ক্যলাকাটা ইউনিভার্সিটিতে অনার্স পড়ার চেয়ে অনেক সময় মনে হয় লটারির টিকিট কাটা ভালো ছিল। কথাটা বলছি কারণ, নিজে কখনো তিন বছর পর পর এরকম ধারাবাহিকভাবে রেজাল্ট খারাপ জীবনে কখনো হয়নি। শেষমেষ তৃতীয় বছর রেজাল্ট খারাপ করার পর, যখন ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছি না, কেন এই দূরবস্থা, তখনই এই গল্পটা লেখা। মানে ২০১৩ সালে। তা নতুন দশকের শুরুতে ৭ বছর আগের গল্পের শিশুসুলভ চপলতা এবং প্রগলভতাগুলো আশাকরি আমার অত সীমিত সংখ্যক পাঠকেরা ক্ষমা করে দেবেন।
এবং, অবশ্যই, এই গল্পটা মনে মনে উৎসর্গ করেছিলাম, সত্যজিৎ রায়কে। এবং গতবছর বাংলা ই-পত্রিকা ‘ব্ল্যাকবোর্ড’-এ লেখাটি প্রকাশিতও হয়েছে।
ট্রেনের কামরায় একটা সীটে কোনও রকমে বসে ঘুপচি গরমে সিদ্ধ হতে হতে সোমনাথ ভাবছিল, বাড়ি গিয়ে কোন মুখে দাঁড়াবে মা-বাবার সামনে… মা বাবা ভাইয়ের ব্যাপারটা তো মানা যায়। কিন্তু তিতলি ? কত বড়মুখ করে সবাইকে কত বড় বড় কথা বলে, বাবার সঙ্গে তো প্রায় হাতাহাতি করে কোলকাতায় গেছিল, ফিজিক্স পড়তে। স্কুলের স্যারেরা অবশ্য বলেছিলেন, “তোর হবে। লেগে থাক ফিজিক্স নিয়ে।” কিন্তু সেসব অনেক আগের কথা। তিন তিন বছর পর পর খারাপ রেজাল্ট করার পর, আর প্রথম দু’বছর ইউনিভার্সিটি কে দোষ দিলেও, শেষে আজ মনে হচ্ছে, সব তারই দোষ। তার দোষেই প্রতি বছর রেজাল্ট খারাপ হয়েছে, সে ফিজিক্স কিসসু বোঝে না। ট্রেনের ভীড়ে দম বন্ধ হয়ে আসছে, না তার চারপাশের পৃথিবীটা ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে, বুঝতে পারছে না।
বর্ধমান থেকে একটু ভেতরে যেতে হয় স্টেশন থেকে বাস ধরতে হয় আবার। গ্রামে তার বাড়িতে যখন ঢুকল সোমনাথ তখন রাত আটটা। কারোর সাথে প্রায় কিছু কথাই হয়নি তার। মা ভাত দিয়েছে, খেয়ে শুয়ে পড়েছে সে। আর অদ্ভুত এক অস্বস্তিতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে, খেয়াল নেই। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাবার সাথে দেখা। বাবার সাথে ঝগড়াঝাঁটি করে ফিজিক্স পড়তে গেলেও, বাবা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেন না কখনোই। সাধারন ভাবেই জিজ্ঞাসা করলেন,
-“এবার কি করবি ভাবছিস?”
-“এম. এস. সি-ই করবো বাবা, কয়েক জায়গায় পরীক্ষা দিয়েছি। দেখি সেখানে কি বলে।”
-“বেশ, তবে আমার মনে হয় ওসব না ভেবে, এবার ব্যাবসাটা দেখ। আমার তো বয়স হচ্ছে। আর তোর ভাই তো মাধ্যমিক-ও পাস করেনি। তুই না দেখলে…”
-“ব্যবসা আমার দ্বারা হবে না বাবা, ওসব আমি পারব না। আমি আরও পড়াশোনা করতে চাই। এম.এস.সি পেয়ে যাব কোথাও না কোথাও।”
বাবা একটু অসন্তুষ্ট হয়েছেন বোঝা গেল, তবে তিনি আর কোনও কথা না বলে চলে গেলেন। মা বিশেষ কিছু বলেননি, তবে আকারে ইঙ্গিতে বার বার বোঝাতে চেয়েছেন যে ছেলের ভবিষ্যত নিয়ে তিনি কতটা চিন্তিত। তিতলির সাথে দেখা হল দুপুরে। সে কাছেরই কলেজ থেকে বাংলা নিয়ে পরছিল, তার রেজাল্ট খুবই ভালো হয়েছে, এমনিতেই তিতলি পড়াশোনা ছাড়া আর কিছুই করে না বলতে গেলে।
-“আবার দিলি তো? সত্যি, খালি গান গেয়ে বেড়া দিনরাত। পড়াশোনা তো করিস না।”
-“বা রে! কোথায় দিনরাত গান গেয়ে বেড়ালাম? মোটে তো তিনটে কম্পিটিশনে নাম দিয়েছিলাম। আর ফার্স্টও তো হয়েছি তাতে।”
-“কৃতার্থ করে দিয়েছ আমাকে। রেজাল্টের কি হবে?”
এবার একটু বেশীই দুঃখ পেল সোমনাথ। সেটা বুঝতে পেরে তিতলিও তাড়াতাড়ি এগিয়ে এল ওর দিকে। দুগালে দুটো হাত দিয়ে সোমনাথের মুখটা ওর দিকে ঘুরিয়ে বলল,
-“আচ্ছা বাবা, সরি। রাগ করিস না প্লিজ। তোর রেজাল্ট খারাপ হলে আমার কতটা কষ্ট হয় বুঝিস তো?”
সোমনাথ মাথা নেড়ে সায় দেয়।
গ্রামের ভেতর দিকে, একটা বাঁশবাগান আছে। সেটার ধারে বসে হাওয়ায় বাঁশ পাতার শব্দ শুনতে ভারী ভালো লাগে সোমনাথের। বিকেলে সেখানে বসে আছে চোখ বুজে, মনটা এখন অনেকটা হালকা হয়ে গেছে। হঠাৎ একটা অচেনা গলার ডাকে, চমকে উঠে সামনের দিকে তাকাল সোমনাথ।
-“কী হে ছোকরা, ব্যাপার কী? চোখবুজে বাঁশবনের কানা ডোম সেজে বসে আছো নাকি?”
একটা অচেনা লোক দাঁড়িয়ে আছে সোমানাথের সামনে। লম্বা, ফরসা, বেশ শার্প চেহারা।
এরকম অদ্ভুত প্রশ্নে বেশ বিরক্তই হল সোমনাথ। বলল,
-“ডোম সাজতে যাব কেন? এমনি বসে আছি। এ জায়গাটা ভালো লাগে।”
-“মন খারাপ? কেন রেজাল্ট খারাপ হয়েছে বুঝি?”
সোমনাথ এবার বেশ রেগে মেগে বলে ওঠে,
-“আপনি কে বলুন তো? এত প্রশ্ন করছেন তখন থেকে?”
লোকটা মুচকি হেসে, সোমনাথের পাশে বসল। পাঞ্জাবীর পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল,
-“আজকালকার ছেলেপুলে, বললে কি আর বিশ্বাস করবে, সবতো খালি এটা মানি না, সেটা মানি না, হ্যানা বিশ্বাস করি না, ত্যানা বিশ্বাস করি না…”
-“এই আপনি না বড্ড বাজে বকে চলেছেন তখন থেকে। আপনি কে বলুন দেখি, বিশ্বাস করি কিনা ভেবে দেখব।”
-“বটে? আমি ভূতের রাজা।”

-“ইয়ার্কি মারার জায়গা পাননি?”
-“দেখেছ! বললাম, আজকালকার ছেলেপুলে, এসব মানবে কেন? যত্তসব নাস্তিকের দল।”
-“দেখুন, ফাজলামির একটা লিমিট আছে। আমি পড়াশোনা শিখেছি, কচি খোকা নই, আর আপনি এন্তার ঢপ দিয়ে যাবেন আমায়, আমি বিশ্বাস করে নেব?”
-“কোর না, কে বিশ্বাস করতে বলেছে? গুপি আর বাঘার মত লক্ষী ছেলে আর কটা পাওয়া যায়। এখনকার দিনে তো অসম্ভব।”
হঠাৎ সোমনাথের মনে হল, মজার লোকতো। ঢপ দিচ্ছে দিক, দেখি কোথাকার জল কোথায় গড়ায়। সে বলে উঠল,
-“বিশ্বাস কি করে করব? সবাই জানে ভূতের রাজাকে কেমন দেখতে, আর আপনি দুম করে এসে বলছেন আপনিই তিনি। আপনাকে দেখে তো দিব্যি মানুষ বলে বোঝা যাচ্ছে।”
-“অই। মানিকবাবু আমার সব্বনাশটি করে গেছেন। তিনি তো দিব্যি আলোর তারা-ফারা দিয়ে একটা ফিলিম বানিয়ে দিলেন, আর লোকে ভাবে আমি ওইভাবে আসব। এ কি ফাজলামি না কি? শোন হে ছোকরা, চোখ খুলে আমার বদলে যদি দেখতে, নাকি সুরে গান গাইতে গাইতে একটা আলোর তারা নাচতে নাচতে আসছে, তাহলে কি তুমি এখানে বসে আমার সাথে কথা বলতে, না দৌড় মারতে, অ্যাঁ ?”
না, যুক্তিটা মন্দ বলেনি। ভূতের রাজা হোক ছাই না হোক বুদ্ধি আছে। সোমনাথ এবার একটু মুচকি হেসে ফেলে, বলে,
-“বেশ, বুঝলাম, আপনিই না হয় ভূতের রাজা। কিন্তু আমার কাছে কি প্রয়োজনে আসা মহারাজ?”
-“আমার আর কি প্রয়োজন? প্রয়োজন তো তোর। রেজাল্ট তো খারাপ করেছিস। এখন?”
আচ্ছা মুশকিল! সোমনাথের রেজাল্ট খারাপ হয়েছে, এ জানল কি করে? অবশ্য হতে পারে! ভূতের রাজা তো? হয়তো অন্তর্যামী! সোমনাথ মনে মনে হেসে বলল,
-“এখন আর কি? পটাপট তিনটে বর দিয়ে ফেলুন, তাহলেই তো আমার আর খাওয়া পড়ার চিন্তা থাকে না। ওই যে, কি যেন, ‘যা চাই পড়তে খাইতে পারি, যেখানে খুশি যাইতে পারি’ গানটা মোটামুটি গাইতে পারি, ওটার বদলে বরং অন্যকিছু দিয়ে দেবেন।”
-“তুমি মাইরি, এক নম্বরের গাড়োল। ফিজিক্সের কিসসু বোঝো না। কি যেন বলে, ‘ভরের নিত্যতা সুত্র’ পড়িসনি? গোটা ব্রম্ভান্ডে যদি ভরের পরিমাণ সবসময় এক হয়, তাহলে, হাওয়া থেকে খাবার কি করে তৈরী করা যাবে শুনি? তাতে তাপগতিবিদ্যার মেরুদন্ড ভেঙ্গে যাবে না?”
সোমনাথ এবার চোখ গোলগোল করে অবাক গলায় বলল,
-“বাব্বা! রাজামশাইয়ের বিজ্ঞানের জ্ঞান তো বেশ টনটনে দেখছি! কিন্তু একটা ভূত হওয়া মানেই তো ফিজিক্সের নিয়ম ভাঙা, তাই না?”
-“তোমার মুন্ডু। বলি কোয়ান্টাম মেকানিক্স পড়িসনি? ওয়েভ ফাংশান কাকে বলে? মরা মানে কি? মরা মানে ওয়েভ ফাংশান-এর একটা আমুল পরিবর্তন। অর্থাৎ তখন আর সেটা সময়ের ওপর নির্ভর করে না। চিরন্তন হয়ে যায়। মানে যাকে বলে ‘টাইম ইন্ডিপেনডেন্ট’।”
সোমনাথ এবার বেশ অবাক হল। কারণ শক্তির নিত্যতা সূত্র ক্লাস নাইন-টেনের বাচ্চাও জানে। তা বলে কোয়ান্টাম মেকানিক্স? সে তো এলেবেলের কর্ম নয়। তাই লোকটার প্রতি বেশ উৎসাহিত হয়ে পড়ল সোমনাথ। হাসি হাসি মুখে বলে উঠল,
-“আরিব্বাস! রাজামশাই তো দেখছি ফিজিক্স গুলে খেয়েছেন একেবারে! তা রাজামশাই, কোথা থেকে এত জ্ঞানের ভান্ডার হলেন?”
লোকটি এবার হেসে বলল,
-“আমার জ্ঞান কই রে? এ তো তোরই জ্ঞান। ভেবে দেখ তো, তোর জ্ঞানের বাইরে কিছু বলেছি কি আমি?”
সোমনাথ এবার ইচ্ছে করে, নীজের মুখটা গোমড়া করে বলল,
-“তাহলে বলুন আমাকে বর টর দেওয়ার কোনও ইচ্ছাই আপনার নেই। খালি কথার প্যাঁচ কষছেন সেইজন্য।”
-“তুই ছোকরা বড্ড হ্যাংলা দেখছি। কথা নেই, বার্তা নেই খালি বর দাও, বর দাও। আরে এ কি ছেলেখেলা নাকি? যাকে তাকে কি আর বর দেওয়া যায়? আগে তোকে একটু বাজিয়ে টাজিয়ে দেখি, তবে হ্যাঁ, যা মাগ্যির বাজার চলছে, বেশি চাসনে বাবা, একটা বর তোকে দিতে পারি। ও তিনটে বড় অনেক খরচার ব্যাপার।”
-“খরচা? কিসের খরচা?”
-“ওমা, খরচা না? গুপি বাঘাকে তো যা চাই পরতে খাইতে পারি বলে দিলাম, কিন্তু, মুশকিল দেখ। ফিজিক্সের নিয়ম তো ভাঙতে পারবো না, তাই ট্যাঁকের পয়সা খরচা করে খাবারের যোগান দিতে হয়েছে ছেলেদুটোকে। সে কি কম ঝক্কি?”
-“ওওওওওও! তাহলে আপনার অনেক টাকা, বলুন।”
লোকটা এবার এক হাতে চুল আর অন্য হাতে শার্টের কলার ঠিক করতে করতে বেশ ডাঁটের সুরে বলল,
-“রাজা কি আর এমনি এমনি হওয়া যার রে পাগলা, ট্যাঁকের জোর থাকতে হয়।”
তারপর হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে একরকম আঁতকে উঠে বলল,
-“উরিব্বাস! ভোর হয়ে এল রে। আমি উঠি রে, সকালে গিয়ে দরবারে বসতে হবে। আজ আবার মামদোর সাথে মিটিং আছে। চলি রে। কাল দেখা হবে।”
এই বলে লোকটা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে, প্যান্টের পেছনটা ঝেড়ে, বাঁশবনের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। সোমনাথ আরও একটু সন্ধ্যে হওয়া পর্যন্ত বাঁশবনের ধারে বসে রইল, আর একটু আগের ঘটনার কথাগুলো ভাবতে ভাবতে, মুচকি মুচকি হাসতে থাকল।
সেদিন রাতে বিছানায় যাওয়ার আগে পর্যন্ত সোমনাথ লোকটার কথা ভাবতে থাকল, আর হাসিই পেল তার। কে লোকটা? ভূত সেজে কতক্ষণ ধরে গাঁজাখুরি বকে গেল? পাগল, না অন্য কিছু? যাই হোক। লোকটার সাথে সাথে আরও একটা কথা বার বার মনে পড়ে ওর। কোয়ান্টাম মেকানিক্স। কি মনে হতে বইটা খুলে পড়তেও বসে। আর পড়তে পড়তে কি ভাবে যে গোটা রাতটা কেটে যায়, জানতেও পারে না সোমনাথ।
-“ভূতের রাজা??? সে তো তুই নিজেই!” হাসতে হাসতে বলে ওঠে তিতলি।
সোমনাথও হাসতে জবাব দেয়,
-“আর তুই তো একটা পেত্নি।”
-“কেন, শাঁকচুন্নি হলে বেশি খুশি হতিস?”
-“হতামই তো। শাঁকচুন্নি হতে গেলে তোকে আগে আমায় বিয়ে…”
কথাটা শেষ না করতে দিয়েই তিতলি খালি মুড়ির বাটিটা হাতে নিয়ে তাড়া করল সোমনাথ কে।
-“দাঁড়া তোকে মজা দেখাচ্ছি!”
গ্রামে থাকলে এইভাবেই দিনরাত খুনসুটি চলে দুজনের। তিতলির তাড়া খেয়ে মাঠের আল বেয়ে ছুটতে থাকে সোমনাথ, তিতলিও তার পিছু ছাড়ে না। দুজনে অভ্যস্ত পায়ে তীরবেগে ছুটতে থাকে, পেছনে পড়ে থাকে সময়ের ভারে জরাজীর্ণ তাদের গ্রাম। একটা রোগগ্রস্ত নুব্জ বৃদ্ধের মত। যেন পেছনে ফেলে আসা অন্ধকারে হারিয়ে যায়। যেন কোনও উজ্জ্বল আলোর দিকে ছুটে চলে দুজনে। বড়রাস্তার প্রায় কাছাকাছি এসে, হাঁপাতে হাঁপাতে দু’জনে আলের ধারে বসে পরে। তিতলি হাতের বাটিটা দিয়ে দু’ঘা বসিয়ে দেয় সোমনাথের পিঠে।
-“ছেলের সখ কত! বিয়ে করবে! যা গিয়ে পড়তে বস। নাহলে ভূতের রাজা বর দেবে না।”
আবার হেসে ওঠে দু’জনে। আবার শুরু হয় হাতাহাতি মারামারি। একটু বাদে দু’জনে বাড়ি ফেরে। তিতলির কলেজ চলছে তখনো, তাই সোমনাথ বাড়ি ফিরে, কি মনে হতে বই নিয়ে বসে। সারা দুপুর আবার কেটে যায় বই নিয়ে। বিকেলে অদ্ভূতভাবে আবার তার মনে পরে যায় ভূতের রাজার কথা। আর এক অদ্ভূত আকর্ষনে সে হাজির হয় সেই বাঁশঝাড়ের সামনে। কারোর দেখা নেই। অভ্যেসমত বাঁশঝারের সামনে জুত করে বসতে না বসতেই, বাঁশঝাড়ের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসে গতকালের সেই লোকটা। সাজপোশাক একই, মুখে লেগে আছে একটা দুষ্টুমি মেশানো হাসি।
-“কি রে? কাল থেকে খুব পড়ছিস মনে হচ্ছে? কোয়ান্টাম মেকানিক্স?”
সোমনাথ মনে মনে একটু অবাক হলেও, মুখে সেটা প্রকাশ না করেই বলল,
-“আপনি ভূতের রাজা হয়ে আমার সামনে ফিজিক্স কপচাবেন, আর আমি ফিজিক্স পড়লেই দোষ?”
-“না না না না! দোষ কেন? দোষ একেবারেই নয়। পড়া তো ভালো, ৬ দিন বাদে যে পরীক্ষা?”
সোমনাথ এবারে বেশ অবাক হয়ে গেল।
-“পরীক্ষা? কিসের পরীক্ষা? আমার পরীক্ষা তো হয়ে গেছে, রেজাল্ট…”
কথাটা তাকে শেষ না করতে দিয়েই লোকটা বলে উঠল,
-“তোর বি.এস.সি. পরীক্ষা যে হয়ে গেছে, সে কি আর আমি জানি না? আমি বলছি আই.আর.আই এর কথা। সে পরীক্ষা তো ৪ তারিখ?”
এবার সোমনাথ বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। হ্যাঁ, ৬ দিন বাদে সত্যিই ইন্ডিয়ান রিসার্চ ইন্সটিট্যুট-এর এন্ট্রান্স। এম.এস.সি.-এর জন্য। ভুলেই গেছিল সোমনাথ। কিন্তু লোকটা জানল কি করে? সোমনাথ বেশ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,
-“সেটা জানলেন কি করে?”
লোকটা সে প্রশ্নের উত্তরটা দিলে একটু ঘুরিয়ে,
-“আপনি আপনি বন্ধ কর দিকি। আমাকে না হয় রাজা দা বলে ডাকিস। কতই আর বড় হব তোর চেয়ে? খুব বেশী হলে দু-আড়াইশো বছর। আর জানিস না, ভূতের রাজা অন্তর্যামী?”
সোমনাথ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় লোকটা বলে ওঠে,
-“আইনস্তাইনের আপেক্ষিকতাবাদে, সময়ের ধারণাটা ফ্রেমের ওপর নির্ভর করে কেন রে?”
আচমকা এই প্রশ্নে সোমনাথ কি প্রশ্ন করবে ভুলে গিয়ে, এই প্রশ্নের উত্তরটাই দিতে শুরু করে। আর কখন যে সে ফিজিক্সের জগতে ঢুকে পড়ে আবার, নিজেও বুঝতে পারে না।
পরীক্ষা এগিয়ে আসতে থাকে। আই.আর.আই ভারতের অন্যতম বিখ্যাত একটা প্রতিষ্ঠান, সেখানে কোনোরকমে এম.এস.সি. পেয়ে গেলে, সেটা অত্যন্ত ভাগ্যের ব্যাপার হবে। অদ্ভূতভাবে, রোজই ভূতের রাজা কিছু না কিছু বলে তার পড়ার ইচ্ছাটাকে বার বার উস্কে দিচ্ছে।
হ্যাঁ, “ভূতের রাজা”। যার কাছে যাওয়াটা এখন সোমনাথের কাছে নেশা হয়ে গেছে প্রায়। বর পাওয়ার কথা সে ভাবছে না, কারণ সে ভূত, ভগবান বা অতিপ্রাকৃতিক কোনও বিষয়ে বিশ্বাস করে না, আর পাঁচটা শিক্ষিত ছেলের মতই। আসলে লোকটার সঙ্গে কথা বলতে তার বড্ড ভালো লাগে। ফিজিক্সে জ্ঞান যথেষ্ট। হয়তো পড়াশোনা করেছে অনেক। যাই হোক, রোজ বিকেল হলে তাই লোকটার কাছে না গিয়ে থাকতে পারে না। এক এক করে এগিয়ে এল পরীক্ষার দিন। পরীক্ষার আগের দিনই কোলকাতা রওনা হয়ে গেল সোমনাথ। পরীক্ষা দিতে গিয়ে তার মনে হল, শেষ ক’দিন যে পড়াটা পড়েছে, সেটা না হলে এ পরীক্ষা কোনোভাবেই দিতে পারত না সে। বাড়ি ফিরল সেদিনই বিকেলবেলা। তড়িঘড়ি ছুটল বাঁশবনের ধারে। আজ আর অপেক্ষা করতে হল না, সে দেখল রাস্তার ধারে তার জন্যি অপেক্ষা করছে তার রাজা দা। তাকে দেখেই, সেই চিরপরিচিত হাসি হাসি মুখ করে বলল,
-“বাব্বা! ফাটিয়ে দিয়েছিস তো! ইন্টারভিউ কবে?”
-“কি যে বল! আরও কত ছেলেও তো পরীক্ষা দিল, কত কত পারসেন্টেজ! আমার চেয়ে ভালো কত লোক পরীক্ষা দিয়েছে…”
-“সে হোক। ইন্টারভিউ তে তুই ডাক পাবিই। দেখে নিস।”
-“ও হ্যাঁ! ভুলেই তো গেছিলাম! রাজামশাই তো ত্রিকালদর্শী!”
ভূতের রাজার কথা সত্যি প্রমাণ করল, ৩ দিন বাদে অনীশের ফোন। এন্ট্রান্সে সোমনাথ ফিফথ হয়েছে। দু’দিন বাদে ইন্টারভিউ। ভূতের রাজা সে কথা শুনে বলল,
-“আশীর্বাদ করি, তোর জীহ্বায় যেন আইনস্তাইন অধিষ্টান করেন।”
সেই আশীর্বাদের জোরেই কিনা কে জানে, দু’দিন বাদে ইন্টারভিউতে আই.আর.এস.-এর তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীদের অবাক করে দিয়ে, সোমনাথ আই.আর.এস.-এ ফিজিক্সে এম.এস.সি. পেয়ে গেল। তার পরেরদিন, বাড়ি থেকে বিছানাপত্র গুছিয়ে আবার কোলকাতা আসার আগে, ভূতের রাজা দরবারে আবার হাজির হল সোমনাথ। ভূতের রাজাকে মুখ না খুলতে দিয়েই, সে বলল,
-“অনেকদিন তো ভূতগিরি হল, এবার বল দেখি রাজা দা, তুমি কে?”
একথা শুনে বেশ অনেকক্ষণ হাসার পর, সোমনাথের দিকে তাকিয়ে মুখ খুলল সে,
-“আমার না স্বপ্নময় দস্তিদার। আমার বাবার নাম তন্ময় দস্তিদার। আমি পাশের গ্রামে থাকি। আমার বাবা তোর বাবার বিশেষ বন্ধু। ওঁর মুখেই শুনি, যে তোর রেজাল্ট খারাপ হয়েছে। আসলে আমিও ফিজিক্স নিয়ে পড়েছিলাম, আর আমার রেজাল্টও একেবারেই ভালো হয়নি। এম.এস.সি. পেলাম না, গ্রামে ফিরে এসে কিছুদিন বাবার গলগ্রহ হয়ে তারপর একটা মুদির দোকান খুলি। তোর কথা শুনে ভাবলাম, আমার তো হল না, দেখি তোর যদি কোনরকমে হওয়ানো যায়। ফিজিক্সের খবর টবর রাখি এখনো, শখের খাতিরে, তাই তোর পরীক্ষার কথাটাও জানতে পারি।”
সোমনাথ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে স্বপ্নময় আবার বলল,
-“দাঁড়া, দাঁড়া। কথা শেষ হয়নি। তোর বরটা এখনো দেওয়া বাকি আছে।”
এই বলে সোমনাথের মাথা হাত রেখে, “ভূতের রাজা” বলে,
-“এম.এস.সি. তে খুব ভাল রেজাল্ট হবে। আসি রে। বাড়ি গিয়ে আবার দোকান খুলতে হবে।”
সোমনাথ আর কিছু বলার আগেই, স্বপ্নময় রাস্তা থেকে ধানক্ষেতে নেমে, ‘ভূতের রাজা দিল বর’-এর সুরটা গুনগুন করে ভাঁজতে ভাঁজতে, রোজকার মতই, অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।
দু’চোখ জলে ছলছল করছে, তবু মুখের হাসি যেন বাঁধ মানছে না। সোমনাথ পাথরের মূর্তির কত অনেকক্ষণ রাস্তার দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর মন্থরগতিতে হাঁটা দিল বাড়ির দিকে।
স্টেশনে বাবা এসেছিলেন সোমনাথ কে ট্রেনে তুলতে। তখনই সোমনাথের খেয়াল পড়ল।
-“বাবা, পাশের গ্রামের তন্ময় দস্তিদার, তোমার বন্ধু তো?”
-“হ্যাঁ, কেন বলতো ?”
-“আরে, ওনার ছেলেকে একটু মিস্টি খাইয়ে দিতে পারবে? আর বোলো না…”
এই বলে সোমনাথ ভূতের রাজার বর দেওয়ার ঘটনা বৃত্তান্ত বাবাকে বলতে থাকে। কিছুদুর শোনার পরই, সোমনাথের বাবার ভ্রু কুঁচকে যায়, মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। আর কোনও কথা শোনার মত অবস্থায় তিনি থাকেন না। তাঁর মনে পড়ে যায়, তাঁর বন্ধু তন্ময় দস্তিদার আজ মানসিক ভারসাম্যহীন; কারণ তার একমাত্র ছেলে স্বপ্নময় দস্তিদার, আজ থেকে প্রায় ছ’বছর আগেই ট্রেন দূর্ঘটনায় মারা গেছে।
মতামত, গালাগালি, কমেন্ট বক্স, ফেসবুক বা হোয়াটস্যাপ খোলা রইল।
শান্তির আশায়…
নীল…
Hi fi toh! Darun laglo. Tor hobe!
LikeLiked by 1 person