আমার স্কুলের এক সিনিয়র দাদা একবার ফেসবুক-এ বহুদিন আগে লিখেছিল, কলকাতা আমাকে অবাক করে দেয়। আর দুদিন আগে যে ঘটনাটা আমার সাথে ঘটল, তারপর আমিও বলতে বাধ্য হচ্ছি যে কলকাতা আমাকে বারবার অবাক করে দেয়। কারণ অপ্রাত্যাশিত এমন কিছু চমক পাওয়া যায় কলকাতার রাস্তাঘাটে, সেটা শুধু অকল্পনীয় নয়, ইংরেজীতে যাকে বলে ‘জ ড্রপিং’, ঠিক তাই। আর এত গৌরচন্দ্রিকার কারণ হল, গত সোমবার, একটা ১৫ মিনিটের ওলা রাইড, আমার… যাকে বলে ‘চোয়াল-পতন’ ঘটিয়েছে।
এবার ঘটনায় আসি। এখানে আমি একা ছিলুম না। সঙ্গে ছিল আমার ভাই তুহিন। সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ ফড়িয়াপুকুরের মোড় থেকে দুই ভাই একখানা ‘ওলা শেয়ার’ বুক করে অপেক্ষা করছি। সঙ্গে মালপত্তর। ৫-৬ মিনিট অপেক্ষা করার পর গাড়িটির অবির্ভাব ঘটল। চালকের আসনে মাঝবয়সী শশ্রুগুম্ফসম্বলিত এক ব্যাক্তি। গাড়িতে উঠে বসে যাত্রা শুরুর পর পরই এক বাইকওয়ালার সাথে কিঞ্চিৎ বাকবিতন্ডা হয় তার। আসলে ঠিক বাকবিতন্ডা নয়, বাইকওয়ালা ঝগড়ার উপক্রম করতেই, তিনি বার তিনেক ‘সরি’ বলে আবার যাত্রা শুরু করলেন; আর বলে উঠলেন-
-“ইংরেজরা এমন একটা শব্দ দিয়ে গেছে, ব্যবহার করব না ?”

কথাটা শুনে বেশ হাসিই পেল। শ্যামবাজারের দিকে গাড়ি ঘুরিয়ে চলতে চলতে তিনি বলতে থাকলেন যাত্রীদের কথা। কারা কেমন ব্যবহার করেছে, কবে কার ব্যবহার শুনে কান্না পেয়ে গেছে। হঠাৎ বলে উঠলেন;
-“জীবনে দুঃখ সহ্য করার ক্ষমতা আমার আছে, কপালে সুখটাই সয় না…”
আমি বলে উঠতে যাচ্ছিলাম কিছু একটা, হঠাৎ তিনি আবার বলে উঠলেন,
-“এ ব্যাপারে আমার একটা কবিতা আছে…”
ব্যস… আর জি করের মুখ থেকে টালা অবধি, একটা গাড়ির বন্ধ কাচের আবডালে নিয়ন্ত্রিত শীতাতপের মধ্যে চলল কবিতার মেহফিল।
আমার স্বপ্নবিভোর কবিতার সামনে তার কঠোর বাস্তবধর্মী শ্যায়রির মোলাকাত হল।
নিজেই বললেন,
-“আসলে, আমার কবিতাগুলো একটু নজরুল ঘ্যাঁষা।“
হিন্দি-বাংলা দুই ভাষাতেই কবিতা শোনালেন, তবে বুঝতে পারলাম হিন্দিতেই বেশী স্বচ্ছন্দ। ওলা অ্যাপে নাম দেখেছিলুম ‘জয় সুভাষ সিং’। জিজ্ঞেস করলাম ফেবুতে আছেন কিনা। ইতিবাচক উত্তর পেয়ে ফেবু অ্যাপটা খুলে প্রোফাইল নেম জিজ্ঞেস করতে বললেন
-“ড্রাইভার সুভাষ।”
আবার অবাক হলাম। প্রোফাইলটা খুঁজে পেয়ে একটা বন্ধুত্ব নিবেদন করতে করতেই পৌছে গেলাম বাড়ির দোরগোড়ায়।
তখন সময় পাইনি, পরে ভালো করে খুলে দেখলাম তার প্রোফাইল খানা… তখন তাঁরই কমবয়সের একটা ছবি দেওয়া ছিল, আর প্রোফাইলের ট্যাগলাইন হিন্দি হরফে লেখা
“ম্যায় সারথী হুঁ”
ব্যাস…
কোনো রাখাঢাক নেই, কোনও ভনিতা নেই, তাই নামের শেষে পদবি না লিখে নামের আগে লিখেছেন ‘ড্রাইভার’; আর ওই সোজাসাপটা ট্যাগলাইন… তাই কলকাতা আমায় আবার অবাক করে দিল। কলকাতা বলেই এটা সম্ভব হল। তন্ময় মুখার্জী-এর ব্লগ ‘বংপেন’ এ একটা লেখা ছিল। যেটার নাম ইন্টারভিউ। সেখানে মানবরূপী কলকাতার মুখে একটা ডায়ালগ ছিল।
-“আমরা আলুভাতে ভাত খেয়ে সবপেয়েছি বলে দুহাত তুলে নাচতে পারি।“
আর পারি বলেই, স্টীয়ারিংয়ের পেছনে বসা কবি যেমন তার সত্ত্বাকে ভোলে না, তেমনি কবিতা আবৃত্তি করতে করতে ড্রাইভার ভোলে না তার বাস্তবটাকে…
মাঝে মাঝে তাই ভাবি, আমরা যারা এত স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে বড় হয়েছি, মানে যেমন আমি, বিছানায় গা এলিয়ে ল্যাপটপে ব্লগ লিখছি, তারা পারব ? স্বাচ্ছন্দের অভাবে যদি পড়ি কোনোদিন, মনের ভাললাগার জায়গাটাকে পারব এভাবে বাঁচিয়ে রাখতে ? নাকি নীজের অক্ষমতা আর ডিপ্রেশন চাপা দিতে সব বিসর্জন দিয়ে দেব? আমরা কি পারব, বুক ঠুকে নামের আগে ড্রাইভার লিখে গাড়ির প্যাসেঞ্জারকে কবিতা শোনাতে?
জানি না, হয়তো জানতেও পারব না, তবে মনে মনে চাইব, পড়ে যদি কোনোদিন ড্রাইভার সুভাষের সাথে দেখা হয়ে যায়, ট্রিপটা যেন ১৫ মিনিটের চেয়ে বেশী লম্বা হয়। অনেক কবিতা শোনার বাকি আছে।
অনেক জানা বাকি আছে… জীবনটাকে…
শান্তির আশায়,
নীল
পুনশ্চ : নীচে প্রোফাইলের লিংক দেওয়া রইল, প্রমাণ হিসাবে। এবং আপনাদেরও সুযোগ রইল এরকম একজন অসাধারণ একটা মানুষকে জানার, চেনার…
Amon manus gulo e prokrito hero ar eder dekhei abar sob protikulotar moddhe bachar swapno dekhte iccha kore. ..Thank you Neelotpal ato sundor oviggota share korar jonno. .
LikeLiked by 2 people
Bhalo…
LikeLike