তরঙ্গ – শেষ পর্ব

সোমনাথের ঘুম ভাঙে, তখন ঠিক সকাল সাতটা। মেসবাড়ির তার ঘরটা ছোট্ট; একদিকে একটা খাট সেটার পাশেই একটা টেবিল পাতা, তার পড়াশোনার জন্য। অন্যদিকে একটা টেবলে একটা ইলেক্ট্রিক হিটার, চায়ের কৌটো, কয়েকটা বাসন কোসন। আড়মোড়া ভেঙে উঠে ঘরের বাইরে বেড়োতেই মেসমালিক কয়ালবাবুর সাথে দেখা। তিনি একগাল হেসে বললেন,

-“কি হে সোমনাথ! তোমাদের গর্ত খোঁড়ার আর কতদিন বাকি হে ?”

সোমনাথও হেসে উত্তর দেয়,

-“খোঁড়া তো মোটামুটি শেষ এখন গড়ার কাজ চলছে…”

-“তা আমাদের জীবদ্দশায় চড়ে যেতে পারব তো হে?”

-“অবশ্যই মেসোমশাই… আমার আন্দাজ বলছে আর বছর পাঁচেক ম্যাক্সিমাম, তার আগেও হয়ে যেতে পারে…”

-“বাহ বাহ… তা মেট্রো চালু হলে একদিন চড়িয়ে দিও…”

-“সে তো চালু হলে সবাই চড়তে পারবে… আপনাকে প্রথম ট্রেনে চড়াবার বন্দোবস্ত করে দিতে পারি…”

-“বাহ, বাহ… তাই দিও…”

কয়ালবাবুকে পেরিয়ে স্নানে যায় সোমনাথ। কলকাতা মেট্রোর সার্কিট ইঞ্জিনীয়ারের দায়িত্বে সে আছে প্রায় ৫ বছর ধরে। তার পোষ্টিং কালীঘাট স্টেশনে, মানে এখনো স্টেশন হয়ে ওঠেনি সেটা, তবে কাজ চলছে। হালিসহরে কাকার বাড়ি থেকে রোজ যাতায়াত করা সম্ভব নয় বলে রাসবিহারীর কাছে এই মেসটা নিয়েছে সে।

স্নান করে একটু দেরী করে বেরোলেও হবে আজ; কারণ ডিউটি সাড়ে দশ’টা থেকে। আর আজ একবার পার্ক স্ট্রীটে মেট্রোরেল ভবনেও যেতে হতে পারে। তাই জলদি স্নান সেরে সে খেতে গেল খাওয়ার ঘরে। তার মেসের প্রতিবেশীরা মানে স্বরূপ পতিতুন্ড এবং আরও কিছু লোকজন, তার আগে থেকেই সকালের আড্ডা বসিয়েছিল সেখানে।

-“কি হে, সোমনাথচন্দর… আর কদ্দিন এভাবে ব্যাচেলর হয়ে কাটাবে মাইরি? এবার বিয়ে থা কর, আমরাও হালিসহর গিয়ে পোলাও কালিয়া পেঁদিয়ে আসি…”

হেসে ফেলে সোমনাথ, মৃদু হেসে বলে,

-“সে পোলাও কালিয়া খাবে তো আমার কাজের একটু চাপ কমলে, চল না একদিন পার্ক হোটেল… তার জন্য বিয়ে ফিয়ে করতে বোলো না… এ জন্মে ব্যাচেলর ট্যাগ আমার ঘুচল না…”

-“বাহ! ভারী সুবিধাবাদী… আর, তোমার আবার কাজের চাপ কি হে? সরকারী চাকরী, মুতবে কম, ছড়াবে বেশী, তবে না?”

সোমনাথ হাসতে হাসতেই উঠে পড়ে। এবার না বেরোলে দেরী হওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা।        

বিয়ের কথা সে ভাবে না, প্রথমত স্কুলে-কলেজে পড়াকালীন মেয়েদের সাথে কথা বলতেও ভয় পেত কেমন; আর বিয়ে ব্যাপারটা নিয়েও সে খুব একটা উৎসাহিত নয়। কাকীমা যদিও সপ্তাহে একটা করে অন্তত মেয়ের কথা বলেন, কিন্তু সে একেবারেই রাজী নয়। ছেলে কি, মেয়ে কি, কলেজে বন্ধু তার ছিলই না, যে ক’জন ছিল নোটস নিতে আর ড্রয়িং-এ সাহায্য পাওয়ার কথা ভেবেই বন্ধুত্ব করেছিল তার সাথে। আর সবচেয়ে বড় কথা, একটা মেয়েকে দেখেও তার পচ্ছন্দ হয়নি গোটা কলেজে।

মেস থেকে বেড়িয়ে হাঁটতে থাকে সোমনাথ, হাঁটতে হাঁটতে সিগারেট ধরায়। রোজ সে হেঁটেই যাতায়াত করতে পারে; এটাই সবচেয়ে বড় সুবিধা এই মেসে থাকার। সে সকাল সাড়ে দশটার মধ্যে পৌছে গেলেও, তার সহকর্মীরা হেলেদুলে বেলা এগারোটা-সাড়ে এগারোটার আগে ঢোকে না কেউই।

যখন সোমনাথ রাস্তায় হাঁটছে, তখন শহরের অপরপ্রান্তে একটা অদ্ভূত ব্যাপার শুরু হয়। রাজাবাজার পোস্ট-অফিসের একটা টেলিগ্রাফ প্রবল বেগে মর্স কোডে বার্তা দিতে শুরু করে। প্রায় আধঘন্টা পড়, গলদঘর্ম টেলিগ্রাফ অপারেটর পোস্টমাস্টারের কাছে গিয়ে বেশ রাগত স্বরে বলে ওঠে,

-“দেখুন তো বড়বাবু… এত লম্বা টেলিগ্রাম পাঠায় কেউ? আর তাও কি সব মাথামুন্ডুহীন লেখাপত্তর…”

-“কার নামে? কে পাঠাল?”

-“সেটা তো আরও ভজকট… সেন্ডার আর রিসিভার এক নাম অজিতেশ সামন্ত। ঠিকানা দেওয়া আছে আমাদের বিদ্যাসাগর স্ট্রীট পি জি হলের…”

-“তো? কে কাকে পাঠাচ্ছে সেসব না দেখে, এটা পৌঁছোবার ব্যবস্থা কর… দেখছ না আর্জেন্ট লেখা রয়েছে?”

কালীঘাটের প্রস্তাবিত মেট্রো স্টেশনের মূল দ্বারে দু’জন সিকিওরিটি গার্ড থাকে; নিবারণ দাস আর রামনাথ দুবে। সোমনাথকে দেখতে পেয়ে নিবারণ রোজকারের মত একটা গদগদ হাসি হেসে নমস্কার করে, আর রামনাথ হাসিমুখে সম্ভাষণ করে,

-“রাম রাম বাবুজী…”

-“আরে, রাম রাম দুবেজী… সব ঠিক?”

-“একদম ঠিক বাবুজী… কোই মুসিব্বত নেহী…”

-“অওর কোই আয়া কেয়া?”

সোমনাথের এই প্রশ্নের উত্তরটা দেয় নিবারণ।

-“কেন লজ্জা দিচ্ছেন সোমনাথবাবু… জানেন তো, আপনার আগে কোনও নবাবপুত্তুরেরই আসার সময় হয়ে ওঠে না।”

সোমনাথ হা হা করে হেসে সিঁড়ি দিয়ে নির্মীয়মান স্টেশনের গর্ভে নেমে যায়।

Photo by Vicky Tran on Pexels.com

উপসংহার

-“তো এই সেমিস্টারের সিলেবাস এখানেই শেষ… অ্যাই হোপ ক্লাসগুলো সবার কাছে বোধগম্য হয়েছে; কোনও ডাউটস থাকলে, আই অ্যাম অ্যাভেইলঅ্যাবল ইন মাই অফিস…”

ক্লাস শেষ করে নিজের ঘরে ফিরে ফিরে এলেন প্রফেসর সামন্ত। নিজের টেবলে থিতু হয়েছেন কি হননি; দরজায় একটা টোকা পড়ল

-“ইয়েস ?”

-“স্যার, আমি সুকোমল…”

-“ও! ভেতরে এস…”

দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল সুকোমল, স্যারের প্রিয় ছাত্র।

-“বল, কি ব্যাপার তোমার?”

-“আসলে স্যার, ঠিক ডাউট নয়, একটা প্রশ্ন ছিল…”

-“ফায়ার অ্যাওয়ে…”

-“স্যার, আইনস্টাইন-রোসেন ব্রীজ কি সত্যিই সম্ভব ?”

-“ওয়েল, দেয়ার আর থিওরিটিক্যাল ইমপ্লিকেশন্স… কিন্তু এখনো অবধি তো হলিউডের সিনেমা আর নেটফ্লীক্সের সিরীজ ছাড়া দেখা যায়নি কোথাও…”

সুকোমন হেসে ফেলে…

-“না স্যার, মানে সত্যিই কি এভাবে স্পেস-টাইমের দু’টো পয়েন্টের মধ্যে… মানে কখনো, কোনোভাবে…”

-“ওয়েল, উই ক্যান ওনলি হোপ…” -এই বলে তার চিরাচরিত হাসিটা হাসেন, ডক্টর অজিতেশ সামন্ত।

সুকোমল সেটার প্রত্যুত্তরে একটা হাসি ছুঁড়ে দিয়ে উঠে যায়। সে দরজা খুলে বেড়িয়ে যাচ্ছিল, তাকে পেছন থেকে আবার ডাকেন অজিতেশ।

-“ভবিষ্যতে কি আছে জানি না… সায়ান্স অ্যান্ড টেকনোলজী আমাদের কোনদিকে ঠেলে দেবে… আমাদের জীবদ্দশায় কি হবে আর কি হবে না… ইফ দ্যাট ডে কামস, অ্যান্ড টাইম ট্রাভেল বিকামস আ রিয়ালিটি, একবার ভেবে দেখো, গপ্পের কথা বাদ দিলেও, আমি পার্সোনালি মনে করি, মেডলিং উইথ টাইম ইজ আ ডেঞ্জারাস থিং…”

সুকোমল মাথা নেড়ে বেড়িয়ে যায়।এবার নিজের ডানহাতের দেরাজ খুলে একটা ল্যামিনেট করা টেলিগ্রাম বের করে আনেন ডক্টর সামন্ত। সেই টেলিগ্রামটা, যেটা আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে তার কাছে এসেছিল, এবং অদ্ভূতভাবেই আগামী চল্লিশ বছরে তাঁর জীবনে ঘটতে চলে প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আগে থেকেই জানিয়ে দিয়েছিল। টেলিগ্রামের শেষ লাইনে লেখা ছিল,

I personally believe, meddling with time is a dangerous thing…”

২০২০… সংখ্যাটা ভাবতে কেমন গা শিরশির করে সোমনাথের… সাত বছর আগে রিটায়ার করার সময়ও মনে হয়েছিল, ‘ওরে বাবা ২০১৩!’ ২০০০ সাল কথাটাতেই কেমন করে উঠত গা টা… আর… যাই হোক…

কাকা মারা যান ’৯২-এ। কাকীমাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কোলকাতায় এনে, হালীসহরের পাট চুকিয়ে দেয় সে। সল্টলেকের বাড়িটাও কাকীমাকে নিয়ে আসার পড়েই করা।  কাকীমা চলে যান ’৯৯-এ। তাই নতুন এই সহস্রাব্দটা সোমনাথ একাই কাটিয়েছে, কাটাবেও জীবনের বাকী কটা দিন। বই পড়ে আর নেটফ্লিক্স দেখে দিব্যি চালিয়ে দিচ্ছে সে। কলকাতার গর্ব মেট্রোর ইস্ট-ওয়েস্ট লাইন চালু হওয়ার ফলে সল্টলেক-এর কিছু অংশে মেট্রো চলছে। শহরের পাতালরেল কে নিজের চোখে আঁতুর থেকে বেড়িয়ে সাবালোক হতে দেখেছে সে। গর্ব হয়… ভালো লাগে… মনে হয় এই মেট্রোর জন্মের পেছনে তার কিছুটা হলেও হাত, কিছুটা হলেও অবদান আছে।

চাকরির সাথে সাথে সিগারেটের নেশাটাও ছেড়েছে; কিন্তু ইদানিং বাড়ির কাছের এই ‘টি-বার’-এ প্রতি রবিবার বিকেলে একটা চিকেন স্যান্ডউইচ আর এক কাপ আর্ল গ্রে টি খাওয়াটা একরকম অভ্যাসেই দাঁড়িয়ে গেছে তার।  আজও বসে খাচ্ছিল তাই, তার সামনের টেবলে বসেছিল এক স্বামী-স্ত্রী আর তাদের একটা বাচ্চা মেয়ে। মেয়েটি সোমনাথের দিকে পিঠ করে বসে খুব শান্তভাবে, মন দিয়ে বাচ্চাটাকে কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করছিল। বাচ্চাটাও হাত পা ছুঁড়ে বায়না করে যাচ্ছিল খালি।

সোমনাথের মজাই লাগে। এটা আর একটা কারণ তার এখানে এসে বসার। কারোর সাথে কথা না বললেও, সবার মাঝে বসে থেকে, নিজের সামাজিক প্রতিবন্ধকতাটা কেমন কাটিয়ে ওঠা যায়।

সামনের টেবলের মেয়েটি হাল ছেড়ে দিয়েছে, এবার বাচ্চাটিকে মৃদু বকাঝকা করা চলছে। এমন সময় ওদের বিল আসে, বিল দেওয়ার পর, উঠে পড়ে তিনজনে। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ছেলেটি আগে বেড়িয়ে যায়। মেয়েটি যখন সোমনাথকে পেরিয়ে দরজার দিকে যাচ্ছিল, তখন মেয়েটার মুখের দিকে চোখ পড়ে সোমনাথের। খুব চেনা লাগে মেয়েটিকে। মনে হয় অনেক জন্ম আগে, এই মেয়েটা তার খুব কাছের লোক ছিল। এই মেয়েটাই বোধহয় তার হাত ধরে কোনোদিন হারিয়ে না যাওয়ার শপথ নিয়েছিল, হয়তো এই মেয়েটাই জন্মে জন্মে তার কাছে ফিরে আসবে বলে কথা দিয়েছিল। হয়তো অন্য কোনও বাস্তবতায় !

Somewhere in the Jungle of North Bengal শুরু হয়েছিল Lockdown-এর আগে, এবং আমার সাথে দিল্লী, আগ্রা ঘুরে এসেছে ওই গল্প। কিন্তু এ গল্পটা পুরোটাই এই লকডাউনের পর বাড়িতে বসে লেখা, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। কিছু কল্পনা, কিছু আশঙ্কা আর কিছুটা প্রেম মিলিয়ে গল্পটা লিখেছি; এবার ভালো বা খারাপ যা-ই লাগুক, জানান… অপেক্ষায় থাকলাম।

অন্যদিকে Blog-এর Theme এবং রং পরিবর্তন দেখে অবশ্যই বুঝতে পারছেন, ভুটান যাত্রা হচ্ছে, এবং আমাদের যাত্রা শুরু হচ্ছে আসছে শনিবার। সেটা আশাকরি আপনাদের মূল্যবান সময়ের যৎকিঞ্চিত দাম দিতে পারবে…

শান্তির আশায়…

নীল…

Advertisement

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.