না মশাই, নিতে পারি না… আগেই বলেছি দিন দিন যাকে বলে ‘পেসিমিস্টিক’ হয়ে যাচ্ছি কিনা, তাই নিতে পারি না। এই যে দেখুন, প্রথম বাক্য লিখতে গিয়েই ফট করে একটা ইংরেজী বেরিয়ে গেল, আর আজ নাকি মাতৃভাষা দিবস। (#সমাজ_কি_আমায়_মেনে_নেবে_?) যাক গে যাক। আমিও অবশেষে ফুটেজ খাওয়ার লোভে এই ‘মাদার ‘টাঙ্গু’ ডে’-এর সন্ধ্যেবেলা কিছু ‘ওয়াইজ ক্র্যাকিং’ (আবার হ্যাশট্যাগ) কথা লিখে ব্লগে ছাপছি। যাই হোক, কিন্তু এই নিয়ে বার বার তিন বার বলছি, নিতে পারছি না।
কথাটা মাতৃভাষা দিবস, বাংলাভাষা দিবস নয়, কিন্তু আজকের দিনটায় কেন মাতৃভাষা দিবস পালন হয়, সেটা যারা জানেন ভালো কথা, যারা জানেন না… মরে যান… পরিস্কার কথা, মরে যান। আমি লিখে দিচ্ছি, আমি যদি কাল কোলকাতা শহরের যে কোন জনবহুল অংশে দাঁড়িয়ে কাউকে প্রশ্ন করি মাতৃভাষা দিবস কি ও কেন, হয় ভুল উত্তর পাবো, না হয় পাবো না। অথচ তারা কিন্তু সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে উঠে ফেবু আর হোয়াটস্যাপ এ স্ট্যাটাস দিয়েছে “অমর একুশে”। সেটা একুশে আইন না ফেব্রুয়ারী, নিজেই জানে না।
সমীক্ষার কথা ছেড়ে দিলাম (হ্যাঁ, সমীক্ষা; স্ট্যাটিস্টিক্স নয়। চাইলে বাংলা আমি ও লিখতে পারি); যেখানে গদীতে বসা হনুমানসমূহ হুপ হুপ করে লাফাচ্ছে আর দাবী করছে, হিন্দিকে জাতীয় ভাষা ঘোষণা করা হোক, সেখানে মাতৃভাষা হিসাবে বাংলার কতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত আমাদের, সেটা আর নতুন করে বোঝানোর কিছু নেই। যেখানে আমাদের জীবনযাপন এবং কর্মক্ষেত্র আমাদের দিনে দিনে এমন একটা দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যেটা আমাদের সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন করছে। আমি বারো বছর বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়েছি। আজ একটা ভালো বাংলা মাধ্যম স্কুলের নাম বলুন তো, যেখানে একটা সুস্থ পড়াশোনার পরিবেশ আছে? আমি বলিনি ইংরেজি মাধ্যম মানেই স্বর্গ, কিন্তু এককালের কলকাতার তাবড় তাবড় বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলো, যেগুলো ইংরেজি মাধ্যমের যেকোনো স্কুলের সাথে অনায়াসে টক্কর দিতে পারত, সেগুলোর আজ কিন্তু নখ-দাঁত ভাঙ্গা বৃদ্ধ সিংহের মতোই অবস্থা। আমার সমবয়সীদের জিজ্ঞেস করি,
-“আপনার মেয়েকে/ছেলেকে কি বাংলা মাধ্যমে পড়াবেন?”
উত্তর আসবে ‘না’ কারণ আমি জানি আমি পড়াব না। ইংরেজী আর বাংলা নিয়ে বাঙ্গালীর নানান ধরনের মতবাদ দেখা যায়। কেউ বাঙ্গালীর ছেলে/মেয়ে হয়েও বাংলা বলেন না, কারণ ‘প্রেস্টিজ’ যাবে। কেউ ইংরেজি জেনেও বলেন না, কারণ যদি ‘প্রেস্টিজ’ যায়। আরেকদল দৃঢ়তার সঙ্গে ভুলভাল ইংরেজি বলে যান, কারণ প্রেস্টিজ যাওয়া কাকে বলে তারা বোঝেন না।

যারা বঙ্গসন্তান হয়েও বাংলা বলতে নাক সিঁটকোন, তাদের আমি ঘৃণা করি। আর যারা বলে থাকেন ‘আমি তো বাংলা মিডিয়াম, তাই ইংরেজিতে কাঁচা’ তাদেরও আমি সমানভাবে ঘৃণা করি। কথা বলতে সবাই শুরু করে অনেক কম বয়স থেকে, এবং সেটা তার মাতৃভাষায়। কিন্তু তার যখন ভাষাশিক্ষার শুরু হয় তখন বাংলা ভাষার পাশাপাশি ইংরেজীও শেখা যায়, এবং দক্ষতা অর্জনও করা সম্ভব হয় (এটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত মতামত)। তাই এক মাধ্যমের জন্য অন্য ভাষায় দখল নেই, এটা স্রেফ গাফিলতি, কিছু ক্ষেত্রে স্কুলের, কিছু ক্ষেত্রে মা-বাবার।
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় তার এক কৌতুকে বলেছিলেন,
“ছেলেটি সারা বছর মদ খায়, কিন্তু গান্ধিজীর জন্মদিনে মদ না খেয়ে গোটা বছরের মদ খাওয়ার পাপ খন্ডন করে।”
তাই সারা বছর বলি ‘বাংলাটা আমার ঠিক আসে না’; আর ভাষা দিবসের রক্তাক্ত ইতিহাসের জন্য যদি আমরা একটা দিন বরাদ্দ করি, তাহলে পাপস্খলন আদৌ হয় কি ? বুকে হাত রেখে বলুন তো ? তাই কাল সন্ধ্যে থেকে ভাষা দিবস সংক্রান্ত পোষ্ট সত্যি বলছি, নিতে পারলাম না। আমি জানি আমার চেনা অনেকেই আছেন যারা সারা বছর ধরে বাংলা ভাষা নিয়ে চর্চা করেন; তাই তাদের কাছে ক্ষমাও চেয়ে নিচ্ছি; তাদের মনে ব্যাথা দেওয়ার ধৃষ্টতা আমার নেই।
শুধু ভাষা দিবস কেন? আমাদের সংস্কৃতির যে হারে ‘প্যারাডাইম শিফট’ চলছে, তাতে প্রত্যেকটি দিবস, বিশেষ করে বাংলা ও বাঙালি সংক্রান্ত, উদযাপনের ঘটা দেখলেই আমার আদিখ্যেতা মনে হয়। মানে, কেন রে বাপ ? যেখানে গোটা বছর কানে হেডফোন গুঁজে হানিসিংহের পদাবলী, ‘আজ ব্লু হ্যায় পানি পানি পানি পানি…’ (মানে কোথাকার জল কোথায় গড়াচ্ছে), আর ২৫শে বৈশাখ এলেই ভানুসিংহের পদাবলী, ‘নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল…’
লাগতে দাও… আটকাচ্ছে কে? নীরব মোদী, সরব মোদী কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে, সেখানে কোন শালা আবার সংস্কৃতির চুরি আটকাতে যাবে? মানে, কালচারে তো আর জিএসটি লাগে না!
তাই সবকিছু দেখে, পেসিমিস্ট আমি আবার চেঁচিয়ে ওঠে…
-“ও কত্তা, ব্যাপারটা নেওয়া গেল না…”
রিয়ালিস্ট আমি জবাব দেয়
-“ছাড় না, তুই কি ভাবলি না ভাবলি, কারোর কিসসু যায় আসে না…”
আর অপটিমিস্ট আমি আমতা আমতা করে বলে ওঠে…
-“মানে, সবই বুঝলাম, কিন্তু একদিনের জন্যে হলেও তো লোকে ভাষাটার কথা ভাবছে; কটা দেশ একটা ভাষার জন্য এরকম হুজুগে মাতে বল তো?”
তখনই কথাটা মাথায় খেলে আবার; বাঙালি সবার আগে হুজুগে বাঁচে। এই বাতিকটা আছে বলেই আজও একদিনের জন্যে হলেও ফেসবুক আর হোয়াটস্যাপ বাংলায় ভরে যায়। কিন্তু একদিনের জন্যই।
একদিনের জন্যই কবিগুরুর ছবিতে মালা ওঠে।
বঙ্গললনারা জীন্স টপ ছেড়ে হলুদ শাড়ীতে সরস্বতীর সামনে ফুল হাতে দাঁড়ায়।
তাই, (হু)যুগ যুগ জিও…
কিন্তু না মশাই, হুজুগের ভরসায় আর থাকবো কতদিন? বাঙালি যেমন হুজুগপ্রিয়, তেমনই নতুনত্বের আশায় আর সবার রঙে রং মেলানোর তাগিদে, বাঙালির সংস্কৃতি কিন্তু বিপথগামী হচ্ছে; মানে হাইজ্যাক হচ্ছে আর কি। তাই নববর্ষর চেয়ে ভ্যালেন্টাইন্স ডে-এর বাজার বেশী। কারণ সেটা বেশী ‘মার্কেটেবল’। আর এই যুগের হুজুগ কেটে গেলে, হয়তো চন্দ্রবিন্দুর সাথে সুরে সুর মিলিয়ে আমাকেও গাইতে হবে;
“জয় জয় জয় বঙা, ন্যাকাই ঢঙা, হাতে হ্যারিকেন…”
বাহ বেশ ভালো…
LikeLiked by 1 person
Khub valo laglo…
LikeLike
LikeLike