এই মুহুর্তে যদি ভারতে সবথেকে ‘ক্লীশে’ কিছু বিষয় থেকে থাকে, তাহলে সেটা হল নারী সুরক্ষা। এই নিয়ে আমিও হেদিয়ে মরেছি, বহুবার। কিন্তু ক’দিন হল, একটা জিনিস চোখে পড়ল, তাই আমারও আবার কতগুলো কথা মনে হল লেখা দরকার, আর তাই যেখানে ‘ফনী’ আর ভোট নিয়ে বাজার সরগরম, সেখানেও এ ব্যাপারটা নিয়ে না লিখে পারলাম না।
দু’দিন হল, সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা ভিডিও ঘুরে বেড়াচ্ছে। এক মধ্যবয়সী মহিলা চিৎকার করে বলছেন ‘ছোট জামাকাপড় পড়া মেয়েরা ধর্ষিতা হওয়াই উচিত’। এবার এই ভিডিওটা যেখান থেকে শুরু হচ্ছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে, একদল মেয়ে একটি মোবাইল নিয়ে মহিলার পেছন পেছন ঘুরছে, আর বার বার জিজ্ঞেস করছে ‘বলুন না, কি বললেন…’।
আমি জানিনা, ওই মহিলা কি পরিপ্রেক্ষিতে হঠাৎ এরকম মন্তব্য প্রথম করেছিলেন, তবে ব্যাপার হল, এরকম ঘটনা আকছার ঘটছে, শুধু সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে আজকাল সামনে আসছে বেশী। যেসব লোকের জীবনে ইন্টারেস্টিং কিছু ঘটে না, মানে কমবয়সে কেউ তাঁকে গুরুত্ব দেননি, সংস্কৃতি, শিক্ষা, স্বাধীনতা সবকিছুরই বিরাট অভাব ছিল, তাঁদের বয়স একটু বেড়ে গেলে, মাথার পাকা চুলকে হাতিয়ার করে সব ব্যাপারে মতামত দিতে থাকেন, এবং গোটা দুনিয়াটা কিভাবে গোল্লায় যাচ্ছে, সেটা চোখে-আঙুল-দিয়ে দেখানোই তাঁর জীবনের ধর্ম-কর্ম হয়ে ওঠে। ফলাফল হয় মোরাল পুলিসিং, আর সেটা মেট্রোয় যুগল ঠ্যাঙ্গানো থেকে শুরু করে এই ধরনের মতামত পোষন করা অবধি চলে যায়।
ভারতের এক এক রাজ্য এক এক রকম হলেও, সব জায়গাতেই ‘রেপ-কালচার’ কম বেশী আছে। ম্যারিটাল রেপ-এর কথা নাহয় ছেড়েই দিলাম। ভারতীয় কমার্শিয়াল মুভির কথা যদি লক্ষ্য করি, তাহলে দেখতে পাবো, যুগে যুগে বহু সিনেমা হয়েছে, যেগুলো রেপ-রিভেঞ্জ ড্রামা; নয় নয় করে ৪০ শতাংশ তো হবেই। এখন যদি সেই সিনেমাগুলোর কাটামোগুলো যদি পর্যালোচনা করে দেখি, তাহলে দেখা যাবে স্টোরিলাইন মূলত তিনরককমের।
১। নায়িকা রেপ হল, নায়ক তার বদলা নিতে ভিলেনের বংশ ধ্বংস করে দিল, নায়ক-নায়িকার মিলন হল।
২। নায়কের মা/বোন/প্রেমিকা কেউ একটা রেপ/রেপ+খুন হল, তার বদলা নিতে নায়ক ভিলেনের গুষ্টি উদ্ধার করে দিল, শেষে নায়িকা/নতুন নায়িকার সাথে মিলন হল।
৩। সাদাসিধা নায়িকা রেপ হল, কিন্তু তারপরই হয়ে উঠল লাস্যময়ী, মার্শাল আর্ট পারদর্শী সুপারওম্যান। ভিলেনকে হলিউডি স্ল্যাশারের স্টাইলে মারতে মারতে নায়কের দেখা পেল, অথবা সিনেমার শেষে সন্ন্যাসিনী হলে শেষ জীবন মন্দিরে ভজন গেয়ে কাটিয়ে দিল।
ভাবুন, ছাপোষা নায়িকা ধর্ষিতা হওয়ার পরই হয়ে উঠল লাস্যময়ী, শক্তিশালী। যেন রেপ না হলে তার এই ‘এমপাওয়ারমেন্ট’ কোনোদিনই হত না। আর সিনেমার কথা যদি মেনে নি, তাহলে ধর্ষকের শাস্তি হল মৃত্যু, আর সেই মৃত্যুদন্ড দেওয়ার ক্ষমতা যে কারোর আছে; তাই সিনেমার প্রয়োজনে নায়ক/নায়িকাই হয়ে উঠছে জাজ/জুরি/এক্সিকিউশনার।
শুধু সিনেমার কারণেই নয়, আমাদের বিকৃত মানসিকতার জন্য, আমরা অনেকেই মনে করি, ধর্ষণ হল মেয়েদের জন্য শাস্তি। আমরা অনেকেই বলে থাকি,
-“ওই তো জামাকাপড়ের ছিরি! যেদিন রেপ হয়ে যাবে, বুঝবে মজা…”
একটু চিন্তার ধরনটা ভাবুন – কান ধরে দাঁড় করানো > কান ধরে ওঠবোস করানো > কান ধরে হাঁটু মুড়ে বসানো > ধর্ষণ…
আর আমাদের নিজেদের জীবনের সমস্ত না-পাওয়া জিনিস, সমস্ত অযাচিত আশা-আকাঙ্খা, আবার অনেক ক্ষেত্রে অন্যায় কিছু না চেয়েও কিছু না পাওয়া,এই সব এক এক জনের এক এক ভাবে বেরিয়ে আসে। ওই ‘আন্টি’-র কথাই ধরুন না, হয়তো তিনি সারাজীবনে কিছুই করে উঠতে পারেন নি, বাড়ির কড়া শাসন তাকে নিশ্বাস ফেলারও জায়গা দেয়নি। সেই তিনি যদি আজ দেখেন, তাঁর হাঁটুর বয়সী মেয়েরা ভুরি ভুরি স্বাধীনতা পাচ্ছে, তাঁর গায়ে লাগবে না? তাই তো তিনি মুখ ফুটে বলেই ফেললেন-
“Rebel girls deserved to get Raped…”
এখন এই ‘রেবেল’ কথাটির প্রেসঙ্গে আমি আর গেলাম না, কারণ এ ব্যাপারে আমার মতামত জানাতে গেলে একটা গোটা পোস্ট লেগে যাবে। ওটা অন্য কোনো সপ্তাহের জন্য তোলা থাক।
ব্যাপার হল, এই মহিলার এই মতামত নতুন কিছু নয়। আমাদের অনেকের মনের মধ্যেই আছে, ইনি নিজেকে বড় হনু মনে করেন বলে চিৎকার করে বলছেন। আসলে যতই চেষ্টা করি, আমাদের রক্তের গভীরে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের যে ময়লা জমে আছে, সেটা বের করা সোজা নয় কারোর বেশী আছে, কারোর কম আছে। তাই শাড়ি পড়ার পর উন্মুক্ত পেট-পিঠ দেখে আমাদের কালচার আর স্লিভলেশ জামা অশ্লীল মনে হয়। তাই একটা মেয়ের হাঁটু দেখা গেলে, আমাদের মনে হয় তার ‘যোনীপথে’ আক্রমণ করে তার ‘ডানা’ ছেঁটে ফেলা হোক…
এর সত্যিই কোনো সমাধান নেই, যতদিন না, আমরা আমাদের মনের ময়লা পাঁকগুলোকে ‘ওপিনিয়ন’ হিসাবে দেখা বন্ধ করব, আর সেই পাঁক অন্যের গায়ে মাখাতে উদ্যত হব…
শান্তির আশায়…
নীল…