সাধারণ এ-ফোর কাগজে প্রিন্ট করে, খুব এলোমেলো ভাবে হাতে কেটে তৈরী কার্ডটা। যেন কেউ খুব তাড়াহুড়ো করে তৈরী করেছে, হয়তো তাকেই দেওয়ার জন্য। রাতের খাওয়ার পর সেটাই ভালো করে নেড়ে চেড়ে দেখছিল সোমনাথ। বলাই বাহুল্য বাড়ি ফেরার সময়টা তার খুব একটা শান্তির হয়নি। বিরিয়ানি কিনতে গিয়ে, আরসালানের দোকানটা কেন খুঁজে পেল না সেটা নিয়ে এখনো ধন্ধে রয়েছ; যেখানে আরসালান থাকার কথা, সেই জায়গায় একটা বিরাট বড় হোটেল।
বাকি রাস্তাটায় একই কথাগুলো মাথায় ঘুরে গেছে;
“আরও বাড়বে” “কমে গেলে বিপদ” “আমার কথা শোনার মত মনের অবস্থা আপনার নেই” এবং তদোপরি, “আপনি পাগল নন…”
কি হচ্ছে এসব ? কেন হচ্ছে এসব ? বাড়ি ফিরে একা একা ফ্ল্যাটে বসে থাকতে গা-টা কেমন ছমছম করছিল তার। মেঘা অফিস থেকে বেরোনোর পর থেকে অনেকবার সে ফোন করেছে সোমনাথকে। সে বার বার জানতে চেয়েছ, কি হয়েছে সোমনাথের; কিন্তু হেসে বলেছে ‘আজ তোমাকে বড্ড মিস করছি গো’।
মেঘা ফেরার সঙ্গে সঙ্গে তাকে জড়িয়ে ধরেছে সোমনাথ। মেঘা হেসে উঠেছে;
-“এই পাগল; কি করছ টা কি? ছাড়ো… বাইরে থেকে এসেছি…”
সোমনাথ জানে, তাকে ছাড়তে হবে, কিন্তু ছাড়তে সে চায় না। দিনের শেষে মেঘার পারফিউমের সাথে ঘামের গন্ধ মিশে যে অদ্ভূত গন্ধটা তৈরী হয়, সেটাতে ওর হালকা হালকা নেশা লাগে; মনে হয় জাপটে, জড়িয়ে আষ্টেপৃষ্টে থাকতে ওর সাথে, সারাজীবনের জন্য। এই আলিঙ্গনটার জন্য প্রতিদিন অপেক্ষা করে সে, কিন্তু আজ মেঘা আর একটু দেরী করলে সে বোধহয় কেঁদেই ফেলত।

তারপরও, সোমনাথ বুঝতে পেরেছে মেঘাকে দেখে একটু শান্তি অনুভব করলেও, মনের ভেতরের দোলাচলটা কিছুতেই কাটছে না। তাই রাতের খাওয়ার পর পার্স থেকে কার্ডটা বের করে নেড়েচেড়ে দেখছিল সে।
-“ওটা কি দেখছ গো?”
-“অ্যাঁ ! হ্যাঁ… না… ওই একজন ভদ্রলোক কিছু গ্রিভেন্স নিয়ে এসেছিলেন… লোকে ইয়ার্কি মেরে আমার টেবলে পাঠিয়ে দিয়েছে। তিনি কার্ডটা দিয়েছিলেন তাই দেখছি…”
-“তুমি এগুলোকে কেন প্রশ্রয় দাও বলো তো? লোকে তোমার সাথে ইয়ার্কি মেরে যাচ্ছে আর তুমি…”
-“লিভ ইট না, বাবু… দেখো ওরকম লোক থাকবেই, যারা লোকের পেছনে লেগে থাকে, আর আমিও যদি অ্যাটেন্ড না করে আবার কারো টেবলে পাঠাতাম, তাহলে আমার সাথে বাকিদের তফাত রইল কোথায় বল তো?”
মেঘার মুখে একটা প্রশান্তির হাসি ছড়িয়ে যায় কথাটা শুনে। সে সোমনাথকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা রেখে বলে
-“আ’ম সো লাকি টু হ্যাভ ইউ, সমু… অথচ তোমার এই পিওর কোরটার জন্যই সবাই তোমার পেছনে লাগে… আমার একদম ভাল লাগে না…”
সোমনাথও এবার মেঘাকে জড়িয়ে ধরে। গত দু’দিন যা যা ঘটছে, সেটার পর মেঘা না থাকলে সোমনাথ কি না কি করে বসত, সে নিজেও ভেবে পায় না।
দু’জনে শুয়ে পড়ার পর, মেঘা সহজেই ঘুমিয়ে পড়ে; কিন্তু সোমনাথ জেগে থাকে। যখন বুঝতে পারে, মেঘা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন খুব সন্তর্পণে বিছানা ছেড়ে উঠে ঘর থেকে বেড়িয়ে খাবার জায়গায় আসে। কার্ড দেখে ফোনে নম্বরটা ডায়াল করে।
-“হ্যালো…”
-“সোমনাথ বাবু, আপনি কি প্রস্তুত ?”
-“দেখুন, আমি বুঝতে পারছি না আপনি কি প্রস্তুতির কথা বলতে চাইছেন… কি হয়েছে আমার ?”
পরের প্রশ্নটা অদ্ভূত…
-“মাট্রিক্স দেখেছেন ?”
-“কি ?”
-“ম্যাট্রিক্স, ম্যাট্রিক্স… আরে বাবা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর গাইড বই নয় সিনেমা… কিয়ানু রীভস আর লরেন্স…”
-“হ্যাঁ দেখেছি… কথাটা শেষ না করতে দিয়েই উত্তর দেয় সোমনাথ…”
-“ব্লু-পিল আর রেড পিলের কথাটা মনে আছে ?”
-“হ্যাঁ…”
-“রেড পিল মানে কঠিন সত্য আর ব্লু পিল মানে এড়িয়ে যাওয়া… শুধু আপনার ক্ষেত্রে সমস্যা হল, সময় মত রেড পিলটা না খেলে, সমূহ বিপদ…”
-“দেখুন… আপনার এই ক্রিপ্টিক কথাবার্তা আমার মোটে ভালো লাগছে না… আপনি ঝেড়ে কাশবেন? কি বিপদ? কার বিপদ…”
-“সে ঝেড়ে আমি কাশব; কাশব, হাঁচব… ঝেড়ে যা যা করা যায় সবই আমি করব। আপাতত কাল অফিস যান, ছুটির সময় দেখা হচ্ছে, আর আপনার স্ত্রীকে অবশ্যই বলে যাবেন, জরুরী কাজে অফিসের বাইরে যেতে হবে, তাই ফিরতে দেরী হবে… কাল ছুটির সময় দেখা হচ্ছে…”
-“কাল… মানে…”
-“আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া, এবং বিশ্বাসযোগ্য উত্তর দেওয়া আমার দায়িত্ব… আপাতত শুয়ে পড়ুন। কাল কথা হবে।”
উল্টোদিক থেকে ফোনটা কেটে গেল মৃদু শব্দ করে। সোমনাথ আবার এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল চুপচাপ।
কে লোকটা… কি জানে? সোমনাথকে বিপদে ফেলতে চাইছে না তো? কিন্তু সোমনাথের বিপদে পড়ার মতো আছেই টা কি? মেঘা তো সঙ্গে যাচ্ছে না… তাহলে আর চিন্তা কি… হয়ে যাবে এস্পার নয় ওস্পার… এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুম আসে সোমনাথের চোখে।
সকালে উঠে অফিস যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে বেরোনো পর্যন্তও খুব স্বাভাবিকই ছিল মনের অবস্থা। কোনও দুশ্চিন্তা ছিল না, শুধু মনে হচ্ছিল, আজ এতদিন পড়ে তার সব প্রশ্নের উত্তর সে পেতে চলেছে, আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে সব, যেরকম আগে ছিল।
-“আজ আমার ফিরতে একটু দেরী হবে… একবার হাওড়া যেতে হবে…”
-“ও… ঠিক আছে, আমি অফিস থেকে বেড়িয়ে কল করে নেবো তোমায়…”
মেঘাকে কাল রাতে পর এই দ্বিতীয়বার মিথ্যে কথা বলল সোমনাথ। হ্যাঁ, শুনতে খুব অবাস্তব মনে হয়, কিন্তু কথাটা সত্যি। সম্পর্কের মাঝখানে মিথ্যের কোনো স্থান নেই, এটা চিরদিন মনে করে এসেছে তারা দু’জনেই। আর সবচেয়ে বড় কথা, মিথ্যে বলার প্রয়োজনই বা পড়বে কেন? দু’জন সবথেকে কাছের মানুষ, তারা একে অপরজনের কাছে মিথ্যে বলবেই বা কেন? আসলে বাইরের সবার সামনে মিথ্যে, আর ধৃষ্টতার যে আবরণটা আমরা তৈরী করি, সেটা আমাদের সবচেয়ে কাছের মানুষের সামনে যদি খসে নাই পড়ল, তাহলে…
অফিসের বাসে উঠে সোমনাথের বুকটা একটু কেঁপে ওঠে। ঠিক করছে তো? লোকটার কাছে গিয়ে অজান্তেই নিজের বিপদ ডেকে আনছেনা তো? এসব ভাবতে ভাবতেই আবার চোখ বোজে সে। অফিসের স্টপে নেমে এবং অফিসে ঢোকা পর্য্যন্ত আবার সব ঠিক মনে হয়। অফিসে বসে বসে ঘড়ির কাঁটার এগোনো, একটু একটু করে তার হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দেয়, আবার।
অফিস ছুটি হওয়ার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে, তার ফোনে একটা ফোন আসে।
-“হ্যালো?”
-“অফিস থেকে বেড়িয়ে বাঁদিকে হাঁটবেন; যেখানে ফুটপাথ শুরু হচ্ছে, ঠিক সেখানেই দাঁড়াবেন।”
-“আ-আচ্ছা…”
ফোনটা রাখার পর এবার সোমনাথের মনে হয়, হৃৎপিণ্ডটা ফেটেই যাবে বোধহয়…