তরঙ্গ – নবম পর্ব

-“২০২২ সালে ক্ষমতায় আসে এক ফ্যাসিস্ট সরকার, যারা ‘বৈদিক’ সভ্যতার আদলে ভারতের সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করে, ফলাফল বর্ণাশ্রম চালু করা; জন্মপরিচয় দেখে মানুষের ইচ্ছের বিরুদ্ধে…”

-“আপনি একটু চুপ করবেন, প্লিজ?” -সোমনাথ ধরা গলায় বলে ওঠে…

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন ডক্টর সামন্ত। তারপর বলেন,

-“আমার কথাটা শোনো, সোমনাথ… তুমিই পারো গোটা ব্রহ্মাণ্ডকে বাঁচাতে, শুধু তাই নয়, তুমিই পারো মেট্রোরেলের ওই ভয়ঙ্কর নাশকতাটাকেও আটকাতে।”

-“আমি পারব না…”

-“তোমাকে আমি স্বার্থপর বলছি না; সোমনাথ… তোমার মতো একা জীবন কাটালে আমারও হয়তো একই অবস্থা হত… কিন্তু তুমি নিজের চোখেই দেখেছ, মেঘার সাথে এই বাস্তবতায় পরিণতি কি মর্মান্তিক… মেঘাকে তুমি চেষ্টা করেও কাছে রাখতে পারবে না, তার চেয়ে ভুলে যাওয়া ভালো নয় কি? ভালো নয় কি, সব মুছে ফেলে নতুন করে চেষ্টা করা? আমাকেও তো মুছে ফেলতে হবে…  আমার ধ্যান, জ্ঞান, ভালোবাসা, সবই ছিল আমার এই ল্যাব, রিসার্চ, আমার ই-আর বীমার… তুমি মেঘাকে হারাবে যেমন, আমিও হারাবো আমার আবিষ্কার।”

-“মানে?”

-“মানে তুমি যদি ঠিক কর, যে তুমি আগের রিয়ালিটিতে ফিরে যাবে, তাহলে তোমার সাথে একটা যন্ত্র দিয়ে আমি। এ বাস্তবতার স্মৃতি তোমার একটুও থাকবে না; তাই তুমি তো আমার সাথে দেখা করে বোঝাতে পারবে না আমায়… কিন্তু এই যন্ত্রটা স্বয়ংক্রিয়। তুমি ওই রিয়ালিটিতে পৌছালেই ওখানে, ১৯৮০ সালের আমার কাছে, এই রিয়ালিটির ২০২০ সালের আমার কাছ থেকে একটা বার্তা যাবে, মানে বলতে পারো, এমন কিছু কথা, যেটা আমি ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না, আর আমি… মানে  ওই রিয়ালিটির আমি, ই আর বীমারের স্বপ্নও জলাঞ্জলি দেব। যখন আমি মেসেজটা পাব, তখন যদিও সদ্য এম এস সি পড়তে ঢুকেছি; কিন্তু আমার মেসেজ আমি ঠিক বুঝতে পেরে যাব…”

সোমনাথ চুপ করে বসে থাকে…

-“বাড়ি যাও। তোমাকে জোর করে পাঠানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়; তাতে ফলাফল হিতে বিপরীত হতে পারে। বাড়ি যাও। আবার ফোন কোরো আমায়, যেদিন প্রস্তুত হবে। শুধু মনে রেখো; বেশী দেরী করলে কিন্তু সমুহ বিপদ।”

সোমনাথকে একটা ট্যাক্সি ডেকে দেন ডক্টর সামন্ত। সে একটাও কথা বলেনি এর মধ্যে। ট্যাক্সিতে বসে তার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। সে জানে, ডক্টর সামন্ত তার সাথে ছলনা করছেন না, একটা বানানো আজগুবি গল্প বলে তাকে পাগল করে তুলছেন না। সে জানে। মনের গভীরে সে জানে, এ সবই সত্যি। নদী একুল ভেঙে ওকুল গড়ে; এ কথা বার বার শোনা যায়… তার ক্ষেত্রে কেন একূল অকূল দুকূলই যাচ্ছে সে কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না।

প্রায় ১ ঘন্টা বাদে যখন বাড়ী পৌছায়, তখন বাজে রাত আটটা। মেঘা হাসিমুখে দরজা খুললে তাকে জাপটে ধরে কাঁদতে শুরু করে সোমনাথ। হাউ হাউ করে। মেঘা অবাক হয়ে যায়।

-“কি হয়েছে সমু… কি হল? এভাবে কাঁদছ কেন?”

সোমনাথ কোনও উত্তর না দিয়েই হাউহাউ করে কেঁদে যায়। অনেকক্ষণ পর, সোমনাথ মুখ খোলে

-“আমি তোমায় ছেড়ে থাকতে পারব না, মেঘা…”

মেঘা হেসে ফেলে,

-“কেন ছেড়ে থাকবে আমাকে? কে বলেছে তোমায় থাকতে? এরকম পাগলের মতো কাঁদছ হঠাৎ, এই কথা ভেবে?”

-“জানি না… মাথাটা তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে বড্ড…”

-“তুমি ওঠো তো… ওঠো…”

সোমনাথকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসিয়ে, তার সামনে বসে মেঘা।

-“তুমি বড্ড ইমোশনাল, সমু… এভাবে বাচ্চার মতো কান্নাকাটি করে কেউ? তুমি একা ছিলে, আর নেই, সেটা ভাবছ না কেন বলত? এভাবে কান্নাকাটি করলে লোকে তোমার ভেতরের অত্যন্ত নরম মানুষটাকে দেখে ফেলবে, চিনে ফেলবে, আর তারপর পিশে মেরে ফেলতে চাইবে… আর, আমি কোথায় যাব তোমাকে ছেড়ে? কোথায় যাব তোমাকে ছাড়া, বল? এসব একদম না ভেবে যাও, ফ্রেস হয়ে এস…”

স্নানে যায় সোমনাথ। শাওয়ার চালিয়ে তার নিচে দাঁড়িয়েও কাঁদতে থাকে সে সমানে। কি করবে সে? কি করা উচিৎ তার? গোটা পৃথিবীকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়ে অপেক্ষা করা, কবে একদল লোকে জোর করে তাকে আর মেঘাকে আলাদা করে দেবে? নাকি তার নিজের বাস্তবতায় ফিরে গিয়ে নিজেকে অদৃষ্টের হাতে ছেড়ে দেওয়াটাই স্বাভাবিক হবে? ভেবে পাচ্ছে না সে। সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে, আর বুক ফেটে কান্না বেড়িয়ে আসছে।

বাথরুম থেকে বেড়িয়ে খেতে বসে দু’জনে। মেঘার হাতের রান্না; তার দেরী হবে বলে সবটা মেঘাই করে ফেলেছে। খাওয়ার সময় জোর করে হাসিমুখ করে থাকে সোমনাথ। মেঘাও হাসিমুখেই মামুলি একটা দু’টো কথা বলে; খাওয়ার পর, বিছানায় বসে সোমনাথকে বলে মেঘা;

-“এবার বলোতো… কি হয়েছে… ওভাবে কাঁদছিলে কেন? এরকম তো কর না তুমি। কি হয়েছে আজ…”

-“জানিনা, বাবু… আজ হঠাৎ করে মনটা প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেল… কোনও কারণ ছাড়াই। কেমন বার বার মনে হতে থাকল, তোমাকে হারিয়ে ফেলব, তোমার থেকে দুরে চলে যেতে হবে…”

-“কেন? হঠাৎ এরকম কেন? কেন এরকম ভাবছ? কে কেড়ে নেবে আমাকে? কার ক্ষমতা আছে?”

-“জানি না… সবসময় সবকিছুর পেছনে তো কারণ পাওয়া যায় না… শুধু মনটা খারাপ হয়ে গেল বাড়ি ফিরতে ফিরতে…”

মেঘা তার খুব কাছে এগিয়ে আসে, দুহাত দিয়ে সোমনাথের গলাটা জড়িয়ে ধরে বলে,

-“কেউ পারবে না… এই জন্মে না… পরের জন্মে না… আমাদের দেখা হবেই… কেউ আটকাতে পারবে না…”

সোমনাথের চোখে আবার জল চলে আসে। মেঘা তার ঠোঁটে একটা গভীর চুমু খায় তারপর হাসিমুখে বলে,

-“এসো শুয়ে পড়ি…”

মেঘা ঘুমিয়ে পড়লেও, সোমনাথ জেগে বসে থাকে। সে মনে মনে সত্যিই প্রস্তুত। একদল লোক এসে দু’জনকে টেনে আলাদা করে দেওয়ার বদলে এই তো ভালো… হতে পারে সবই মনে মনে; তার মনের কল্পনাই তৈরী করেছে এই বাস্তবতা, হয়তো মেঘা তার বুকচাপা কান্না আর সারজীবনের একাকীত্বের ফসল, হয়তো তার রিয়ালিটিতে মেঘার কোনও অস্তিত্বই নেই, আর আজ থেকে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার দিন তার হাতটা ধরার কেউ থাকবে না, তবুও তো গোটা দু’টো বছর মেঘার সাথে কাটিয়েছে সে হয়তো কল্পনার সুতোতেই গাঁথা সেই দুটো বছর, তবুও; গোটা দু’টো বছর অনেক অনেক দিনের কাঙ্খিত ভালোবাসাটা সে তো পেয়েছে… সব হারানোর বদলে, সব ভুলে যাওয়াই তো ভালো… বার বার ডক্টর সামন্তের গাওয়া গানটা মনে পড়ে তার;

-“শুধু একদিন ভালোবাসা, মৃত্যু যে তারপর…”

একদিনের অনেক বেশীই তো পেয়েছে সে। শুধু মেঘার কোনও স্মৃতিই মনে থাকবে না, এটা এখন কষ্টের মনে হচ্ছে… ভুলে গেলে কষ্টের তো আর কারণই থাকবে না…

Photo by Min An on Pexels.com

আবার ড্রইয়িং-এ বেড়িয়ে এসে ফোন কানে তোলে সোমনাথ…

-“ডক্টর সামন্ত? আমি প্রস্তুত…”

-“তাহলে কাল দেখা হচ্ছে… অফিসের পরে?”

-“নাহ… অফিসের পর নয়… ওই অফিসে আমি আর যেতে চাই না… মেঘা অফিস বেড়িয়ে গেলে, তারপর…”

-“বেশ… আমি রাসবিহারীর মোড়ে চলে আসব…”

-“ঠিক আছে… তবে একটা প্রশ্ন, ডক্টর সামন্ত… আমার এই রিয়ালিটিতে, আপনি কি করে এলেন?”

-“এর পেছনে আমার মনে হয় দু’টো কারণ আছে; এক আমি না থাকলে ই-আর বীমার থাকত না, আর তোমার এই রিয়ালিটিতে আসা সম্ভবও হত না, তাই এই রিয়ালিটিতেও আমি আছি। আর দুই, আমার কানের পেছনে লাগানো মেমোরি রিটেইনারটা। তোমার মতো আমিও তাই দু’ই রিয়ালিটির একটা ছোট্ট সংযোগ। আমার অন্তত এই দু’টো কারণই মনে হয়।”

-“আচ্ছা… কাল দেখা হবে… সব তৈরী রাখুন…”

বিছানায় ফেরত আসে সোমনাথ; কিন্তু শুতে নয়। আজ সে সারারাত জেগে থাকবে, আর প্রাণ ভরে দেখবে মেঘাকে শেষবারের মতো… পরের জন্মে কি হবে সে জানে না, কিন্তু এ জন্মে তার মেঘার ওই মায়াবী মুখ আর ঘুমন্ত চোখদু’টোর দিকে তাকিয়ে থাকার এই শেষ সুযোগ। রাত গভীর হয়ে ভোরের দিকে এগোয় সোমনাথ জেগে থাকে; চোখে জল… ঘুম নেই।

যদি আমাদের জীবনে কোনও অপূরণীয় ক্ষতি হয়, কিন্তু সেই ক্ষতির কোনও স্মৃতি আমাদের না থাকে, তাহলে সেটা ক্ষতি, না শুধুই বিস্মৃতি… ভাবুন… বৃহস্পতিবার শেষ হবে তরঙ্গ…


শান্তির আশায়,

নীল…

Advertisement

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.