‘Gar firdaus bar-rue zamin ast, hami asto, hamin asto, hamin ast’
-Amir Khusroo
|| 2 ||
ট্রেনে ওঠার পর অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে মৈনাক। সকলের হৈ চৈ আনন্দ করার মাঝে, নিজের দুঃখের পসরা সাজাতে তার ইচ্ছে করে না… ট্রেনের মজা, হাসি খুনসুটি এসব নিয়ে মেতে উঠে প্রেম ভেঙে যাওয়ার দুঃখটা ভুলেই গেছিল সে। এখন গন্তব্য নিয়ে আলোচনা করতেই ব্যস্ত সবাই। নিউ আলিপুরদুয়ারে নেমে সেখান থেকে সান্তালাবাড়ি গাড়িতে, তারপর পদব্রজে বক্সা দুয়ার। আর সেখান থেকেই কাজ শুরু ওদের। ফেরার সময় সুযোগ পেলে জয়ন্তী আর রাজাভাতখাওয়া বুড়ি ছুঁয়ে আসার ইচ্ছে আছে সবারই।
সারারাত ট্রেনেই কাটবে। সবাই লাগেজ গুছোতে, এবং একরাতের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বের করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। স্লীপার ক্লাসের আপার বার্থ-এ শুয়েছে অসীমাভ, তার হাতে খোলা রয়েছে ‘এ ফীস্ট ফর ক্রোজ’* তার ঠিক উল্টোদিকের বার্থে শুয়ে শ্বেতাংশু, তার কানে লাগানো আইপড। মিডল বার্থে মৈনাক, তার বুকে খোলা ‘মিস্টার মার্সেডিজ’* উল্টোদিকে আকমল। নীচের দুটো বার্থে অনুপ্রিয়া আর সমীরা, তারমধ্যে সমীরার কানেও একটি হেডফোন আর অনুপ্রিয়া ট্রেনে ওঠার একটু পর থেকেই ঘুমের দেশে। সাইড লোয়ারে বসে পল্লবী পড়ছিল ‘দ্যা গার্ল হু প্লেইড উইথ ফায়ার’* এবং আপার বার্থ-এ স্যার পড়ছিলেন একটা জার্নাল। সবাই শুয়ে পড়লেও, ঘুমের সময় কারোরই হয়নি। এমন সময় আকমল অস্বস্তিসূচক একটা শব্দ করে অসীমাভ কে বলল,
-“ভাই, বড় মুশকিল হল… আমার এক পাটি চটি চোরে নিয়ে গেছে…”
-“এক পাটি ? তাহলে চোর নয়, খচ্চর…” – মৈনাকের এই মন্তব্যে স্যার সমেত সবাই-ই হেসে ওঠে।
যাই হোক, একটু খোঁজাখুঁজি করার পর আর একপাটি চটি ঠিকই পাওয়া গেল, কিন্তু একটু বাদে আবার আকমল বলে উঠল,
-“ভাই… বড় মুশকিল হল… কালই সুটকেশটা কিনেছি… লকটা জ্যাম হয়ে গেছে… মানে কম্বিনেশানটা কি দিয়েছিলাম ভুলে গেছি, আর এখন ডায়ালগুলো ঘুরছেও না…”
মুখ ব্যাজার করে অসীমাভ ওপর থেকে নেমে এল… অনেক ধস্তাধস্তির পরও যখন সে তালা খোলা গেল না… তাখন অসীমাভ তার ব্যাগ থেকে পাথর ভাঙ্গার ছোট ছেনি হাতুড়ি দিয়ে সেটা ভেঙ্গেই দিল। আর হুমকিও দিয়ে গেল
-“আর একবার আমাকে ডাকলে তোর মাথা ভাঙব…”
-“এরকম বলছিস ভাই ?”
-“ভালার মরঘুলিস…”
-“কি গুলব ?”
-“তোর মাথা… শুয়ে পড়…”
বাকী রাতটা নির্বীঘ্নেই কাটল। ট্রেনও যথাসময়ে স্টেশনে পৌছে গেল। সমস্যাটা শুরু হল সান্তালাবাড়ির বীট অফিসারের কাছে গিয়ে। মৈনাকরা ভেবে এসেছিল যে ওরা থাকবে বক্সা দুয়ারেই, কিন্তু ব্যাপার হল, সেখানে ইলেক্ট্রিসিটির অভাব থাকায় তাদের সমস্ত যন্ত্রপাতি নিয়ে ওপরে থেকে কাজ করা সম্ভব না, তার ওপর অত ওপরে ফোনের নেটওয়ার্কও থাকে না, বলাই বাহুল্য। তাই তাদের থাকতে হবে সান্তালাবাড়িতেই। আর কাজের জন্য দরকারমত জিনিসপত্র নিয়ে ট্রেক করে ওপরে উঠে কাজকর্ম করতে হবে। ব্যাপারটা বড্ড পরিশ্রমসাপেক্ষ, কিন্তু অগত্যা… কিছু করার নেই। সান্তালাবাড়ির কাছে একটা রিসর্ট ছিল, যেটার নাম লেপার্ডস নেস্ট। রিসর্টটা যেকোনো কারণেই হোক, বেশীদিন চলেনি। তার ঘরগুলোকেই সাফসুতরো করে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন দিলীপ বাবু, মানে ওখানকার বীট অফিসার। আলাদা করে ইলেকট্রিসিটির কানেকশন টেনে, অচল হোটেলকে সচল করেছেন, ওরা সবাই জিনিস গুছিয়ে নিচ্ছিল, আর তখনই মৈনাক শুনল, দিলীপবাবু স্যার কে বলছেন,
-“এই জায়গাটায়, কিছুই আর টিকল না। আগে একটা স-মিল ছিল… বেশ চলত, তারপর কি একটা কারণে শ্রমিক অসন্তোষ হয়ে উঠে গেল, আর তারপর কোন এক মাড়োয়ারি কিনে এই রিসর্ট করল। তাও খুব বেশী হলে বছরখানেক… তারপর এই দশা। এখন ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট-এ আওতায় আছে, তাই মাঝে মাঝে আমাদের কাজে লেগে যায়…”
গোটা জায়গাটা ভালো করে ঘুরে দেখে মৈনাক… ছোট ছোট বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি, তার মধ্যে থাকার জায়গা ছাড়া খাওয়ার আর রান্না ঘর, কিছু স্টাফ কোয়ার্টার্স, আর একটা বড় কনফারেন্স হলের মত জিনিস। এই বাংলোগুলোর মধ্যেই একটা বড় গোছের বাংলোয় ওদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে, সেটার কাছেরই একটা ছোট বাংলোয় স্যারের। ওদের বাংলোটার মূল দরজা দিয়ে ঢুকে যে বড় ডাইনিং স্পেশ গোছের জিনিসটা আছে, সেটা সেটাতেই টানা বিছানা করে ওদের চারটে ছেলের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে, আর ভেতরের মাস্টার বেডরুমে ঠাঁই পেয়েছে তিন ললনা।
কমপ্লেক্স থেকে বেরোলেই রাস্তা, আর রাস্তার উল্টোদিকে একটু ঘাসজমি ক্রমশ উঁচু হয়ে জঙ্গলে গিয়ে মিশেছে।
পুরো কমপ্লেক্সটা ঘুরে দেখার পর, কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে, রাস্তা পেরোনোর পর, সবুজ ঘাসের জমি ধরে উদ্দেশ্যহীনের মতো জঙ্গলের দিকে হাঁটতে থাকে মৈনাক। হাঁটতে হাটতে একটা দু’টো গাছ পেরোতে পেরোতে জঙ্গলের একটু ভেতরে ঢুকে পড়েছিল, হঠাৎ পেছন থেকে একটা পরিচিত গলায় আওয়াজ পেয়ে চমকে পিছন ফিরে তাকাল সে।

-“আর ভেতরে যাস না… জঙ্গল গভীর হচ্ছে।”
কখন যে স্যার লুকিয়ে তার পিছু নিয়েছেন, খেয়াল করেনি মৈনাক। সবে সবে সিগারেট এ আগুন ধরিয়ে একটা লম্বা সুখটান দিয়ে স্যার বললেন।
-“মন খারাপ বুঝতে পারছি, কিন্তু একা একা অত ভেতরে যাস না…”
মৈনাক বেশ অপ্রস্তুত হয়ে বলে,
-“না স্যার, মন খারাপ আর কিসের ?”
-“মন খারাপ কিসের মানে ? তোর ব্রেক-আপ হয়েছে, তো মন তোর খারাপ হবে না তো কি আমার হবে না কি ?”
এ কথাটার উত্তরে বড়ই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে মৈনাক। স্যার এগিয়ে এসে তার কাঁধে হাত রেখে বলেন,
-“খোকা, তুমি কি ভাবছ, তোমার জীবনেই একমাত্র ব্যর্থ প্রেম আছে ? ওটা অন্তত একটা করে সবার জীবনেই থাকে। সময় লাগবে, মনে হবে আর কেউ নেই, কিছু নেই… কোনোদিন কাউকেই বিশ্বাস করতে পারব না… কিন্তু পারবি, আবার প্রেম হবে। এত সহজে যদি লোকের সবার ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে যেত, তাহলে কি আর দেশের জনসংখ্যা এই হারে বাড়ত ?”
এবার হেসে ফেলে মৈনাক। স্যারের ইশারায়, স্যারের পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করে সে। স্যারও মাঝে মাঝে সিগারেটে একটা করে টান দিতে দিতে বলতে থাকেন।
-“প্রতি বছর এই সার্ভের জন্যই অপেক্ষা করি, জানিস তো… আমাদের নগরসভ্যতার থেকে দুরে, জঙ্গলের এত কাছে, এই যে প্রকৃতিকে নিবীড় করে পাওয়া; এ অনেক বড় পাওয়া রে। এই যে ক’টা দিন এখানে কাটাবি, দেখবি জঙ্গলের প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা গন্ধ কলকাতায় ফিরে কত আপনার মনে হবে, আর কতটা মিস করবি… আমার কাছে তো এটাই স্বর্গ রে… আর রাতটা হলে দেখবি… উফফফফ…”
-“রাতে কি স্যার ?”
-“এই জঙ্গলের চেহারাই পাল্টে যায় ! একটা আদিম, উদ্দাম, অথচ চিরসবুজ জিনিস চোখের সামনে… আর কত শব্দ! রাতে জঙ্গলের শব্দ শুনলে গায়ে কাঁটা দেবে, মনটা উদাস হয়ে যাবে, চাঁদনী রাতে মনে হবে কত রহস্যের ভান্ডার যেন অপেক্ষা করছে সামনে… শুধু একটু খুঁজে নিলেই হল। সে একটা ভয়ঙ্কর সুন্দর জিনিস !!!”
জঙ্গলের পথে চলতে চলতে সহসা স্যারের এই দার্শনিক হয়ে ওঠাটায় বেশ মজাই পায় মৈনাক। এতক্ষণ স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল, এবার সামনের দিকে তাকিয়ে, একটু থমকে যায়। হাঁটতে হাঁটতে যেখানে চলে এসেছিল, সেখান থেকে সামনে মুখ তুলতেই চোখে পড়ে লেপার্ডস নেস্ট। জায়গাটা বড্ড চেনা চেনা লাগছে তার… এটাই সে দেখেছিল না স্বপ্নে, তিনদিন আগে ?
বলছি, কেমন হচ্ছে ? জানাবেন কিন্তু… লেখাটে এত সহজে শেষ হবে না, আর ভূত ? মেওয়া ফলতে এখনো দেরী আছে, দাদা…
শান্তির আশায়…
নীল…
Pingback: Somewhere, In the Jungle of North Bengal… Part – III – Libberish