড়ি দেখে তারাশঙ্কর, আর তারপর লাফিয়ে ওঠে,

-“ওরেব্বাবা ! সাড়ে ন’টা !! সব্বোনাশ করেছে… আমি উঠলাম স্যার, উঠলাম, ফ্রেন্ডস… কাল দেখা হবে; অনেক রাস্তা ট্রেক করতে হবে কাল… তখন আবার গল্প করা যাবে, চলি… গুড নাইট।”

এই বলেই একরকম হন্তদন্ত হয়েই তারাশঙ্কর বেরিয়ে যায়।

রাতে অনেক জল্পনা কল্পনা হয় এই খুনিয়া নিয়ে; শ্বেতাংশু স্বীকার করে, ‘নিশির ডাক’-এর কথা শুনলেও এরকম নিশি-কাম-হাতির ডাকের কথা সে শোনেনি আগে। তারপর এক এক করে সবাই শুয়ে পড়লেও, মৈনাক চুপ করে জেগে বসে থাকে, একা একা জানলার দিকে তাকিয়ে। স্যার বলেছিলেম রাত হলে জঙ্গলের রূপ পালটে যায়। দূর থেকে কালো ঝাপসা একটা জমাট বাঁধা জিনিসটা যে আদতে গাছের তৈরী, সেটা বুঝতে বেশ বেগ পেতে হয়। একটা বিকট ঝিঁঝিঁর ডাক, পড়ে জেনেছিল ওটাকে ‘ঘন্টিপোকা’ বলে; তার সাথে মাঝে মাঝে পেঁচার ডাক, বাদুরের ডানা ঝাপটানোর শব্দ, আর জঙ্গলের পাতার ফাঁক দিয়ে ঝিরঝির করে বয়ে চলা বাতাসের একটানা সীম্ফনী… সবমিলিয়ে মনটা কেমন উদাস হয়ে যায় যেন… আকাশে চাঁদটা বেশ বড়… অনেক তারার মাঝে চাঁদটা যেন বসে আছে বিরাট বড় একটা ফ্লাডলাইটের মত…

আচ্ছা আজ কি পূর্ণিমা ? খুনিয়ার জঙ্গলের কাছে আজ গেলে কি সে দেখতে পাবে সেই নারীকে ? রূপ-যৌবনের টোপ দিয়ে যে একের পর এক মানুষকে নিশ্চিৎ মৃত্যুর দিকে টেনে আনে ? আজ কেউ কি একা হাঁটছে সেই রাস্তায় ? তাকে কেউ সাবধান করেছে তো ? এইসব ভাবনার মধ্যেই হঠাৎ তার চটকা ভাঙ্গে, জঙ্গল থেকে আর একটা শব্দের আমদানীতে; খুব জোরেও নয়, খুব আস্তেও নয়… কিন্তু একটানা মৃদু, বিরক্তিকর ঘ্যাস ঘ্যাস ঘ্যাস ঘ্যাস আওয়াজ, অনেকটা কাঠের ওপর করাত চালালে যেরকম হয়, সেরকম। জঙ্গল থেকেই শব্দটা আসছে, অনেক গভীর থেকে। চাঁদের আলোয় অনেক ঠাহর করেও কিছুই দেখতে পেল না সে।

কি আপদ… এটা আবার কিসের উপদ্রব  শুরু হল !!!                 

<——- Read Previous Installment…

Advertisement

5 thoughts on “Somewhere, In the Jungle of North Bengal… Part IV

  1. Pingback: Somewhere, In the Jungle of North Bengal… Part V – Libberish

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.