বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি সোমনাথকে। সে গিয়ে দাঁড়াবার ক’য়েক সেকেন্ডের মধ্যেই একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায়। ডক্টর সামন্তই বসে আছেন চালকের আসনে। সোমনাথ গাড়িতে উঠে বসলেই, তিনি রওনা দেন।
-“কি, নার্ভাস লাগছে? মনে হচ্ছে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি?”
-“না… মানে…”
-“ঘাবড়াবেন না মশাই… আপনার বিন্দুমাত্র ক্ষতি করবার ইচ্ছা আমার নেই। তবে আপনাকে আমার বিশেষ দরকার; আর আপনারও আমাকে…”
-“আচ্ছা, আপনি কে বলুন তো?”
-“আমি? ও… হ্যাঁ, এ উত্তরটা অবশ্য যেতে যেতেই দেওয়া যায়। কার্ডেই দেখেছেন, আমার নাম অজিতেশ সামন্ত; আর নামের আগের ডক্টরটা মরা কেটে নয়, থিসিস লিখে পাওয়া। আমার বাড়ি ছিল সাবেক উত্তর কোলকাতায়, পড়েছিলাম স্কটিশ চার্চে। স্কুলের পাঠ শেষ করে ভর্তি হলাম প্রেসিডেন্সিতে, ফিজিক্স অনার্স। তারপর আমাদের রাজাবাজারেই এম এস সি। পি এইচ ডি করতে গেলাম ফার্মি ন্যাশানাল অ্যাক্সিলারেটর ল্যাবরেটরী, মানে যেটাকে লোকে ফার্মিল্যাব নামেই বেশী চেনে। তারপরও মার্কিন মুল্লুকে ছিলাম প্রায় ছাব্বিশ বছর, কাজ করতাম ক্যালটেক-এ, হাই-এনার্জি ফিজিক্স বিষয়ে। দেশে ফিরে সেই ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতেই যোগ দিয়েছিলাম…”
সোমনাথ শুনে যাচ্ছিল, কিন্তু সে এখনো ঠিক বুঝতে পারছিল না, এই লোকটা কিভাবে তার প্রশ্নের উত্তর দেবে, বা সমস্যার সমাধান করবে।
-“কি ভাবছেন? ভাবছেন ফিজিক্স কি হবে, আমার তো ‘সাইকোলজি’ দরকার… না মশাই না… আগের দিনই বলেছি আপনার সমস্যাটা শারীরিক বা মানসিক নয়।”
সোমনাথ এরপর আর কোনো কথাই বলে না। প্রায় ২০ মিনিট পর, গাড়িটা গিয়ে থামে উত্তর কোলকাতার একটা অভিজাত পাড়ায়। একটা বেশ সেকেলে বাড়ির ভেতর, ডক্টর সামন্তের পেছন পেছন ঢুকল সোমনাথ।
ঘরটা আকারে বেশ বড়, কম্পিউটার ছাড়া, বাকি সবকটা যন্ত্রই সোমনাথের অচেনা। ঘরের আলোটা খুব একটা জোরালো নয়, তবে একেবারে মিটমিটেও নয়। আলোটার মধ্যে একটা মায়াবী ভাব আছে।
-“বসুন…”
একটা চেয়ারের দিকে নির্দেশ করে আর একটা চেয়ার সামনে টেনে সেটায় বসলেন ডক্টর সামন্ত।
-“এবার মাথাটা ঠান্ডা করুন; আপনাকে খুব সোজা কয়েকটা প্রশ্ন করব, সেগুলোর উত্তর দিন। ঠিক আছে? আপনি প্রস্তুত?”
মৃদু মাথা নাড়ে সোমনাথ।
-“আপনার নাম?”
-“সোমনাথ সেন…”
-“বাবা আর মায়ের নাম ?”
-“শশধর সেন আর লীলা সেন…”
-“স্ত্রীর নাম?”
-“মেঘা সেন…”
-“বাড়ি?”
-“কালিঘাট, রাসবিহারীর কাছে…”
-“বয়স?”
-“২৭ বছর…”
-“ডেট অফ বার্থ?”
-“১৮ই সেপ্টেম্বর…”
-“জন্মসালটা বলুন…”
-“……………”
সোমনাথের মনের মধ্যে একটা ঝড় চলছে যেন। কিছুতেই তার মনে পড়ছে না নিজের জন্মসালটা! আর তার সাথে মাথায় শুরু হয়ে গেল প্রচন্ড ব্যাথা; সোমনাথ দু’হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরল নিজের। ডক্টর সামন্ত নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে এলেন। সোমনাথের মাথাটা তিনিও দু’হাত দিয়ে চেপে ধরে বললেন
-“আপনার জন্মসাল কি, সোমনাথ বাবু? বলুন… আপনার বয়স ২৭ হলে আর এটা ২০২০ সাল হলে আপনার জন্মসাল হয় ১৯৯৩; কিন্তু সেটা হিসেব করে বের করার কথা নয়, কেউ নিজের জন্মসাল ভোলে না, সোমনাথ বাবু… বলুন, কি আপনার জন্মসাল…”
-“আমি জানি না… আমার মনে পড়ছে না… আমার মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা…”
-“আপনি জানেন, আপনার মনে আছে… বলুন, বলুন আপনার জন্মসাল…” প্রায় চিৎকার করে ওঠের ডক্টর সামন্ত; আর সেই চিৎকারের দৌলতেই কিনা, সোমনাথের মুখ থেকে একটা সংখ্যা বেড়িয়ে যায়, আর সঙ্গে সঙ্গেই থেমে যায় তার মাথার ব্যাথাটা…
-“১৯৫৩…”
সোমনাথকে ছেড়ে দিয়ে ধপ করে সামনের চেয়ারে বসে পড়েন ডক্টর সামন্ত।
-“বয়স কত আপনার?”
-“সা-সাতাশ…”
-“আপনার বয়েস ২৭ হলে আপনার জন্মসাল কি করে ১৯৫৩ হয়?
-“না না… আমার জন্মসাল ১৯৯৩…”
-“সেটা তো আমি বলে দিলাম… আপনি নিজে মুখে স্বীকার করলেন ১৯৫৩… তাহলে তো আপনার বয়েস ৬৭ হওয়ার কথা…”
এবার সোমনাথ কেঁদে ফেলে, হাউ হাউ করে…
-“আমাকে বাঁচান, ডক্টর সামন্ত… আমি জানি না আমার কি হচ্ছে… এসব কেন হচ্ছে… প্লিজ…”
ডক্টর সামন্ত এগিয়ে এসে সোমনাথের কাঁধে একটা হাত রাখেন।
-“এদিকে এসো…” -বলে সোমনাথকে নিয়ে গিয়ে একটা যন্ত্রের সামনে বসিয়ে কতগুলো ইলেকট্রোডের মত জিনিস সোমনাথের কপালে আটকাতে আটকাতে বলতে শুরু করেন ডক্টর সামন্ত…
-“মানুষের মন, মানে হিউম্যান মাইন্ড… সত্যি চমপ্রদ জিনিস। সায়েন্স, টেকনোলজী এসব ফিজিক্সের নিয়ম হলেও, সেগুলোকে সংজ্ঞায়িত এবং সংখ্যায় মাপা মানে কোয়ান্টিফাই করার কাজটা কিন্তু করেছে সেই, হিউম্যান মাইন্ড। আজ যে এই ঘরে দাঁড়িয়ে আছি আমরা, এ ঘরের প্রতিটা যন্ত্রই আসলে মানুষের মনের সেই অসীম শক্তির প্রকাশ।”
ইলেকট্রোড গুলো লাগানো শেষ হলে আবার চেয়ার টেনে সোমনাথের সামনে বসলেন তিনি।
-“তোমার কি হয়েছে, এটা জানার আগে, একটু আত্মপ্রচার না করলে হবে না… ২৬ বছর বিদেশে থাকাকালীন আমি হাই এনার্জি ফিজিক্সের সাথে সাথে আর একটা জিনিসের প্রতি প্রচন্ড আকৃষ্ট হয়েছিলাম। সেটা হল ‘আইনস্টাইন-রোসেন ব্রীজ’। চলতি কথায় যাকে বলে ওয়ার্মহোল… অর্থাৎ আমাদে ফোর ডিমেনশনাল স্পেশ-টাইমের দু’টি ভিন্ন বিন্দুর মধ্যে একটা কানেকশন, যাতে একবিন্দু থেকে আর একবিন্দুতে যাতায়াত করা যাবে খুব সহজেই। হাজার হাজার বছর লাফিয়ে চলে যাওয়া যাবে, এক নিমেশে…”
-“আপনি টাইম ট্রাভেলের কথা বলছেন?”

হেসে ফেলেন অজিতেশ সামন্ত; হা হা হা হা করে অনেক্ষণ হাসার পর তিনি আবার মুখ খোলেন…
-“কি? কি মনে হচ্ছে? বস্তাপচা একটা কাঁচা কল্পবিজ্ঞানের প্লট শোনাচ্ছি? না মশাই না… আসলে এই আইনস্টাইন রোসেন ব্রীজ, টাইম ট্রাভেল, কল্পবিজ্ঞানের গপ্পো আর হলিউডি ছবির দৌলতে এত খেলো হয়ে গেছে না, লোকে শুনলেই ভাবে ঢপ দিচ্ছি।”
-“না… মানে…”
-“আরে মশাই, একটা জিনিস নিয়ে বেশী চটকালে তেতো তো হবেই, তাই না… লোকের আর দোষ কি?”
সোমনাথ চুপ করে যায়।
-“ব্যাপারটা নিয়ে অবসেসড হয়ে গেলাম। প্রচুর পড়াশোনা করতে থাকলাম। ইউনিভার্সিটির লোকে আমার মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করল। ক্যালটেকের চাকরীটা গেল। কিন্তু ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি স্বজনপোষন করে এসেছে চিরকালই, আর আমার সিভির দৌলতে একটা প্রফেসরশীপ নিয়ে দেশে ফিরে এলাম। কিন্তু সমস্যা হল টাকার। প্রচুর টাকা দরকার আমার। আর শুধু ইউনিভার্সিটির মাইনেতে সেটা সম্ভব নয়। তখন আমি বেপরোয়া। বিভিন্ন জায়গায় ফান্ডের জন্য ঘুরেছি। প্রথমে বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি, বিভিন্ন কোম্পানি… সারা না পেয়ে ডার্ক ওয়েবে অবধি প্রচুর শেল কর্পোরেশনের কাছে… আর সাহায্য পেলাম সেখান থেকেই। আগেপিছে কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে গেলাম। কাজ চলতে লাগল। দেশে ফেরার পর প্রায় ৬ বছরের প্রচেষ্টায় তৈরী হল ‘ই-আর বীমার’ বা ‘আইনস্টাইন – রোসেন বীমার’ অথবা একেবারে সোজা বাংলায় বলতে গেলে…”
-“টাইম মেশিন…” -সোমনাথের মুখ ফস্কেই যেন বেড়িয়ে যায় কথাটা…
-“তারপরই আমার স্পন্সর-এর আসল রূপ দেখতে পেলাম; কোনো শেল কর্পোরেশনের পেছনে কে বা কারা থাকে, মাঝে মাঝে এফ বি আই বা এন এস এ-এর পক্ষেও জানা সম্ভব হয় না… ‘অপ্টিমাস টেক’-নামক শেল কোম্পানিটির পেছনে আছে ‘জ্যানিস’ নামে একটি সন্ত্রাসবাদী সংস্থা; বায়ো এবং ই-টেরোরিজমেই যারা সিদ্ধহস্ত। টাকা নেওয়া শুরু করার সাথে সাথেই ছ’বছর ধরে আমাকে তারা মনিটার করে গেছে আর আমার হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মিলিয়ে গেছে।”
ক’য়েক মুহূর্ত চুপ করে গেলেন ডক্টর সামন্ত।
-“সেদিন ১৬ই অক্টোবর, ২০২০… ইউনিভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরে দেখলাম, আমার ল্যাবোরেটরী তছনচ করা, ই-আর বীমার টা নেই, চুরি গেছে…”
-“জ্যানিস চুরি করল, করার পর?”
-“মানুষের মঙ্গলের কাজে যে লাগাবে না, সে তো বোঝাই যাচ্ছিল। ওদের খোঁজার আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু… দে ওয়ের গুড অ্যাট কভারিং দেয়ার ট্র্যাকস… পুলিশ বা অন্য কোথাও যাওয়ার ক্ষমতাও ছিল না আমার; সবাই পাগল ভাবত। তবে, যন্ত্রটার ইন্টারফেস আমি তখনো মনিটার করতে পারছি, আর যন্ত্রের প্রথম প্রোটোটাইপটা আমি ইউনিভার্সিটির অফিসে লুকিয়ে রাখায় সেটা হাতছাড়া হয়নি। কয়েকবার টেস্ট রান করেছিল ওরা, এদিক ওদিক… তারপর, জ্যানিস লম্বা সময়ের জন্য ব্রীজ খুলল, ২২শে নভেম্বর, ২০২০… যে ব্রীজের অপরপ্রান্তে ২২শে নভেম্বর, ১৯৮০…”
সোমনাথের মাথার মধ্যে কিসব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে… তার মনের ভেতর যেন একটা বিশাল বড় ঢেউ উঠেছে, কিসের যেন শব্দ পাচ্ছে সে কানে…
-“কলকাতার ইতিহাসের সবচেয়ে সাংঘাতিক সন্ত্রাসবাদ… সি-ফোর এক্সপ্লোসিভ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হল নির্মীয়মান নর্থ-সাউথ মেট্রোরেলের গোটা টানেলটা… শয়ে শয়ে লোক মারা পড়ল, আর রাজ্য এবং জাতীয় সরকারের যৌথ উদ্যোগে বন্ধ করে দেওয়া হল কোলকাতা মেট্রোরেলের কাজ, শুধু তাই নয়, অন্যান্য শহরেও পাতালরেলের প্রস্তাবিত সমস্ত কাজ বন্ধ করে দেওয়া হল, চিরতরে…”
সোমনাথের সারা গা কাঁপছে… কেন জানে না…
-“আমার কানের পেছনে এই যন্ত্রটা দেখছ?”
ডক্টর সামন্ত এগিয়ে এসে কানের পেছনে হিয়ারিং এইডের মত একটা যন্ত্র তৈরী দেখান।
-“এটা আমার মেমোরী কে প্রিজার্ভ করে… অর্থাৎ আমার অবর্তমানে অন্য কেউ ই-আর বীমার ব্যবহার করলে, আমার স্মৃতিতে কোনও প্রভাব পড়বে না…”
সোমনাথ কোনও উত্তর দিতে পারে না…
-“যাই হোক… বিষ্ফোরণের সময় অনেক লোক মেট্রোর সুড়ঙ্গের মধ্যে ছিল, তাদের বেশিরভাগেরই মৃতদেহ পাওয়া যায়; আসলে বেশিরভাগের নয়, সবারই পাওয়া যায়, একজনের ছাড়া, জানো কার?”
সোমনাথ কথা বলার মতো অবস্থায় নেই; একটা প্রচন্ড ভয় তাকে গ্রাস করেছে… মাথাটা আবার দপ দপ করছে তার…
-“সার্কিট ইঞ্জিনিয়ার সোমনাথ সেন… তুমি…”
সোমনাথের যেন নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে এবার… কি বলতে চাইছেন ভদ্রলোক? সে কি মরে ভূত হয়ে গেছে… সবই কি তার… মানে সে কি নরকে… তাহলে কি এসব… ওফফফ ভাবতে পারছে না সোমনাথ…
-“আমি আন্দাজ করতে পারি ব্যাপারটা কি হয়েছিল… গোটা টানেলটা সি-ফোর দিয়ে রিগ করার পর, যখন জ্যানিস-এর লোকজন উলটোপথে ২০২০-তে ফেরার চেষ্টা করছিল, তখন তুমি তাদের সংষ্পর্ষে আসো… আর তাদের সাথে তুমিও এসে পৌছাও ২০২০তে…”
সোমনাথ কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই, ডক্টর সামন্ত একটা যন্ত্রের বোতাম টিপে দেন, আর সোমনাথ জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে…
প্রেমের গপ্পো আর মনে হচ্ছে না, কি বলেন ??? এই অধ্যায়টা পড়ার পর একটা গান শোনা আবশ্যক… রেশটাকে ধরে রাখার জন্য…
Hazy Shade of Winter – The Bangles
শান্তির আশায়…
নীল…