চতুষ্কোণ

চতুষ্কোণ

||১||

বাড়িটা প্রকান্ড… মানে এরকম বাড়ির জন্যই বোধহয় ‘অট্টালিকা’ কথাটার উদ্ভাবণ হয়েছে বাংলা অভিধানে। বাড়ি সদর দরজাটাকে ‘ফটক’ না বললে সেটাকে রীতিমত অপমান করা হয়। গোটা বাড়িতে সেন্ট্রাল এসির ঠান্ডা হাওয়া বইছে…

ছেলেটা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে ভাবছিল, পয়সা থাকলে লোকে কিভাবে খরচ করে… হ্যাঁ, সে নিজে মোটামুটি স্বচ্ছল ঘরের ছেলে হলেও, এত বিলাস দেখেনি কখনো। সঙ্গে ছিল অফিস পিওন উল্লাসদা, তার চোখদু’টো ততক্ষণে ‘বাবা তারকনাথের চরণে সেবা লাগি’ বলতে বলে চরকগাছে চড়েই পড়েছে। সে ফিস ফিস করে ছেলেটার কানের কাছে বলল,

-“এরা তো হেগে ৫০০ টাকার নোটে মোছে মনে হচ্ছে…”

ছেলেটা মুচকি হেসে বলল,

-“চেপে যাও… শুনতে পেলে কেস হয়ে যাবে…”

কাজ শেষ হওয়া অবধি উল্লাসদা থাকল না, তার বাড়ি যাওয়ার তাড়া ছিল।

ছেলেটা কাজ শেষ করে বেরোলো যখন, তখন বাজে রাত প্রায় ১১টা। র‍্যাপিডো ডাকতে ডাকতে বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে, আপনমনে পাগলের মতই হেসে যাচ্ছিল ছেলেটা। ভাবছিল,

-“যাই করি শালা… এত বড়লোক তো এ জীবনে হতে পারব না…”

||২||

ছেলেটা বেহালা থেকে ফিরছিল, দাদার বাড়ি একটা কাজ করে, কব্জী ডুবিয়ে বিরিয়ানি খেয়ে শেষে একটা উবের ধরেছিল।

রাত ১২টার ঘর পেরিয়ে গেছে। তার ওপর করোনার কেলেঙ্কারি তো চলছেই। তাই রাস্তাঘাট এক্কেবারেই শুনশান। ময়দান পেরোনোর সময় ইলিয়ট পার্ক-এর চারপাশ দেখে একটা অদ্ভুত খেয়াল চাপল ছেলেটার মাথায়। অফিস থেকে তো খুব একটা দূরে নয়; যদি কোনও দিন অফিস থেকে বেরিয়ে ইলিয়ট পার্ক চলে এসে সারারাত সেই চত্তরেই ঘুরে বেড়ানো যায় ? তাহলে কেমন হয় ?

একরাত না হয় বেঞ্চ-এ শুয়েই কাটাল? কি হবে? ভূতে ধরবে?

একদিন চেষ্টা করলে হয়। এইসব ভাবতে ভাবতেই পার হয়ে যায় ইলিয়ট পার্ক, এসপ্ল্যানেড।

||৩||

ছেলেটার শরীর দিচ্ছিল না… একে তো লাঞ্চ করা হয়নি দুপুরে, তারপর টানা পাঁচ ঘন্টা ধরে কাজ করে চলেছে, উপরন্তু তামাকের একটানা গন্ধে গা গুলিয়ে আসছে তার… কিন্তু কাজ এখনো অনেকটাই বাকী… শেষ করতে গেলে রাত ২-৩টে বেজে যাবে।

আর তার আশায় আরও তিনজন বসে আছে একসাথে বাড়ি ফিরবে বলে। একা হলে একটা চেষ্টা করে দেখা যেত… কিন্তু না…

অবশেষে সে হাল ছেড়ে দেয়…

বস কুশলদা কে ফোন করে সোমবার বাকী কাজ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ওই পরিবেশ থেকে বেরিয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।

গাড়ির স্টেয়ারিং-এ বসে মনে হয়না কি কুক্ষণে এই চাকরীটা করছে, বরং মনে হয়েছে ভাগ্যিস অন্য কোনও রাস্তায় হাঁটেনি, যেখানে তামাকের ধোঁয়ার গন্ধের মধ্যে ২৪ ঘন্টা কাটাতে হয়। নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিয়ে অ্যাক্সিলারেটরের চাপ বাড়ায়…

বাড়িতে মা চিন্তা করছে…

||৪||

রবিবার, অফিস ছুটি, তাই মা, আর দুই ভাইকে নিয়ে বেড়িয়েছিল ছেলেটা। বাড়ি ফিরে, গ্যারেজে গাড়ি তুলে আবার বাড়ির দিকে রওনা দেবে, একটা গলা শুনতে পেল,

-“দাদা… বড্ড খিদে পেয়েছে, খেতে দেবে?”

গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট পড়া ময়লা গায়ের রঙ, একটা রোগামত ছেলে।

তার দিকে তাকিয়ে, ছেলেটা গম্ভীর মুখে উত্তর দেয়,

-“হুঁ, এখানে দাঁড়া…”

কাছের দোকান থেকে এক প্যাকেট বিস্কুট, একটা কেক, একটা লাড্ডু কিনে ছেলেটার হাতে দিতে দিতে, তাকে জিজ্ঞেস করে,

-“কোন স্কুলে পড়িস?”

-“স্কুলে পড়িনা…”

-“মা বাবা ?”

-“মা নেই আমার… বাবার শরীর খারাপ, বাড়িতে শুয়ে আছে, বাড়িতে চাল ডাল নেই গো…”

ছেলেটা গম্ভীর মুখেই তাকিয়ে থাকে, কিন্তু তার ভেতরে কি একটা যেন ভেঙ্গেচুরে যায়, বুকের ভেতর থেকে একটা চাপা হাহাকার যেন ধাক্কা মেরে চোখ দিয়ে বেড়িয়ে আসতে চায়… ছেলেটা তারাতারি গ্যারেজের দিকে এগোতে যায়…

-“দাদা…”

ছেলেটা কোনওরকমে ফিরে তাকায়,

-“তোমার বাড়িতে কোনও কাজ আছে গো? যে কোনও কাজ…”

ছেলেটার বাড়িতে সত্যিই কোনও কাজ নেই, বা জানা নেই… সে চাপা গলায় উত্তর দেয়,

-“না রে, আমার বাড়িতে কাজ নেই কোনও…”

এই বলে হন হন করে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়, দরজা খুলে পেছনের সীটে বসে কাঁচ তুলে দিয়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করে।

শুভ মহানবমী…

নীল…

Advertisement

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.