এখানে আকাশ নীল-নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল
ফুটে থাকে হিম সাদা-রং তার আশ্বিনের আলোর মতন
জীবনানন্দ দাশ
|| ৩ ||
সারারাত ট্রেনে কাটাবার পর, দুপুরে ঘুমটা বেশ দরকারী ছিল, আর স্নানের পর, গরম ভাত আর মূর্গীর ঝোলের কল্যাণে সেটা এসেও গেল চট করে। যদিও মৈনাক বইটা মুখে ধরেই শুয়েছিল, কিন্তু ঘুমের ঘোরে কখন যে হাত থেকে বইটা খসে সে ঘুমের দেশে চলে গেছে, নিজেও বুঝতে পারেনি। ঘুমের মধ্যে আবার স্বপ্ন দেখল… দেখতে পেল, সে একটু একটু করে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকছে, আর জঙ্গলও ঘন হচ্ছে ক্রমশ… আর সেই জঙ্গলের মধ্যে কিছু একটাকে ধাওয়া করে সামনে চলেছে সে। একটা পায়ের শব্দ… শুকনো পাতার ওপর মচ মচ মচ মচ… তার সামনে সামনে এগিয়ে চলেছে কোন এক অজানা দ্বিতীয় ব্যক্তি… একটা হালকা পায়ের শব্দ, অর্থাৎ এই পায়ের ছাপের মালিকের বয়স বেশী নয়। সেই পায়ের শব্দের পেছনে পা ফেলে এগিয়ে চলেছে মৈনাক। পায়ের শব্দই পাচ্ছে, কিন্তু দেখতে পাচ্ছে না এই পায়ের মালিককে; অনেকটা শব্দভেদী বাণের মতই আন্দাজে আন্দাজে এগিয়ে চলেছে সে। হঠাৎ আর একটা ভারী পায়ের শব্দ শুনতে পেল সে পেছন দিকে, এবার তার পেছনে এক তৃতীয় ব্যক্তির আবির্ভাব হয়েছে। তিনিদিন আগে রাতে দেখে স্বপ্নটা এরকমই ছিল না ? আবার পেছনের দিকে ঘুরতে যেতেই, স্বপ্নের জগতের মায়া কেটে বেরিয়ে এল মৈনাক। ধড়মড় করে উঠে বসে দেখল, অসীমাভ, আকমল আর শ্বেতাংশু স্যারের ডাকে উঠে বসে আড়মোড়া ভাঙছে; ঘরের আলোটা জ্বলে উঠেছে, এবং সেটাই সন্ধ্যের অন্ধকারটাকে ঘর দখল করতে বাধা দিচ্ছে…
-“মুখটা ধুয়ে বাইরে আয়… এ জিনিস আর এ জন্মে দেখতে পাবি না…”
কথাটা বলে স্যার আস্তে আস্তে ভেতরের ঘরের দিকে গেলেন। মেয়েদের ঘরের দরজায় টোকা দিতে। স্যারের অনেকক্ষণের প্রচেষ্টার ফলে প্রায় পনেরো মিনিট পড়ে সাতজনই ঘর থেকে বেরোল। বাইরে বেশ ঠান্ডা পড়েছে। রিসর্টের যেদিকে জঙ্গল, অর্থাৎ মূল প্রবেশদ্বারের দিকে, সেদিকে না গিয়ে স্যার চললেন রিসর্টের পেছনের দিকে। রিসর্টের সীমানা যেখানে শেষ হচ্ছে, সেখান থেকে জমি ঢালু হয়ে একটা উঁচু টিলার মত চেহারা নিয়েছে, আর সেই টিলার ওপর বরাবর চলে গিয়েছে ছোট গেজের বহু পুরোনো পরিত্যক্ত রেল লাইন। সেই ঢিবির অপর পারে আছে প্রশস্ত চা বাগান। স্যারের কথামতো, সেই ঢিবির ওপর উঠে যে দৃশ্যটা ওরা সবাই দেখতে পেল, সেটা দেখার পর প্রায় ৫ মিনিট মুখ হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল সক্কলে।
প্রশস্ত চা বাগানের চা গাছগুলোর ওপর উড়ে বেড়াচ্ছিল লাখ লাখ, কোটি কোটি জোনাকি। উদ্দেশ্যহীন ভাবে, গোটা চা বাগানের সব গাছগুলোর ওপর আলো ছড়িয়ে। আর একটু ওপরে তাকালে দেখা যাচ্ছিল আকাশ। দু’দিন আগে একটু বৃষ্টি হয়ে এখন পরিস্কার আকাশ, আর আকাশে তারা আর মাটিতে জোনাকি যেন চা গাছগুলোর মাথা থেকে একটা আলোর চাঁদোয়া আকাশ অবধি উঠে গেছে। সবার প্রথমে মুখ খুলল অসীমাভই।
-“আমি ক্যামেরাটা নিয়ে আসি…”
-“আরে থামো হে ছোকরা…” আপত্তি জানালেন স্যার।
-“গোটা দুনিয়ার সবকিছুই যদি স্ন্যাপশট বানিয়ে ফেললে, তাহলে তোমার চোখের জন্য বাকি কি রইল হে ? এমনিতেও তো সারাদিন ফোন আর ল্যাপটপে মুখে গুঁজে রেখে চোখগুলোর বারোটা বাজিয়েছো…”
অসীমাভ একটু হেসে দাঁড়িয়ে গেল। ক্যামেরা আনতে আর গেল না। সমীরা একবার বিড়বিড় করে ‘হায় দাইয়া’ বলে উঠল…
এসবের মধ্যে, চা বাগানের দিকে তাকিয়ে জোনাকির ঝাঁক দেখতে দেখতে একটা জিনিস চোখে পড়ল মৈনাকের। চা বাগানের মাঝখানে, যেখানে জোনাকির সংখ্যা সবচেয়ে বেশী, সেখানে জোনাকির আলোয় একটা অবয়ব স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্রমশ। সেটা মানুষের মতই। জোনাকিগুলো যেন সেটাকেই প্রদক্ষিণ করে চলেছে। ঘন চা বনের ফাঁকে অন্ধকারের মধ্যে, কে ওটা ? জোনাকির প্রচুর আলো, কিন্তু তার মধ্যে দুটো জোনাকি যেন স্থির। মৈনাকের মনে হল, ওইদু’টো জোনাকি নয়; লোকটার দু’তো জ্বলন্ত চোখ। এবার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল মৈনাকের। এমন সময় পেছন থেকে একটা কুকুরের ডাক শুনে চমকে পিছনে তাকালো মৈনাক সহ সক্কলে। দেখা গেল, বীট অফিসার দিলীপ বাবু দু’হাতে চারটে কুকুরের দড়ি ধরে উপস্থিত হয়েছেন।
-“যাক! তাহলে অ্যাম্ফিথিয়েটারের সন্ধান পেয়ে গেছেন ?”
স্যার হেসে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, সেদিকে মন না দিয়ে আবার সামনের দিকে তাকায় মৈনাক, কিন্তু অনেক ঠাহড় করেও সেই অবয়বটাকে আর দেখতে পায় না সে। চোখের ভুল ? সবাই ঢিবির থেকে নেমে কথা বলতে বলতে রিসর্টের দিকে চলতে শুরু করেছে। মৈনাকও নেমে পড়ে; কিন্তু সকলের সমবেত গুঞ্জনের দিকে কান থাকে না তার। সে ভাবতে থাকে, ওই দুটো স্বপ্ন, তারপর আজকের এই ছায়ামূর্তি… সবই কি স্বাভাবিক ? সত্যিই চোখের ভুল ? কাকতালীয় ?

-“অ্যাই মৈ…” -হাঁকটা দিয়েই শ্বেতাংশু একটা হাত কাঁধে রাখে মৈনাকের…
-“তুই আবার তিয়াসার কথা ভাবছিস ?”
-“না রে ভাই…”
-“আর ন্যাকামো করিস না… ঘুম ভেঙে কিভাবে উঠে বসেছিলি, দেখেছি আমি…”
-“না… মানে…”
-“দেখ ভাই, আমি, অসীমাভ অনেক খাটা-খাটনি করে তোর আসার ব্যবস্থা করেছি… এখন প্লিজ, এই মনমরা ফেজ টা থেকে বেরো, তোর পায়ে ধরি।”
হঠাৎ মৈনাকের মনে পড়ে যায়, স্যারের সাথে সকালের কথোপকথন।
-“হ্যাঁ, ভালো কথা, আমার ব্রেক-আপ যে হয়েছে, এটা স্যারকে কে বলেছে রে ? তুই না অসীম ?”
-“আমি ? না না…”
-“তার মানে অসীম ?”
-“না… মানে ওটা একটা যৌথ প্রচেষ্টা বলতে পারিস…”
-“সিরিয়াসলি ? ভাই, নিজের কলেজের ফেভারিট টিচারের সাথে ব্রেক-আপ নিয়ে ডিসকাস করা কতটা এমব্যারাসিং বুঝতে পারিস ?”
-“আরে ভাই… চাপ নিস কেন ? কৌশিক স্যার ইজ কুল…”
-“আরে ভাই… যতই কুল হোক… আমার কেমন একটা লাগে…”
-“ঠিক আছে, তোর আর ব্রেক আপ হলে স্যারকে বলব না, ঠিক আছে ?”
-“তুই একটা ইডিয়েট…”
-“বাবাও রোজ তাই বলে রে…”
এবার হেসে ফেলে মৈনাক, হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে সবাই মিলে পৌছোয় রিসর্টের বসার জায়গাতে, দিলীপবাবু একটা ছোটখাটো ভাষণ দিলেন, আর সেটার বক্তব্য ছিল এই, যে এই এলাকায় অন্যান্য জানোয়ারের সাথে হাতির খুব উপদ্রব, সুতরাং রাতে এদিক ওদিক যাওয়া এক্কেবারে মানা, বাঘ নেই ঠিকই, কিন্তু লেপার্ড আছে বিলক্ষণ, তাই রাতে খুব দরকারে বেরোতে হলে দল বেঁধে, আর সঙ্গে যেন একটা অন্তত কুকুর থাকে; তাই এই চার সারমেয়র আগমন। এছাড়াও, বনদপ্তর থেকে তিনি দু’টো জীপের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, ড্রাইভাররা সারাদিন মজুত থাকবে, তবে রাতে জীপ লাগলে, আগে থেকে বলতে হবে, আর জঙ্গলে চলাফেরা করার পারমিটও দরকার মতো তিনিই ব্যবস্থা করে দেবেন।
সকালে রান্না করেছিল স্থানীয় একটি ছেলে, নাম রতন। বয়স বেশী নয়, কিন্তু বেশ হাসিখুশি চটপটে ছেলে। ছেলেটিও সারারাত থাকবে, ওর জন্যও একটা স্টাফ কোয়ার্টারের ঘর এবং লাগোয়া রান্নাঘরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া আর একটি লোক সকালে একবার এসে ঘর-দোর পরিস্কার করে দিয়ে যাবে। এসব কথা হলে, দিলীপ বাবু, আটজনের জন্য আটটা বড় টর্চ আর আটখানা সোলার লাইট দিয়ে গেলেন। তার সাথে তিনি বলে গেলেন,
-“এমন সময় এসেছেন, বর্ষা এল বলে, জঙ্গল তো বন্ধ হবে ক’দিন বাদেই; এর মধ্যে আপনারা দুয়ারে যাবেন কাজে, ওপরে ওঠার পড় বৃষ্টি নামলেই চিত্তির! তখন এই আলোগুলো কাজে লেগে যাবে; তাছাড়া কি বলুন তো, এখানকার ইলেক্ট্রিসিটিও তো টেম্পোরারি ব্যবস্থা করা, কোনোদিন দূর্যোগে বা কোনোকারণে নিভে গেলে, আমি অফিসে এসে মিস্ত্রি পাঠানো আগে জ্বলবে এ আশাও করবেন না… এইসব সময়ের জন্যই আর কি, এগুলো আগাম দিয়ে রাখা।”
কথাগুলো শেষ করে, দিলীপবাবু বোঝাচ্ছিলেন, টর্চের আলো কোন প্রানীর চোখে পড়লে কি ভাবে জ্বলে, আর বাঘ বা হাতি কাছাকাছি এলে কুকুরগুলোই বা কিভাবে জানান দেয়, এমন সময়, মোটরসাইকেলে এক শীর্ণকায় বনকর্মী হন্তদন্ত হয়ে হাজির হয়ে বলল,
-“স্যার, খগেন খুনিয়ার জঙ্গলে ঢুকেছে…”
কথাটা শুনে দিলীপবাবুর মুখের চেহারাই পালটে গেল! তিনি রাগে আরক্ত মুখে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলেন,
-“তোরা কি করছিলি ? একটা লোককে সামলে রাখতে পারিস না ? গাধার দল যতসব…”
এ’টা বলে তিনি হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে গেলেন, এবং তিনি বেড়িয়ে যাওয়ার পরই, শ্বেতাংশু বলে উঠল,
-“স্যার, খুনিয়া কি ?”
-“কি নয়, কোথায়… এখানকার একটা জঙ্গলের অংশের নাম খুনিয়া, স্থানীয় লোকের বিশ্বাস, সেই জঙ্গলে একদল খুনে হাতি বাস করে, আর দিনে হোক বা রাতে; একবার ঐ জঙ্গলে ঢুকলে, কোনো মানুষের আর নিস্তার নেই…”
-“এসব কি সত্যি ?”
-“জানি না রে… তবে তরাই-ডুয়ার্স অঞ্চলে হাতিকে স্থানীয়রা ভয়ে ভক্তি করে কিনা, তাই-ই হয়তো এইসব ‘লেজেন্ড’-এর আমদানী…”
কি ? এবার একটু একটু গা ছম ছম হচ্ছে তো ? কিন্তু, এ তো কলির সন্ধ্যে… জঙ্গলের আতঙ্কের এই তো সূচনা…
শান্তির আশায়…
নীল…
দুর্দান্ত হচ্ছে প্রিয়। সত্যি বলতে পুরোটা না হলেও অল্প অল্প প্রিয় লেখকের স্বাদ পেলাম বটে। পরের কিস্তির অপেক্ষায় রইলাম।
LikeLike
Pingback: Somewhere, In the Jungle of North Bengal… Part IV – Libberish