-“তখন থেকে কি এত চিন্তা করছ বল তো ? খাবারে মন নেই, কথাও বলছ না আজ… কি হয়েছে সমু ?” -মেঘার কথায় চটক ভাঙে সোমনাথের।
বাড়ি ঢুকে থেকে মনটা বড্ড অস্থির হচ্ছিল। খাবার কিনে আনেনি বলে খাবার অর্ডার দিয়েছিল। কিন্তু একা একা ফ্ল্যাটে নিজেকে কেমন অসহায় মনে হচ্ছিল তার। সকাল থেকে একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে মনের ভুল বলে নিজেকর শান্ত করা যাচ্ছিল না; বিশেষ করে লোকটা ভিজিটিং কার্ড দিয়ে যাওয়ার পর থেকে মাথাটা বড্ড ঘেঁটে রয়েছে।
-“কি হল সমু ? বল আমায়… কি হয়েছে ? এরকম মনমরা কেন হয়ে আছ তুমি ?” -মেঘা আবার প্রশ্ন করে।
-“না, কিছু না… একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম…”
এ প্রশ্নের উত্তরে যে মেঘা চুপ করবে না, সেটা সোমনাথ ভালোই জানে। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পেটের কথা বের না করতে পারলে তার মাথা ঠান্ডা হয় না। মেঘার এই স্বভাবের জন্য, সোমনাথও অনেক কথা, ছোটখাটো কথা, যেগুলো মেঘার মাথায় ঢুকিয়ে তাকে বিব্রত করবে না ভাবে, সেগুলোও মেঘার নাছোড়বান্দা স্বভাবের জন্য শেষমেশ না বলে পারে না। এর পরের উত্তর জানা আছে সোমনাথের। এবার মেঘা অভিমান করবে।
-“ও, মানে আমাকে বলা যাবে না, তাই তো ?”
সোমনাথ এবার বেশ জোরে শব্দ করে হেসে ফেলে। তারপর হাসিমুখেই বলে,
-“তোমায় কতটা চিনি, জানো ? আমি জানতাম আমার এই উত্তরটার পরে তুমি ঠিক এই কথাটাই বলবে।”
মেঘাও হেসে ফেলে এবার।
-“তুমি বলবে কি না বল ?”
-“আচ্ছা, বলব… এখন খেয়ে নাও, রাতে বলব।”
খাওয়া শেষ করে রোজকার মতো বাসনপত্র ধুয়ে শুতে যায় দু’জনে। বিছানায় শুয়েই মেঘা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সোমনাথকে।
-“এবার বল তো ?”
-“আমি বড্ড অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছি আজকাল, জানো তো… আজ বাসে যেতে যেতে হঠাৎ মনে হল এখানের রাস্তাটা এরকম ছিল না। অফিসে বসে বসে ফোনটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকেও ওটাকে যে মোবাইল বলে, সেটা কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। বাড়ি ফিরেও, মানে পাড়ায় ঢুকে অনেকক্ষণ কয়ালের মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম, মনে হল এখানে মাঠ নয়, অন্যকিছু থাকার কথা। জানিনা কেন এরকম হল; মনটা খুব বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে।”
মেঘা যেন আরও কাছে এগিয়ে আসে।
-“কাজের খুব প্রেশার যাচ্ছে, সমু ? নাকি স্বরূপদা আবার কথা শুনিয়ে গেছে ?”
-“না সেরকম কিছু নয়… কাজের প্রেশার নেই তেমন, আর স্বরূপদা আজ এলেও সেরকম কিছু বলেনি। বেশীক্ষণ থাকেওনি আসলে, হাওড়া ডিভিশনে কাজ হচ্ছে বলে অ্যাপ্রুভাল নিয়েই চলে গেছে…”
-“আচ্ছা… চিন্তা কোরো না… এরকম টাইম-টু-টাইম হয়। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছি তো, দু’জনে আছি তো… দু’জনের সমস্যা দু’জনে না জানলে হবে কি করে?”
কথাটায় মাথা নাড়ে সোমনাথ। কিন্তু তবু ভুল করেও সিগারেট খেয়ে ফেলার কথাটা মেঘার কাছে বলতে পারে না। মেঘা রাগ করবে। আসলে রাগ করবে না, অভিমান করে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদবে। ভাববে এতটাই কাজের চাপ বেড়ে গেছে যে সোমনাথ তাকে না বলে সিগারেট খাওয়া শুরু করেছে। আজকের দিনটা এরকম গেল কেন, এটা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে সোমনাথ মনে নেই। যখন ঘুম ভাঙল, তখন সে একটা ঘরে বিছানায় একা শুয়ে। মেঘা নেই তার পাশে। আর এটা তার আর মেঘার ফ্ল্যাটও নয়। কিন্তু ঘরটা তার অসম্ভব চেনা। প্রতিটা দেওয়াল, প্রতিটা খসে পড়া পলেস্তারা, বিবর্ণ হয়ে যাওয়া রং সবই যেন তার খুব কাছের।
ঘরটা থেকে বেরোলেই একটা বারান্দা, আর সেই বারান্দাতেও আরও অনেক ঘর, পরপর… একজন প্রৌঢ় লোক বারান্দা ধরে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। হাসিমুখে এসে সোমনাথকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন
-“কি হে সোমনাথ! তোমাদের গর্ত খোঁড়ার আর কতদিন বাকি হে ?”
সোমনাথ এরকম অদ্ভূত প্রশ্নের উত্তর দিতে যাওয়ার আগেই দেখল, সে আর সেই বারান্দায় নেই, আবার ফিরে গেছে গত রাত্রে স্বপ্নে দেখা সেই সুড়ঙ্গে। রেলের লাইন পাতা সেই অন্ধকার সুড়ঙ্গে সোমনাথ একা।
একা ? না, দুরে কিছু লোকের জটলা দেখা যাচ্ছে এবার। সেদিকে এগোতে যেতেই ঠিক সেইদিনের মতো একটা আগুনের বিরাট স্রোত পেছন থেকে তাকে তাড়া করল আবার। আর সোমনাথের ঘুম ভেঙে গেল তখনই।
গোটা ঘরে অন্ধকার, কিন্তু রাস্তার আবছায়া আলোতে দেখা যাচ্ছে মেঘা অঘোরে ঘুমোচ্ছে তার পাশে। সোমনাথ ঘেমে নেয়ে গেছে। হাঁপাচ্ছে। একইরকম স্বপ্ন আবার ? কেন ? সোমনাথ উঠে বাথরুমে যায়। চোখে মুখে জল দেয় ভালো করে, ঘরে ফিরে আসে। আবার শুয়ে পড়ে। বাকী রাতটা আর ঘুম আসে না। পরপর ঘটে চলা ঘটনার রেশে, নিজেকে একটা ঘোরের মধ্যে মনে হয়। সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে ? এসব কি মানসিক বিকৃতির লক্ষণ নয় ? তার কি ডাক্তার দেখানো উচিৎ ?

ডাক্তার! কথাটা শুনেই মনে হল সেই লোকটার কথা, সকালে অফিস থেকে বেরোনোর পর যে কার্ডটা দিয়ে গেছিল; লোকটার নামের আগে একটা ডক্টর কথাটা লেখা ছিল তো। কিন্তু সে লোকটা কি করে জানল ওর এরকম অবস্থা চলছে? অন্তর্যামী নাকি? একবার ফোন করে দেখবে? এটা ভাবার পরই সোমনাথ নিজেই নিজেকে ধমক দেয়। এত রাতে ফোন করবে? নাহ, সত্যিই মাথায় গন্ডগোল দেখা দিচ্ছে তার এবার।
আবার বিছানায় এসে শুয়ে পড়ে, অনেক চেষ্টা করে ঘুম আসে ভোরের দিকে।
সকালে উঠে মনে হয় একটা স্বপ্ন নিয়ে একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলছে বোধ হয়। এতটা ভাবা উচিৎ নয়। আসলে ক’য়েকদিন আগেই ‘Taking of Pelham 1-2-3’ সিনেমাটা দেখেছিল। আমেরিকার একটা পাতাল রেল হাইজ্যাক করা নিয়ে। সেটারই কিছু নিয়ে হয়তো স্বপ্ন গুলো তৈরী হচ্ছে; স্বপ্ন তো বাস্তবের রসদ, বাস্তবের ইন্ধনেই তৈরী হয়।
অফিস যাওয়ার সময় আজ একা বেরোতে হয় তাকে; মেঘার তাড়া থাকায় ও আগে আগে বেড়িয়ে গেছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে কয়ালের মাঠের সামনে আবার থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে; আবার যেন মনে হয়, এখানে কি একটা ছিল; মানে মাঠ ছিল না। তবু জোর করে পা চালিয়ে বাসে উঠে পড়ে গোটা রাস্তাটা আজ চোখ বুজে কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে কাটিয়ে দেয়। কন্ডাক্টার ডাকলে তার স্টপে নেমে পড়ে।
আজ অফিসে কোনও দিকে না তাকিয়ে মুখ গুঁজে কাজ করে যায়; টিফিনে আজ আর বাইরে যায় না পায়চারী করতে, যন্ত্রমানবের মত এক-দু’বার উঠে বাথরুম থেকে ঘুরে আসে শুধু। কোনওরকমে অফিসের সময়টুকু পেড়িয়ে রাস্তায় নেমে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
আজ আর ভুল হবে না; আজ বাড়ি যাওয়ার আগে ঠিক আরসালানের বিরিয়ানি নিয়েই যাবে। মেঘা হয়তো রাগ করবে, দু’দিন পর পর বাইরের খাওয়া হল বলে, কিন্তু থাক। বড্ড খাটুনি যাচ্ছে ওর আজকাল।
এসব ভাবতে ভাবতে পার্ক সার্কাসের ক্রসিং-এর দিকে এগোচ্ছে, এমন সময় আবার কাঁধে টোকা পড়ল। পেছনে ফিরে প্রায় আঁতকে উঠল সোমনাথ। কালকের সেই ডক্টর অজিতেশ সামন্ত। তার দিকে তাকিয়ে, মুখে কালকের সেই প্রসন্ন হাসিটা আর নেই। একটু গম্ভীরই লাগছে কেমন মুখটা;
-“এগুলো কিন্তু বাড়বে… দিন দিন বাড়বে… কমে গেলেই সর্বনাশ…” -ভদ্রলোক খুব গম্ভীরভাবে বলে ওঠেন কথাটা।
সোমনাথের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, সে কোনওরকমে জিজ্ঞাসা করে,
-“কি-কি বাড়বে দিন দিন ?”
-“আপনার রাতের স্বপ্ন, দিনে চেনা জায়গা, চেনা জিনিসকে চিনতে না পাড়া… এটা বাড়বে, মারাত্মক রকমের বাড়বে…”
-“কেন? কি হয়েছে আমার?”
ভদ্রলোক সোমনাথের দু’কাঁধে হাত রাখেন, তারপর খুব ঠান্ডা গলায় বলেন,
-“সোমনাথবাবু, আপনার যে কিছু সমস্যা হচ্ছে, সেটা আপনার নিজের কাছে স্বীকার করা বিশেষ জরুরী। নিজে যখন বিশ্বাস করতে পারবেন, আপনি স্বাভাবিক নন, তখন আমায় ফোন করবেন। কারণ আমি যা বলতে চাই, সেটা শোনার, এবং শুনে বোঝার মত মনের অবস্থা আপনার নেই…”
-“কি হচ্ছে আমার? আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? আপনিই বা কে?”
-“আপনার সমস্যাটা শারীরিক বা মানসিক নয়, সেটা ভালো করে জেনে রাখুন, স্পষ্ট করে জেনে রাখুন, আপনি পাগল নন, আপনার থেকে মানসিক সুস্থ ব্যক্তি এই শহরে খুব কম আছে।”
-“আপনি কে? আপনি কি করে জানেন আমার কি হয়েছে?”
-“বাড়ি যান, সোমনাথবাবু। বিরিয়ানি কিনে বাড়ি যান। আমাকে ফোন না করলে আমি আর আসব না। কিন্তু মনে রাখবেন, যত তাড়াতাড়ি মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে আমার সাথে যোগাযোগ করবেন, ততই মঙ্গল। তা না হলে কি ভয়ঙ্কর বিপদ যে আসছে আমাদের সবার জন্য, সে আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না।”
এইটুকু বলে, মুখ হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকা সোমনাথকে কোনও প্রতি উত্তরের অবকাশ না দিয়েই, লোকটা হনহন করে পার্ক স্ট্রীটের ভিড়ে মিলিয়ে গেল।
আচ্ছা, আপনাদের কি মনে হয়, সোমনাথের কি সমস্যা? আর কে এই ডক্টর অজিতেশ সামন্ত? কি-ই বা বিপদ আসতে চলেছে সোমনাথের? জানান আমায়, আর আমার উত্তরটা শোনার জন্য আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে আরও কয়েক সপ্তাহ।
শান্তির আশায়…
নীল…