মনে আছে, গত বছর আমার ছোটবেলার দূর্গাপুজোর সাথে এখনকার দূর্গাপুজোর একটা তুলনামূলক আলোচনে করেছিলাম। গোটা পুজোর অনেক স্মৃতির কথা বললেও পুজোর একটা অংশের কথা বলা হয়নি, সেটা হল বিজয়া। আর বিজয়া মানে শুধু বিজয়া দশমীর কথা বলছি না, আমি বলছি ‘বিজয়া সীজনের’ কথা। সেই সময়টার কথা, যখন বিজয়ার শুভেচ্ছা জানাতে আত্মীয়-বন্ধুদের বাড়িতে বাড়িতে যাতায়াত করতে হত । শুধ মেসেজ বা ফেসবুক পোস্ট দিয়ে কাজ সেরে দেওয়া যেত না। আর এই সময়টা আমার অত্যন্ত পচ্ছন্দের সময় ছিল। তার প্রথম এবং সবচেয়ে বড় কারণ হল বাড়িতে লোকজনের যাতায়াত, এবং দ্বিতীয়, এবং প্রধান কারণ হল খাবার। কারোর বাড়ি যাওয়া মানেই খ্যাঁট, আর কেউ বাড়িতে আসা মানেই অন্তত একবাক্স মিষ্টির আগমন।
যাই হোক, বলাই বাহুল্য আমি অত্যন্ত পেটুক শ্রেনীর লোক। তাই খাঁটের চিন্তাটা সবার আগেই আসে। কিন্তু বিজয়ার সময়টা, আমার কাছে একটা ফ্যামিলি গ্যাদারিং, ফ্যামিলি রিইউনিয়নের সময় হয়ে ছিল। কিন্তু ‘ছিল’; মানে অতীতকাল। এখন আর নেই। ফোন-ফেসবুকের দৌলতে এখন কারোরই, ‘সময়’ নেই। মাঝে মাঝে আমার মনে হত আমাকে যেন কোনদিন কাউকে বলতে না হয় ‘আমার সময় নেই’ বা ‘যেতে পারব না রে’। জানি সম্ভব নয়। তবু চেষ্টা করব। আর এই ব্যাপারটা দু’তরফেরই হয়। আমি আমার কথা বলছি; এতদিন আগে বাড়ি বাড়ি যেতাম বলতে আমি, মা, বাবা। এখন কয়েক বছর ধরে বাবা আমার এমন ঘরকুনো হয়ে পড়েছেন, যে মাঝে মাঝে অ্যালান পো-এর গল্পের চরিত্রকে হার মানান। আর তাই অভিমানেই হয়তো অনেকেরই আমাদের বাড়ি আসা কমেছে।
আমার ঠাকুমা মারা যান ২০১৩ সালে। তিনি বেঁচে থাকাকালীন অনেক চেষ্টা করেছিলাম একটা বড় করে গেট-টুগেদার করার। হয়নি। তার দু’টো কারণ। এক, সবাই ব্যাস্ত, আর দুই, দূর্ভাগ্যক্রমে আমাদের বাড়ির সবথেকে ছোট সদস্য বলে আমার কথায় কেই গুরুত্ব দেয় না। যাই হোক। ঠাকুমার অসুস্থতাকালীন অনেকবার গেট-টুগেদারের চেষ্টা করার পর তিনি যখন মারা গেলেন, তখন শ্মশানে আর শ্রাদ্ধে প্রচুর লোক হয়েছিল। সত্যি কথা বলতে কি তখন প্রচুর রাগ হয়েছিল মনে মনে। কিন্তু কিছু বলতে পারিনি। কারণ, ওই… বয়েস।
আমি জানি, একদিনে, এক সময়ে সবার জড় হওয়া একটা কঠিন ব্যাপার। কিন্তু অসম্ভব নয়। নাহলে বিয়েবাড়ি শ্রাদ্ধবাড়িতে ভীড়ই হত না। আসলে, দিন দিন আমরা বড্ড ফর্মালিটি করতে শিখে যাচ্ছি। তাই একটা ছাপা কার্ড পেলেই যেন যাওয়াটা কর্তব্যের মধ্যে পড়ে যায়। কেউ যদি ফোনে বলে ‘একদিন চলে আয় না’… তখনই ব্যাপারটার গুরুত্ব কমে যায় যেন। তাই আমরা ফেসবুক আর হোয়াটস্যাপ-এ বিজয়ার প্রীতি, শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা পাঠিয়ে হাত ধুয়ে ফেলি।
সম্পর্কগুলোও দিন দিন জটিল হয়ে যাচ্ছে। শুধু সময়ের ভারেই যদি সম্পর্ক মাপা হত, তাহলে সব মা বাবাই বুঝে যেত তার ছেলে তাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাবে কি না। কারন মা-বাবা তো ছেলেকে ‘জন্ম থেকেই চেনে’। শুধু বন্ধুত্ব কেন, অনেক ক্ষেত্রে আত্মীয়তার ব্যাপারেও একই ঘটনা ঘটতে দেখেছি। কখনো অনেক বছর ধরে বন্ধুত্ব থাকার পড়ও, দুরত্ব এমন জায়গায় চলে যায়, যেখানে ফেরার আর কোনও রাস্তা থাকে না। আর দু’দিনের বন্ধুত্ব ম্যারিয়ানা ট্রেঞ্চের চেয়ে গভীর হয়ে গিয়ে, বন্ধুরা মা-বাবার আসনেও বসে যায়। সবার মনের চিন্তা একটাই। ‘আমি তোমার থেকে অনেক কিছু এক্সপেক্ট করি কিন্তু তুমি আমার থেকে কিছু এক্সপেক্ট কোর না’। তোমার ছোট ছোট ভুলগুলোকে আমি মহিরুহ করে মনে রাখব। আর যখন তোমাকে আমার প্রয়োজন ছিল তখন তুমি কি করেছ, সেটা অপ্রাসঙ্গিক।
আমি জানি, আমার মত খ্যাঁটনবাজ, নিষ্কর্মা উজবুকের কথার কেউ ধার ধারে না, আর কেউ গুরুত্বও দেয় না। আর আমার পরিবারের যারা সত্যিই ব্লগটা পড়ে, তাদের প্রতি ওপরের কথাগুলো প্রযোজ্য নয় (আশাকরি!)। তাই আমি অকুতোভয় হয়ে এই কথাগুলো লিখতে পারছি।
কালই দশমী গেছে, এখনো কিছু পোস্ট করিনি, কেন কারণটাই এতক্ষণ ধরে লিখলাম। তবু, কেউ যদি এতক্ষণ ধরে আমার লেখাটা ধৈর্য্য ধরে পড়ে থাকেন; তাকে একটা বিজয়ার শুভেচ্ছা না জানালে বড়ই গর্হিত অপরাধ হবে। তাই, শুভ বিজয়া।
শান্তির আশায়…
নীল…