বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর…
||১০||
ভোররাতে বৃষ্টি শুরুর সাথে সাথে ঘুম ভেঙে গেল সক্কলের। জালনা গুলো বন্ধ করতে করতে ওরা বুঝতে পারল, প্ল্যানমাফিক সকালে লেপচাখা যাওয়াটা বোধহয় হবে না। কারণ, এই বৃষ্টিতে ওই রাস্তা ট্রেক করে ওঠা অসম্ভব। জানলা বন্ধ করে শোওয়ার সময় অসীমাভ লক্ষ্য করল, এত হট্টগোলের মধ্যেও মৈনাক চুপচাপ ফোন মুখে ধরে বসে আছে; যেখানে শ্বেতাংশু এমনকি আকমল পর্যন্ত উঠে এসেছে জানলা বন্ধ করতে, সেখানে মৈনাক নির্বীকার; তার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে, যতক্ষণ বাকীরা ঘুমোচ্ছিল, মৈনাক জেগে বসেছিল।
-“অ্যাই মই, ঘুমাবি না ????”
-“হ্যাঁ, এই তো, শুয়ে পড়ছি।”
আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়ে অসীমাভ। তার নিজের প্রবল ঘুম পাচ্ছে।
সকালে যখন সবার ঘুম ভাঙল, তখনও বৃষ্টির কোনো বিরাম হয়নি। স্যারের কাছে ছাতা নেই, তাই তিনি আসতে পারেননি; রতন একটা কেটলি ভর্তি চা আর একগাদা চা-এর গ্লাস দিয়ে গেল। রতন চা দিয়ে যাওয়ার পরই, অনুপ্রিয়া, পল্লবী আর সমীরা এসে হাজির হল। সবাই মিলে বসে চা খাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে, তখনও মৈনাক কিন্তু ঘুমিয়ে চলেছে অঘোরে। শ্বেতাংশুই তাকে টেনে তুলল। মৈনাক উঠে বসে চায়ে চুমুক দিল। তার চোখ মুখ বলে দিচ্ছে, অনেক রাতে শুয়েছে সে, এবং প্রচন্ড ক্লান্ত। চা পান শেষ করে মুখ হাত ধুয়ে সবাই আবার এসে বসল, কারণ এই বৃষ্টিতে আর কিছুই করার নেই, তখন অসীমাভ আবার দেখল, মৈনাক ফোনে ফিরে গেছে।
মৈণকের সেদিকে খেয়াল নেই; কাল রাতে তিয়াসার একটা মেসেজের উত্তরে একটা রিপ্লাই, আর একটা রিপ্লাই, আর একটা রিপ্লাই, এই করে করে গোটা রাত কাটিয়ে দিয়েছে সে; ভোর সাড়ে চারটের সময় যখন তিয়াসা ওকে গুডনাইট বলেছে, তখন কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সে ঘুমের দেশে চলে গেছে, আর শ্বেতাংশু ডেকে তোলার আগে অবধি অঘোরে ঘুমিয়েছে।
আসলে ‘কেমন আছিস ?’ এটা আমার মতে পৃথিবীর সবথেকে কঠিন প্রশ্ন। হ্যাঁ, এই প্রশ্ন আমাদের প্রতি সপ্তাহে অন্তত ১০০ বার হয়তো শুনতে হয়, কিন্তু প্রতিটা ক্ষেত্রে এই প্রশ্নের পেছনের আবেগ, গুরুত্ব সবই আলাদা হয়। পাড়ার যে কাকু রোজ সকালে কান এঁটো করা হাসি হেসে রোজ একই কথা জিজ্ঞাসা করে, তাকে দেওয়া উত্তর আর অনেক দিনের পুরোনো বন্ধুর সাথে বহুদিন পড়ে দেখা হলে সে যখন বুকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে ‘কেমন আছিস’; তখন তাকে দেওয়া উত্তর একেবারেই আলাদা হয়। আর যখন প্রাক্তন প্রেমিকা প্রায় দু-তিন সপ্তাহ পড়ে আবার কেমন আছিস জিজ্ঞেস করে, তখন…
অনেক লোকে অনেক রকম উত্তর দেয়, বা দিতে পারে; আর কাল রাতে তিয়াসার এই মেসেজের উত্তরে ‘none of your business’ লিখে, পাঠাতে গিয়েও মুছে ফেলে উত্তর দেয় মৈনাক, ‘ekhono beche achi…’।
তারপর সারারাত কেটে যায় অনেক ভনিতায়, অনেক রাগ, অনেক জমে থাকা কষ্টের হিসেব মেলাতে মেলাতে; রাত পেড়িয়ে সকাল হওয়ামাত্র, আবার অনেক দিনের পুরোনো অভ্যাসের বশে তিয়াসাকে মেসেজ করে মৈনাক ‘good morning’।
-“তোর কি হয়েছে বল তো ? কাল রাত থেকে দেখছি ফোন থেকে মুখ তুলছিস না একেবারে ?”
-“অ্যাঁ ? না না… এই তো… আরে গে-গেম খেলছিলাম…”
এই বলে কোনোরকমে ফোনটা রেখে দিয়ে গল্পে অংশগ্রহন করতে বাধ্য হল মৈনাক। গল্পে গল্পে বেলা বাড়ল, বৃষ্টিটাও পড়ে এল অনেকটা। সবাই উঠে পড়ল স্নান সারবে বলে।
সবার স্নান টান সারা হলে দেখা গেল, বৃষ্টি থেমে গেলেও, আকাশের মুখ ভার। স্যার ঘরে আসতে পেরেছেন এতক্ষণে।
-“আজকের দিনটা পুরোটাই বরবাদ হয়ে গেল রে! আসলে, এমনই শাঁখের করাত এই সার্ভে; বর্ষাকাল ছাড়া ডেটও পড়ে না, আর বৃষ্টিতে দিন নষ্ট হবেই। যাক গে যাক; আজ ভালো করে ল্যাদ খেয়ে নে, রাতে আর বৃষ্টি না হলে কাল লেপচাখা যাওয়া যাবে।”
মধ্যাহ্নভোজনের সময় দিলীপবাবু এসে হাজির হলেন। কাল রাতে বৃষ্টি শুরু হওয়ার সাথে সাথে ওনাদের জঙ্গলে টহল দেওয়া বন্ধ করতে হয়; তবে তার আগে অবধি জঙ্গলে কোনও শব্দই শুনতে পাননি ওনারা।
-“তবে সম্ভব, সবই সম্ভব… হয়তো বৃষ্টির কথা আন্দাজ করে ব্যাটাচ্ছেলেরা আসেনি কাল।”
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর, মৈনাককে তখনো ফোনে মুখ গুঁজে পড়ে থাকতে দেখে, এবার অসীমাভ বেশ রেগেই যায়…
-“অ্যাই ! তখন থেকে কি করছিস বলত ফোন নিয়ে ?”
-“ওই তো… গেম খেলছি…”
-“গেম খেলছিস ? মিথ্যে কথা বলার জায়গা পাসনি ? দেখি কি গেম খেলছিস ?”
-“আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে, রেখে দিচ্ছি ?”
-“রেখে দিচ্ছি মানে ? তুই কাল রাত থেকে ফোনে মুখ গুঁজে করছিস টা কি শুনি ?”
-“আরে ভাই, রেখে দিচ্ছি বললাম তো…”
-“না, না, তুই বল, কি করছিলি ? তিয়াসা মেসেজ করছিল ?”
মৈনাক চুপ।
-“ও, তার মানে তিয়াসাই মেসেজ করছিলি… তোর লজ্জা করে না রে ? দু’দিন আগে যে তোকে মেসেজ করে তিন বছরের সম্পর্ক ভেঙে দিল, সে মেসেজ করে চলেছে, আর তুই তাকে রিপ্লাইও দিয়ে চলেছিস… বাহ !”
-“ভাই, ছেড়ে দে, সরি… জানিস তো, এই দু’সপ্তাহেই কি সব ভুলে যাব ? তাই…”
-“তাই হাঁক দিলেই কুকুরের মত জিভ বার করে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে ছুটে যাবি, এই তো ?”
-“ভাই, থাম না, হয়ে গেছে মিটে গেছে… আর আমার পার্সোনাল ম্যাটার…”
-“আচ্ছা, এখন পার্সোনাল ম্যাটার হয়ে গেল, তাই তো ? যখন সার্ভে টিমে না থাকা সত্ত্বেও, স্যারকে রাজী করিয়ে আর হেডুকে ঝেলে এতদুর নিয়ে আসলাম, তখন তো বারোয়ারী ম্যাটার ছিল…”
এবার মৈণাকের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটে;
-“মানে ? আমি কি তোকে বলেছিলাম, ভাই, আমাকে নিয়ে চল ? বলেছিলাম ?”
-“সে তো এখন বলবিই রে, অকৃতজ্ঞ কোথাকার; একটা মেয়ে যে রিলেশনশিপটাকে সিরিয়াসলি নিতে পারে না, লোকের কথায় কান দিয়ে এখন তো তার হয়ে ঝোল টেনে কথাই বলবি…”
-“তুই ভাট বকাটা থামাবি ? আমি কখন ঝোল টেনে কথা বললাম ? আমাকে মেসেজ করেছে, আমি রিল্পাই দিয়েছি, দ্যাটস ইট ! আমি রিকন্সাইল করতে যাচ্ছিও না… আর সবচেয়ে বড় কথা, ইউ আর দ্য লাস্ট পারসন টু গিভ মি রিলেশনশিপ অ্যাডভাইস… জীবনে ক’টা রিলেশনশিপ দেখেছিস তুই ?”
এবার অসীমাভ মুখ খোলার আগে শ্বেতাংশু তাড়াতাড়ি বলে উঠল,
-“ঠিক আছে… হয়েছে… শান্তি… আর…” -কিন্তু তাকে শেষ না করতে দিয়েই মৈনাক আবার বলে ওঠে;
-“চ্যাটরুমে মুখ অবধি না দেখে কোন এক আজানা, অচেনা মেয়েকে হৃদয় দান করে বসে আছেন বাবু, আর দাবী হল আমি ‘স্যাপিওসেক্সুয়াল’।”
এবার রাগে ফেটে পড়ে অসীমাভ।
-“হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ অনেক ভালো… চেনা জানা, তিন বছরের ‘রিয়েল’ প্রেমিকা যাকে ‘ইটস নট ওয়ার্কিং আউট’ বলে যাকে রাস্তায় বসিয়ে দেয়, তার মুখে এই কথাগুলো শোভা পায় না; নিজেকে কোন প্রেমের সিভিল সার্জেন ভাবিস তুই ? দেখগে যা, কার হাত ধরে দু’সপ্তাহ ঘুরেছে আর এখন সেটা ঝুল কেস দেখে আবার এ ঘাটে নৌকা বাঁধতে এসেছে…”
এ কথার পর, অনেক কিছুই হতে পারত, কিন্তু মৈনাক সিধে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ঘরের পরিবেশ থমথমে, অসীমাভ মুখ গোমড়া করে বসে আছে; শ্বেতাংশু অসীমাভর মেজাজটা চেনে বলে আর ঘাঁটাল না তাকে। অসীমাভ কিছুক্ষণ বসে রইল, তারপর সিধে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

মৈনাক বাইরে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কান গরম হয়ে গেছে তার। অসীমাভ তার খুবই ভালো বন্ধু, কিন্তু মাঝে মাঝে তার মাতব্বরিটা সীমা ছাড়িয়ে যায়। মেসেজই তো করেছে; আর কি ? মামুলি কথাই হয়েছে, সে একবারও মুখ ফুটে বলেনি তার মনের কথা, তিয়াসা আকারে ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করা সত্ত্বেও। আর অসীমাভ অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই কথা শুনিয়ে দিল তাকে; মৈনাক তো আর মেশিন নয়; যে ব্রেক আপের পরের দিনই তিয়াসা নামক ‘ফোলডার’-এর সমস্তা ফাইল ডিলিট করে এক্কেবারে চাঙ্গা হয়ে যাবে ? এসব ভাবতে ভাবতে পকেটে হাত দিয়ে বুঝতে পারে, ঘরে ফোনটা ফেলে এসেছে সে; একবার পা থেমে গেলেও, শেষমেশ ঘরে যায়, আর গিয়ে দেখে অসীমাভ, শ্বেতাংশু সবাই শুয়ে পড়েছে, চোখ বন্ধ। ফোনটা বিছানার ওপর পড়েছিল। সেটা তুলে নিয়ে ঘাঁটতে ঘাঁটতে চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে, রাতের ঘুমের কোটা পূরণ না হওয়ার ফল; তাই শুয়ে ঘুমিয়েই পড়ে সে।
সন্ধ্যের অন্ধকার নেমে যাওয়ার অনেক পড়ে ঘুম ভাঙে তার। গোটা ঘর ফাঁকা, দুপুরের এই টানা ঘুমটার পড়, নিজেকে অনেক চাঙ্গা মনে হচ্ছে। এখানে আসার পর থেকে, সেই দুঃস্বপ্নটা একদিনই দেখেছিল সে, তারপর থেকে আর না। কিন্তু খালি চোখেই যা যা দেখেছে এর মধ্যে, তারপর ওই আধা দুঃস্বপ্নের কোনো প্রয়োজন আছে কি আর ?
ঘরে কেউ নেই, সেও ঘর থেকে বেরিয়ে দেখতে পেল, বাইরে সবাই জটলা করেছে; স্যার তাকে দেখে বলে উঠলেন-
-“উঠলি ? শ্বেতাংশু বলল তোর নাকি রাতে ঘুম হয়নি বৃষ্টির পর থেকে, তাই তোকে আর ঘাঁটাই নি; এখন চাঙ্গা তো ?”
মৈনাক হেসে সম্মতি দেয়। অসীমাভ তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না এখন। একটু মাখন তাকেই লাগাতে হবে বোঝাই যাচ্ছে, কিন্তু এখন নয়; পরে। দুপুর থেকে আর বৃষ্টি হয়নি, আকাশ মোটামুটি পরিষ্কার, আর তাই আগামীকাল লেপচাখা যাওয়াটা একরকম স্থিরই হয়ে আছে।
-“স্যার, আজ কি দিলীপবাবু আবার রাতে জঙ্গলে পাহারা বসাবেন ?”
-“না না, আজ না। একটু আগে এসেছিলেন, তখন কথা হল। কাল বৃষ্টির পরে আজই যদি পাহারা বসে, তাহলে তাহলে চোরেরা সতর্ক হয়ে যেতে পারে; উনি আবার দু’দিন পরে সার্চ পার্টি বের করবেন।“
সন্ধ্যেটা একটু মামুলি গল্প করেই কেটে যায়; মৈনাক জোর করে সবার সাথে কথা বললেও অসীমাভ মুখ গোমড়া করে চুপচাপ বসেই কাটিয়ে দায়।
স্যারের কথামত সবাইকে তাড়াতাড়ি নৈশাহার সেরে শুতে যেতে হয়। কিন্তু অসীমাভ যা গোঁয়ার, তাতে এত সহজে মৈনাক নিস্কৃতি পাবে বলে তো মনে হয় না। এবং হয়ও তাই। ঘরে যেতেই একরকম পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া শুরু করে সে।
-“এই আকমল, তুই শ্বেতাংশুর পাশে যা, আমি ওই চিটিংবাজের থেকে যতটা পারা যায় দূরত্ব বজায় রাখব।”
মৈনাকের হাসিই পায় এ কথায়;
-“ভাই, প্লিজ… হয়ে গেছে, মিটে গেছে… আমারই ভুল, আমার কথা বলা উচিৎ হয়নি মেনে নিচ্ছি… ড্রপ ইট, প্লিজ…”
অসীমাভ নাছোড়বান্দা;
-“শ্বেতাংশু, ওকে জিজ্ঞাসা কর; শেষ দু’সপ্তাহ যে আমি আর তুই, ফোনের ব্যালেন্স পুড়িয়ে, রাত তিনটে অবধি জেগে জেগে ছেলের ‘মুড’ ভালো রাখছিলাম, এই কি তার প্রতিদান ?”
শ্বেতাংশু নাটুকে ভঙ্গিতে বলে ওঠে, ‘এই কি তার প্রতিদান ?”
-“না না, জিজ্ঞাসা কর ওকে; এই যে এত কাঠ খড় পুড়িয়ে ডুয়ার্স অবধি নিয়ে এলাম, তার পড়ে এই বেইমানিটার কি কোনো প্রয়োজন ছিল ?”
-“এর কি কোনো প্রয়োজন ছিল ?”
মৈনাকের বিরক্তও লাগছিল, হাসিও পাচ্ছিল, কিন্তু সে মুখ খোলার আগেই একের পর এক প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে দিচ্ছিল অসীমাভ।
-“না, না, ও বলুক, আমাদের বন্ধুত্বের থেকে ওর কাছে একটা থার্ড ক্লাস মেয়ের নাটক আর লোক দেখানোই বেশী বড় হল…”
মৈনাকের মুখের চেহারা পাল্টে যায় এই শেষ কথাটায়। সে তবু চুপ করে থাকে। অসীমাভ এবার এগিয়ে আসে,
-“কি রে ? ওরকম গুম মেরে গেলি কেন ? উত্তরটা দে ? বল ? কি রে বল ?”
সকালে মৈনাকের ধৈর্য্যের বাঁধে একটু ফুটো হয়েছিল মাত্র, কিন্তু এবার সেটা হুড়মুড় করে ভেঙ্গেই পড়ল।
-“হ্যাঁ, ওই মেয়েটার সাথে কথা বলেছি। বেশ করেছি। হতে পারে লোক দেখানো, কিন্তু… কিন্তু আমি তো ভালো নেই, নেই ভালো… কিচ্ছু ঠিকঠাক চলছে না, আর এখানে আসা থেকে একের পর এক আজগুবি ঘটনা ঘটে চলেছে, নাথিং ইস নর্ম্যাল… কিচ্ছু না… তার মধ্যে শুধু একটা, একটা জিনিস আছে যেটা আমাকে একটু নর্ম্যালসির আভাস দেয়, সেটা নিয়ে তুই ফালতু একটা ইস্যু তৈরী করছিস।”
-“কিছু নর্ম্যাল নেই, থাকতেও হবে না, তুই তোর ফোনের মধ্যে নর্ম্যাল খোঁজ, আমি পারছি না তোর সাথে একঘরে থাকতে।“
এই বলে অসীমাভ সিধে দরজা খুলে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল। শ্বেতাংশু তাকে আটকাবার জন্য পেছন পেছন ছুটল, আর মৈনাক দু’হাতে মাথার চুল খামচে ধরে বিছানায় বসে পড়ল। তার প্রচন্ড ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে।
ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে অসীমাভ কোনো দিকে না তাকিয়ে বাঁ দিকে ধরে এগিয়ে গেল কারণ ডানদিক বা সোজা গেলে স্যারের ঘরের দৃষ্টিপথে আসতে হবে; তার পেছন পেছন শ্বেতাংশু।
-“অ্যাই অসীম… থাম… কি পাগলামো করছিস রাত্তিরবেলা ? আরে বাবা রিসর্ট থেকে বেরোস না…”
-“তুই যা তো, ঘরে যা, তোকে ভাবতে হবে না…”
এই বলে হন হন করে তাদের কটেজের বাঁ দিক ধরে রিসর্টের সীমানা ছাড়িয়ে বেরিয়ে যায় অসীমাভ। বন্ধুকৃত্যের টানে শ্বেতাংশুকেও যেতে হয় তার পেছন পেছন।
-“এই অসীম… কি ছেলেমানুষী করছিস মাইরি ! এই আর যাস না… স্যার দেখতে পেলে দু’জনেরই পিঠের ছাল তুলে নেবে… এই আর যাস না। থাম না রে ভাই… আরে থাম রে…”
অসীমাভ এবার কিছু না বলে, পাশে শোয়ানো একটা গুঁড়ির ওপর বসে পড়ে।
-“একটা মেয়ে, একটা জলজ্যান্ত ছেলেকে ফুল পাগল করে দিল… মানে বদ্ধ উন্মাদ। ভাব, ছেলে সত্যি সত্যি ভূত দেখছে… তোর খেয়াল আছে, পরশু রাতে ইনিয়ে বিনিয়ে ভূতের গল্প করছিল ? মানে এমনই মানসিক অবস্থা, ছেলে হ্যালুসিনেট করছে। ভাবতে পারিস ?”
শ্বেতাংশু হাঁপাতে হাঁপাতে তার পাশে বসে পড়ে।
-“সবই বুঝলাম ভাই; কিন্তু ওকে একটু সময় তো দিতে হবে ? লোকে বলে তিন বছরের রিলেশনের জের কাটতে বছরখানেক তো লাগবেই। সে তো আর রাতারাতি হয়ে যাবে না!”
-“হ্যাঁ, তাই সার্ভেতে এসে এখন দিনরাত এস এম এস করে নিজের মাথা খাবে, আর আমাদেরও মুড নষ্ট করবে।”
-“আচ্ছা, ঠিক আছে। মানছি ওর দোষ, কিন্তু এখন ফেরত চল। এখানে থাকবি নাকি সারারাত ?”
-“হ্যাঁ, না থাকার কি আছে ? ওপরে আকাশ, নিচে ঘাস…”
-“স্যার উঠে এলে কিন্তু পুরো বাঁশ ভাই… ঘরে চল, প্লিজ। জেদ করিস না…”
-“দাঁড়া, যাচ্ছি, আগে একটু হাওয়া খেয়ে নি…”
কথাটা বলে থামে দু’জনেই। কাল রাত থেকে বৃষ্টি হওয়ার পর থেকে সারাদিন, এমনকি খেয়ে ঘরে যাওয়ার সময় পর্যন্ত ফুরফুরে ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছিল। কিন্তু এখন সেটা আর নেই। কোনো হাওয়া নেই, আকাশের তারাগুলোকেও কোনফাঁকে একঝাঁক মেঘ এসে ঢেকে ফেলেছে যেন। বাতাস নেই, তাই বাতাসের শব্দও নেই, শুধু তাই নয়, এবার দু’জনে খেয়াল করল, চারপাশে প্রকৃতপক্ষেই পিন ড্রপ সাইলেন্স। ঘন্টিপোকা ডাকছে না, রাতচরা পাখি, কোনো জন্তু, এমনকি সামান্য পাতানড়ার শব্দও নেই। কেমন গা শিরশিরে নীরবতা চারদিকে।
যেখানে ওরা বসেছিল, সেখান থেকে একটু দুরেই, সামনে দূর্ভেদ্য জঙ্গল। সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল দু’জনের। মনে হল, সামনের জঙ্গলটা যেন এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। তাও আস্তে নয়, যেন প্রচন্ড বেগে গোটা জঙ্গলটা এগিয়ে এসে পিষে দিতে চাইছে ওদের দু’জনকে। সেই অনুভূতি বলে বোঝানোর নয়। অসীমাভ মুখটা আকাশের দিকে তুলছিল আস্তে আস্তে। কিন্তু তার মনে হল, ওপরে তাকালে দেখবে, গোটা আকাশটা যেন নেমে আসতে চাইছে ওদের দু’জনের মাথার ওপর। অসীমাভ হাতড়ে শ্বেতাংশুর হাতটা খুঁজে সেটা ধরে বুঝতে পারল শ্বেতাংশু কাঁপছে।
এত ভয় অসীমাভও পায়নি জীবনে কোনোদিন। সে সামনের দিকে তাকাল, আর জঙ্গলের ঠিক মাঝখানে দেখতে পেল দু’টো জ্বলন্ত চোখ। কোন জন্তু ওটা ? আলো ফেললে বোঝা যেত হয়তো… কিন্তু আলো ফেলার দরকার হয়না; একটুখানি তাকিয়ে থাকার পরই পরিষ্কার বোঝা যায়, ওই চোখদুটোর মালিক মনুষ্যাকৃতি কোনো প্রানী। অসীমাভ আর সহ্য করতে পারে না, শ্বেতাংশুর হাতটা খামচে ধরে ছিলই, এবার সে চোখ বন্ধ করে ফেলল, কিন্তু বন্ধ চোখ যেন মনের ভয়টাকে আরো অনেকগুন বাড়িয়ে দেয়। আর চোখ খুলেই সে দেখতে পায়;
জঙ্গল জঙ্গলের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে। জ্বলন্ত চোখদু’টোও আর নেই। বাতাসে পাতা নড়ার ঝিরঝির শব্দকে যোগ্য সঙ্গত করছে ঘন্টিপোকার কানে তালা ধরানো শব্দ। কোন আতঙ্ক, কোনো অলৌকিকের লেশমাত্র নেই সেখানে। শুধু সবকিছু ছাপিয়ে দামামার মতো বাজছে তাদের দু’জনের হৃৎপিন্ড।
Pingback: Somewhere In the Jungle of North Bengal… Part XI – Libberish