আমি ‘Cherry Bomb’ বা হালে ‘প্রতুলের ডায়েরী ‘ছাড়া, লিবারিশে গল্প লিখিনি। আসলে গল্প লেখার মাধ্যম হিসাবে লিবারিশটাকে ব্যবহার করব ভাবিনি। কিন্তু ছাপা বই কালচারটা যেভাবে দিন দিন কমে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে আপনা হাত জগন্নাথ করাটাই ভবিষ্যত-প্রামাণ্য। তাই মাঝে মাঝে এখন থেকে দু একটা গপ্পো এখানে পাবেন, আজ থেকেই তার শুরু…
আর কিছু না, নিম ঝোল। শুধুমাত্র নিম ঝোল নিয়ে যে এরকম একটা মহাভারত হয়ে যেতে পারে, সেটা সন্দীপ স্বপ্নেও আন্দাজ করতে পারেনি। নিম ঝোল কথাটা শুনে পাঠকদের যাদের মনে কৌতূহল উদ্রেক হয়েছে, তাদের জন্য বলি, নিম ঝোল জিনিসটা ঠিক কি; আসলে, এটা শুক্তোর একটা উন্নততর সংস্করণ, যেখানে সমস্ত আনাজের সাথে মানে, কাঁচকলা, রাঙ্গালু, পেঁপে-এর সাথে নিমপাতা দেওয়া হয়, আর এখানে নিমপাতাই হল তিক্ত স্বাদের একমাত্র উৎস।
যাকগে, নিম ঝোলকে তো না হয় সংজ্ঞায়িত করা গেল; এবার নিম ঝোলের সাথে স্বেচ্ছাচারিতার কি সম্পর্ক, সেই কথাতেই আসি।
সন্দীপের বয়স নেহাত কম হল না, মানে কলেজ শেষ করে এখন ইউনিভার্সিটি। আর যেদিনটার কথা বলছি, সেদিন সন্দীপের ডিপার্টমেন্ট এ সেমিনার ছিল। স্যার বলে দিয়েছেন,
-“ওইদিন সকাল ১০টার মধ্যে আমার ঘরে হাজিরা চাই, নইলে ক্ষমা নাই।”
তাই বাড়ি ফিরেই সন্দীপ মা কে জানিয়ে দিয়েছে
-“কাল সকাল ৯টার মধ্যে আমি বেরোবো, দুপুরে খাব না, সকালে জলখাবারটা একটু ভারী করে দিয়ে দিও।”
আর তারপর নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়েছে। সকালে উঠে ঠিক পৌনে ৯টায় গিয়ে খাবার টেবিলে বসেও পড়েছে। কিন্তু ঝামেলাটা বাধল তারপরেই। জলখাবার তৈরী; আর জলখাবার বলতে একথালা ফল, একবাটি কর্ণফ্লেস্ক, চারপিস পাঁউরুটি। এ পর্যন্ত কোনও সমস্যাই ছিল না, কিন্তু সন্দীপ কলাতে কামড়টা ঠিক করে বসিয়েছে কি বসায়নি, মা একটা ভারী কাঁসার বাটি এনে সামনে বসিয়ে দিয়ে বললেন,
-“এই নে। দুপুরে ভাত খাবি না বললি, একটু নিম ঝোল খেয়ে যা।”
এই কথাটা শুনে সন্দীপের মুখটা এতবড় হাঁ হয়ে গেল, যে আধকামড়ানো কলাটা বুকে দাঁতালো অত্যাচারের দাগ নিয়ে টপ করে মুখ থেকে প্লেটের ওপর ঝরে পড়ল। ব্যাপারটা ঠিক করে বোঝার পর, সন্দীপ কোনোরকমে বলে উঠল,
-“মানে ? আমি জলখাবারে নিম ঝোল খাব ? পাগল ঠাওরেছো নাকি ?”
-“খেয়ে নে বাবা, লক্ষ্মী ছেলে আমার। দুদিন বাদেই আর নিম খাওয়া যাবে না, ফাল্গুন মাস শেষ হয়ে যাবে কিনা”
-“দেখ মা, ভাতের সাথে দিলে তো সোনামুখ করে খেয়ে নি। কিন্তু তা বলে জলখাবারে ? ইম্পসিবল !”
-“অত না বকে খেয়ে নে। দেরী হয়ে যাচ্ছে না তোর।”
-“হ্যাঁ, খাচ্ছি, কিন্তু নিমঝোল খাব না।”
-“তুই আজকাল বড় অবাধ্য হয়ে গেছিস।”
সন্দীপ চুপ করে গিয়ে আহত কলাটাকে গলাধঃকরন করে। মা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় সন্দীপের ভাইপো ঘরে ঢোকে ঝরের বেগে।
-“দিদা খেতে দাও। জলখাবার খেয়ে বেরোবো।”
মা কিছু বলার আগেই, সন্দীপ বলে ওঠে,
-“ও জলখাবার খাবি ? এ নে, মুড়ি দিয়ে নিম ঝোল খা।”
-“নিম ঝোল ? ইসসস ! আমি তো ব্রেড অ্যান্ড বাটার খাব।”
সন্দীপ ইঙ্গিতপূর্ণ চোখে মায়ের দিকে তাকায়। মা কোনও কথা না বলে সোজা রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। তারপর সেখান থেকে চেঁচিয়ে বলে,
-“ভাল চাস তো খেয়ে নে, নাহলে বাবা কে ডাকব বলে দিলাম।”
সন্দীপ মনে মনে ভাবে, সে তুমি যাকেই ডাক না কেন, আমার পক্ষে সকালবেলা নিম ঝোল খাওয়া সম্ভব নয়। সন্দীপ তার খাবার শেষ করার দিকে মন দেয়। খাবারের মধ্যপথে ঘরে একসাথে ঢোকে মা আর দিদি। আবার সুযোগ পেয়ে সন্দীপ বলে ওঠে,
-“দিদি, এই নে, বেরোনোর আগে একটু নিম ঝোল খেয়ে যা।”
এর উত্তরে দিদি কোনো কথা না বলে শুধু নাক সিঁটকায়। ব্যাপারটা দেখে মায়ের সমস্ত রাগটা গিয়ে পড়ল সন্দীপের ওপর।
-“বাবু, নিম ঝোলটা না খেলে বুঝব তুই আমাকে একটুও ভালবাসিস না”
বটে ? ইমোশানাল ব্ল্যাকমেল ? সন্দীপও বেশ রেগে মেগে বলে ওঠে;
-“ওসব ইমোশানাল ব্ল্যাকমেল করে আমায় কিছু হবে না! আমি এখন নিম ঝোল খেতে পারব না, ব্যাস! মাঝে মাঝে না, তুমি একেবারে দাবীর গাছ হয়ে ওঠো! মানে নাড়া দিলে দাবী ঝড়ে ঝড়ে পড়ে।”
-“আর তোরও স্বেচ্ছাচারিতার কোনো শেষ নেই ! তুই তো স্বেচ্ছাচারিতার মহীরুহ!”
সন্দীপ চোখ ছানাবড়া করে কি একটা বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় পেছন থেকে একটা গুরুগম্ভীর গলা শোনা গেল।
-“সক্কালবেলা মা ছেলেতে কি আরম্ভ করলে বল দেখি ? গোটা বাড়ি মাথায় তুলেছ ?”
গলাটা বাবার! সন্দীপ মনে মনে ভাবল ‘হয়ে গেল’।
বাবা ঘরে ঢুকতেই সব চুপ। বাবার হাতে একটা কাপ, সেটার মধ্যে চামচ নেড়ে নেড়ে কিছু গুলছেন। সন্দীপের মনে পড়ল, আজ তো সোমবার! আর বাবা কোন এক আয়ূর্বেদিক বই পড়ার পর থেকে, গত এক মাস তাকে দুধে গুলে হলুদগুঁড়ো আর কি সব যেন খাওয়াচ্ছেন তাকে প্রতি সোমবার করে। কাপটা সন্দীপের সামনে বসিয়ে দিয়ে বাবা বললেন,
-“নে, খেয়ে ফেল, শেষ চুমুক দেওয়ার আগে ভাল করে গুলে নিবি, শেষের কাঁথ টা যেন বাদ না যায়।”
কিন্তু তারপরই বাবার চোখে পড়ে নিমঝোলের বাটির দিকে! বাবা বেশ রাগত স্বরে বলে ওঠেন,
-“এ কি ! তুমি ওকে এখন নিম ঝোল দিয়েছ? জানো না, হলুদ খাওয়ার পর তেতো খেতে নেই, গুন নাশ হয় ?”
-“কে বলেছে, মোটেও না!”
-“কে বলেছে? আমি পরিস্কার দেখলাম অমুক বইতে লেখা আছে!”
এটা বাবার মূদ্রাদোষ; প্রয়োজনীয় কথা প্রায়শই ভুলে যান, আর সেখানে অমুক জুড়ে দেন, অঙ্কের ‘এক্স’ এর মত।
-“না! হতেই পারে না, তুমি ভুল দেখেছ; নিম ঝোলে কি হলুদ পড়ে না? গুন কেন নষ্ট হবে ?”
সন্দীপ বলতে যাচ্ছিল, গুন নাশ হোক আর ছাই না হোক, সকালবেলা এক কাপ হলুদ মেশানো দুধ খাওয়া গেলেও, এক বাটি নিম ঝোল খাওয়া অসম্ভব। কিন্তু সে মুখ খোলার সুযোগও পেল না, মা আর বাবার নিম এবং হলুদ নিয়ে দাম্পত্য কলহ বেধে গেল ধুন্ধুমার। সন্দীপের মনে পড়ল, ঘড়িতে বাজছে ন’টা কুড়ি, তাই সে অবশিষ্ট খাবার আর হলদে দুধ শেষ করছে, এমন সময় শুনতে পেল, বাবা বলছেন,

-“না না, তা বলে তুমি আমাকে না জিজ্ঞাসা করে সন্তুকে সকালবেলা অমুক ঝোল দেবে ? তোমার স্বেচ্ছাচারিতার তো দেখছি কোনও অন্ত নেই…”
সন্দীপ বুঝল, এক্ষুণি না বেরোলে, কে কতটা স্বেচ্ছাচারী, এই নিয়ে একটা অঘোষিত তর্কসভায় তাকে যোগদান করতে হবে, আর তার ডিপার্টমেন্টাল সেমিনার ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাঠ-ময়দান হয়ে যাবে। দিদি বেগতিক বুঝে আগে ভাগেই পালিয়েছে। এই ভেবে, যেই না উঠতে যাবে, সঙ্গে সঙ্গে ঘরে তৃতীয় কন্ঠের আবির্ভাব ঘটল। কন্ঠের মালিক, থুড়ি, মালকিন সন্দীপের ঠাকুমা মানদাসুন্দরী দেবী।
-“বৌমা! জিতু! কি আরম্ভ করেছিস তোরা ? আমাকে শান্তিতে একটু জপটাও করতে দিবি না ?”
বাবা আর মা দুজনেই বিপন্ন ভাবে অনেক কিছু ঠাকুরমাকে বোঝাতে গেলেন, কিন্তু দুজনের কথার মধ্যে ঠিক দুটো শব্দই শোনা গেল। এক “নিম ঝোল” দুই “হলুদ”। আর তাই শুনেই ঠাকুমা আর্তনাদ করে উঠলেন।
-“নিম ঝোল ! গতকাল ফাল্গুন মাস শেষ হয়ে গেল, আর আজ তোমরা সন্তুকে নিম ঝোল খাওয়াচ্ছো ? ছেলেটাকে কি তোমরা মেরেই ফেলবে ?”
এই মেরেছে রে ! এবার ব্যাপারটা অন্য দিকে গড়াচ্ছে, ওদিকে ঘড়িতে ৯টা ৩৫, এখন না বেরোলে কেলেঙ্কারি! এই ভেবেই সন্দীপ চেয়ার ছেড়ে উঠতে যায়। কিন্তু তৎক্ষণাৎ বাবা তার কাঁধে হাত দিয়ে চেপে চেয়ারে বসিয়ে দেন।
-“বস। কথাটার আগে মিমাংসা হোক।”
-“কিন্তু বাবা, আমার সেমিনার!”
এবার ঠাকুমা ধমক দিয়ে বলেন,
-“সন্তু, চুপ করে বস, বড়রা কথা বলছে দেখছ না?”
আর তারপর বাবা আর মায়ের দিকে মুখ তুলে ঠাকুরমা একই রকম স্বরে বলে ওঠেন,
-“তোমদের স্বেচ্ছাচারিতা দেখলে আমি অবাক হয়ে যাই বৌমা!”
-“না মা, আমি পাঁজিতে দেখেছি, ফাল্গুন মাস কাল শেষ হবে।”
কিন্তু ঠাকুমা মানতে নারাজ, সুতরাং পাঁজি লে আও।
অতঃপর, প্রায় পনেরো মিনিট পঞ্জিকার পাতা ওলটানো, সন্দীপের কানে অনেক দিকশূল, গতেঃ, মঘা, অশ্লেষ্মা, ইত্যাদি ঢুকল। তারপর হঠাৎ ঠাকুমা বললেন,
-“দেখেছ, বলেছিলাম, আজ ভোরেই ফাল্গুন মাস ছেড়ে গেছে।”
বাবা যেন তৈরীই ছিলেন, তিনি বলে উঠলেন,
-“কিন্তু মা, আজ ভোরে ফাল্গুন মাস শেষ হলেও, আমি তো নিমপাতা গুলো পরশু, মানে অমুকবার এনেছি; নিয়মটা তো ফাল্গুন মাসের পর বাড়িতে নিম পাতা ঢোকা নিষেধ, তাই না?”
ঠাকুমা প্রতিবাদ করে বলে উঠলেন,
-“কে বলেছে ? নাহ! হতেই পারে না। নিমপাতা খাওয়া নিষেধ।”
-“না মা, ভালো করে মনে কর, বাড়িতে ঢোকা নিশেধ।”
এই নিয়েও বেশ কিছুক্ষণ বাকবিতন্ডা চলল, আর মা বার বার করে ঠাকুরমাকে বলতে থাকলেন,
-“মা, আমি দেখেছি, ফাল্গুন মাস এখনো শেষ হয়নি।”
তাই শেষে ঠাকুমা বললেন,
-“গুপ্তপ্রেস দিন দিন যাচ্ছেতাই হয়ে যাচ্ছে! জিতু, আমার ঘর থেকে বেনীমাধব শীলটা নিয়ে আয় তো!”
এবং বেনীমাধব শীল যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হলেন। সন্দীপের ঘড়ির দিকে তাকাতেই ভয় করছিল। তার ইচ্ছে করছিল হাঁউমাউ করে কাঁদতে। আরো পনেরো মিনিট ঠাকুমা এবং বেনীমাধব শীলের যুদ্ধ চলল। শেষে বিজয়ীর হাসি হেসে ঠাকুমা বললেন,
-“নাহ, বৌমা, ঠিকই বলেছিলে। আজ সন্ধ্যে অবধি ফাল্গুন মাস আছে। নে সন্তু, চট করে নিম ঝোলটা খেয়ে ফেল দেখি?”
ঠাকুমার আদেশ, সুতরাং নো আপত্তি। তাছাড়া সেই মূহুর্তে যদি একঢোক সায়ানাইড খেলেও রাস্তায় বেরোনো যেত, তাই খেত সন্দীপ। তাই পাঁচন গেলার মত মুখ করে নিমঝোল খেয়ে, রাস্তায় বেরিয়ে দৌড় লাগালো সন্দীপ। কোলকাতার একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে যেতে গেলে যতগুলো সিগন্যালে আটকানো যায়, সবকটায় আটকে, এবং মোবাইলে ২৮টা মিসড কল নিয়ে যখন ডিপার্টমেন্ট এ ঢুকল সে, তখন স্যার অগ্নীশর্মা হয়ে বারান্দার এদিক থেকে ওদিক পায়চারি করছেন, আর তাকে দেখেই ধমক দিয়ে বলে উঠলেন, -“এই যে, সন্দীপ! কখন তোমার আসার কথা, আর কখন তুমি আসছ! না, মানে, তোমার সাহস আর স্বেচ্ছাচারিতা দেখে আমি হতবাক হয়ে যাই।”
আশা করছি ভালো লাগল, আর শেষে আগের সপ্তাহের পূজা সংক্রান্ত অনুপস্থিতির ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি…
শান্তির আশায়…
নীল…
Kichuta ron chorleo dinta mone ache.
LikeLiked by 1 person