বড় দেরী হয়ে গেল, কিন্তু আমার আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আমি বলতে পারি, আমি সময় চেয়েইছিলাম। তবে, এই লেখাটি এত সহজে আমার পিছু ছাড়বে বলে মনে হয় না। তবে, আগেরটার মতই, এটিও কিন্তু নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া সত্য ঘটনা অবলম্বনে। তাই, সত্যের অপলাপ না করেই, শুরু করা যাক, ‘অপ-ঘটনা’ সিরিজের দ্বিতীয় গল্পের প্রথম কিস্তি।
“We’re everywhere, out there, among you”
― C.J. Morrow, The Finder
।। ১।।
এস এম এস টা আর একবার পড়ল, মৈনাক। মানে দু দুটো মেসেজ প্যাক শেষ হয়ে যাওয়ার পরের মেসেজটা হল “Its not wrkng out, Moinaak. I think lets call it… ar amk msg kre br br dstrb Kris na… smne exm ache…”
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল সে। হাতটা থরথর করে কাঁপছে। তিন বছরের সম্পর্ক… আর কথাটা সামনে এসে বলারও প্রয়োজন মনে করল না তিয়াসা… অনেক কথাকাটাকাটি, অনেক বিনিদ্র রজনীর পর, আজ সব ভেঙে পড়ল।
কে দায়ী এর জন্য ? সে ? তিয়াসা ? নাকি তাদের মাঝের ২০০ কিলোমিটার দুরত্ব ? নাকি সেইসব বন্ধু, যারা কারণে-অকারণে তাদের সম্পর্কের মাঝখানে নাক গলিয়ে ব্যাপারটাকে আরো জটিল করে তুলেছিল ? ভাবতে ভাবতে চোখটা আপনা আপনিই জলে ভিজে উঠল, চারদিক ঝাপসা লাগল। পেছনে চলা ক্যান্টিনের নিরর্থক কোলাহল তার কানে রেডিওর একটানা ঘ্যাষঘ্যাসে বিরক্তিকর শব্দের মতই মনে হচ্ছিল। উঠে পড়ল মৈনাক। প্লেটে পড়ে থাকে দেড়খানা ফিশ চপ । ব্যাপারটা আর কেউ লক্ষ্য না করলেও অসীমাভ দেখে। সে ইশারায় শ্বেতাংশুকে ডেকে উঠে পড়ে ।
ক্যান্টিন থেকে বেড়িয়ে বেশিদূর যেতে হয় না, ক্যান্টিনের পাশের ছোট গলিতে, নর্দমার পাশে পাওয়া যায় মৈনাককে, চোখদুটো দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ছে।
-“হরি হে ! মাছের চপ ফেলে নর্দমার ধারে বসে অশ্রুবিসর্জন ? এ তোমার কোন রূপ দেখাচ্ছ, ঠাকুর ?”
মৈনাক ইশারায় হাত তুলে শ্বেতাংশুকে থামায়। তার চোখের জল, নিমেষে একটু পালটে দেয় বাকী দু’জনের মুখের অভিব্যক্তি। তারা দু’জনেই জানত, যে তিয়াসার সাথে একটা টানাপোড়েন ক’দিন ধরে চলছে মৈনাকের। দু’জনে গিয়ে দু’পাশে গিয়ে বসে পড়ে। মৈনাক একরকম অসীমাভকে জড়িয়ে ধরেই কাঁদতে থাকে।
-“আরে ভাই, অনেস্টলি বলছি, তোর হাবভাব দেখে আমার মনে হচ্ছিল, এটাই হতে চলেছে… কাম ডাউন…”
কিন্তু মৈনাক অত সহজে থামবার নয়। দুই বন্ধুর বেশ কিছুটা কাঠখড় পোড়ানোর পর, মৈনাক একটু সোজা হয়।
-“খুব ভালোবাসতাম রে…”
-“সে তো সবাই জানে… কিন্তু বার বার করে বারণ করেছিলাম, লং ডিস্টেন্সে আছিস, দয়া করে থার্ড পারসন মাঝে ঢোকাস না। শুনলি ? না, এর থেকে খবর নিচ্ছি, ওর থেকে খবর নিচ্ছি… কি লাভ হল ? গুছিয়ে তোরটাই তো মারা গেল ?”
আবার একটু কেঁদে ফেলে মৈনাক।
-“বুঝতে পারিনি ভাই…”
-“ছাড় তো এখন ওসব কথা… আপাতত সামনের কথাটা ভাব। সামনে ট্যুর আছে…”
-“ট্যুর ? কিসের ট্যুর ? আমি তো সার্ভে টিমে নেই ? আমার তো…”
তাকে কথাটা শেষ না করতে দিয়েই অসীমাভ বলে ওঠে,
-“নেই মানে? এখন নেই… থাকতে কতক্ষণ ? এমনিতেও অত বড় এরিয়া সার্ভে করার জন্য, ৩ জনের টিম বড়ই ছোট।”
-“তিনজন কই রে ? ছ’জন তো…” -অবাক হয়ে প্রশ্ন করে শ্বেতাংশু।
-“তুই না ভাই, সিরিয়াসলি। কি খেয়েছিস সকালে, গাঁজা ? ছ’জন ? আমি, তুই, পল্লবী বাদ দিলে, আর কে আছে যে কাজ করবে ? আকমল ? যে সন্ধ্যে হলে বোতল পুরাণ পাঠ করতে বসে, নাকি অনুপ্রিয়া, যে দোতলা থেকে একতলা লিফট ছাড়া নামতে পারে না। নাকি সমীরা, না সরি সামিরাআআ যে এখনো কথায় কথায় ভোজপুরী হিরোইনের মতো গালে হাত দিয়ে ‘হায় দাইয়া’ বলে চোখ কপালে তোলে?”

শ্বেতাংশু হেসে ফেলে। একটা হাসির আভা মৈনাকের মুখেও দেখা দেয়।
-“কিন্তু এখন ম্যানেজ হবে ? পরের সপ্তাহেই যাওয়া, থাকা খাওয়া তো সমস্যা নয়, আসল সমস্যা ট্রেনের টিকিট। কি করে পারবি ?”
-“আরে ভাই, এই অসীমাভ মুখুজ্জে থাকতে তোর আবার টিকিটের চিন্তা ? মামাকে একটা ফোন লাগাবো, আর সিধে ভি আই পি কোটা।”
-“কিন্তু, স্যার ম্যানেজ হবে ?” -আবার সন্দেহ প্রকাশ করে শ্বেতাংশু।
-“হুঃ… স্যার আবার ম্যানেজ হবে না… আমাদের ওমন মাইডিয়ার লোক, সে কিনা তার প্রিয় ছাত্রের যাওয়াতে মানা করবে…”
মৈনাক কিছু বলার সুযোগও পেল না। তবে সে আপত্তি করতে চাইছিলও না। কারণ কলেজে জিওলজি নিয়ে পড়া ইস্তক তার সার্ভেতে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল প্রবল, কিন্তু কপালদোষে সেমিস্টারের প্রথম সার্ভে থেকেই তার নাম বাদ পড়ে। ব্রেক আপের দৌলতে হোক, বা যে ভাবেই হোক, এখন এই ঘিঞ্জি শহরটা ছেড়ে বেরোতে পারলেই মনটা হয়তো ভালো হবে। এমনিতেও জঙ্গল তার ভালো লাগে, আর ডুয়ার্স সে আগে যায়নি; গেলেও জ্ঞান হয়নি যখন গেছে, তার ওপর বাড়িতে মন টিকছে না।
রাতে খেয়েদেয়ে, ঘরের আলোটা নেভাতেই মনে হল, ঘরের জমাট বাঁধা অন্ধকার যেন তাকে বিদ্রুপ করছে; যেন অন্ধকারটা একটা জলজ্যান্ত মানুষ, যে তার ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে তার দিকে আঙুল তুলে একটা বিদ্রুপের হাসি হাসছে। আলোটা সে জ্বালিয়েই শুল তাই শেষমেশ। ডাইনিং রুমের গ্র্যান্ডফাদার ক্লকে ঢং ঢং করে ১২টা বাজলে বুঝতে পারল, টানা তিনঘন্টা বিছানায় ছটফট করে, চোখের জ্বলে বালিশ ভিজিয়ে আর যাই হোক, ঘুম আসবে না। বিছানা ছেড়ে উঠে স্টাডি টেবলে বসল মৈনাক। ফোনটা সাইলেন্ট করা ছিল, দেখল একগাদা মেসেজ জমে আছে । ফোনটা ফেলে দিয়ে রিডিং ল্যাম্পটা জ্বালল। সামনে পড়ে থাকা খাতাটা টেনে, কিছু একটা লিখবে বলে অনেকক্ষণ হিজিবিজি কাটতে কাটতে, সেই খাতার ওপরই মাথা রেখে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেই জানে না। যখন ঘুম ভাঙল, তখন সে একটা সবুজ ঘাসজমির ওপর শুয়ে, ওপরে আকাশ, একটা পাহাড়ের সারি দেখা যাচ্ছে…
উঠে বসে সামনে তাকায় সে। একটা ছোট কারখানার মত কি যেন একটু দুরেই। আর তার পরেই একটা ঘন জঙ্গল। উঠে দু’পা হাঁটতে থাকে সে। সামনের দিকে একটু এগোতেই, পেছনে একটা ভারী পায়ের শব্দ পায়। পিছন ফিরে তাকাতে যেতেই, কে যেন তাকে প্রচন্ড জোরে একটা ধাক্কা মারে, আর চমকে আবার জেগে ওঠে সে। এবার তার ঘরে, পিঠের কাছে দাঁড়ানো মা বেশ রাগের গলায় বলে ওঠেন,
-“তোর ঘরের সবক’টা বালব আমি যদি আজ খুলে না নিই, দেখ…”
জানলা দিয়ে আসা রোদে ঘর ভেসে যাচ্ছে তখন।
-“শিগগির নিচে নাম, জলখাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে…”
মা এই বলে ঘর থেকে চলে যান। মৈনাক ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে দেখে সতেরোটা মিসড কল, তার মধ্যে বারোটা অসীমাভর। তাকে ফোন করতে সে বেশ ঝাঁঝের গলায় বলে ওঠে,
-“শালা, কখন থেকে ফোন করে যাচ্ছি, কোথায় গুঁজে রেখেছিলি ফোনটাকে ?”
-“এই তো… বল…”
-“তাড়াতাড়ি কলেজ ঢোক, স্যার ডেকেছেন তোকে, আর্জেন্ট। আর বাই দ্য ওয়ে, তোর টিকিট কনফার্মড।”
কি ভাবছেন ? ভূত কই ? আর মশাই, আসবে, আসবে… ধৈর্য্য ধরুন… সবুরে মেওয়ার সাথে সাথে দু-একটা ভূতও পেয়ে যাবেন। চিন্তা নেই।
শান্তির আশায়…
নীল…
Darun
LikeLike
Pingback: Somewhere, In the Jungle of North Bengal… Part – II – Libberish