-“এই যে, জে কে জি ! কি খবর ?” -অভ্যাস মত সোমনাথের পিঠে একটা অভদ্র চাপড় মেরে প্রশ্নটা করে স্বরূপ দা।
জে কে জি কথাটার অর্থ ‘জোরু কা গুলাম’। সোমনাথের একদম সহ্য হয়না এই নামটা, তবু স্বরূপদা সহ বেশ কয়েকজন ইচ্ছে করেই এই নামে ডেকে থাকে তাকে।
-“এই তো স্বরূপ দা, চলছে… তোমার কি খবর ?”
-“আমার আর কি খবর ভাই… অফিসে বসা তো কপালে নেই, তার ওপর বাড়িতে খান্ডার বউ। খবর তো হবে তোমার; ঠান্ডা ঘর থেকে বেরোনোর বালাই নেই, বাড়িতে সুন্দরী বউ।”
সোমনাথ একটা নকল হাসি হেসে তার মনের বিরক্তিটা লোকানোর চেষ্টা করে। সে জানে অফিসের অনেকেরই মেঘাকে দেখে চোখ টাটায়; আর সোমনাথের অল্প বয়সে অনেক উন্নতি করে ফেলাটাকেও ইর্ষার চোখে দেখে। আর স্বরূপদার চোখটা একটু বেশীই টাটায় এসব ব্যাপারে।
-“তুমি এখানে আজ ? কি ব্যাপার ?”
-“কি আবার ! হাওড়া ডিভিশনে লাইনের কাজের কাগজে তোর একটা সই লাগবে, তাই এলাম…” -এই বলে একটা ফাইল এগিয়ে দেয় স্বরূপ।

সোমনাথ সেটা হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে ভাবে, এটাই সবচেয়ে বড় কারণ স্বরূপদার তাকে নিয়ে। স্বরূপদার নিচের পদে জয়েন করেও সে তাকে টপকে গেছে; সে সিনিয়র হলেও বয়সে বড় বলে ‘স্বরূপদা’ নামটা রয়ে গেছে। কিন্তু বার বার তার কাছে কাজের জন্য এলেও স্বরূপদার মনে যে কষ্ট বা ইর্ষা হয় না, সেটা ভাবলে ভুল ভাবা হবে।
স্বরূপদার কাগজের কাজ শেষ করে নিজের টেবলের ওপর তাকিয়ে একটা অদ্ভূত ধন্দে পড়ে যায় সোমনাথ। কিছুতেই তার টেবলে রাখা চৌকো জিনিসটার নাম মনে করতে পারে না; অথচ জিনিসটা তার খবই চেনা। সেটা হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পর, মনে পড়ে… এটা তো তার ফোনটা; মানে মোবাইল… মোবাইল কথাটা কেন মনে পড়ছিল না তার ? হ্যাঁ, লোকে মাঝে মাঝে অত্যন্ত সাধারণ জিনিস ভুলে যায়, কিন্তু মোবাইলটা যে মোবাইল, এটা ভুলে যাওয়া কি স্বাভাবিক ব্যাপার ?
ভাগ্য ভালো, মোবাইলটার দিকে তার এই বোকার মত চেয়ে থাকার ব্যাপারটা কেউ লক্ষ্য করেনি, নাহলে সেই নিয়ে আবার হাসাহাসি হত। অফিসের বেশিরভাগ লোকই সোমনাথের নরম-সরম স্বভাবের জন্য তাকে অপমান করার ছুতো খোঁজে শুধু শুধু। মেঘাও তাকে বোঝায়; এভাবে লোকের কথার প্রতিবাদ না করে থাকাটা মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়; কিন্তু এই ব্যাপারট ছোটবেলা থেকেই যেন সোমনাথের মধ্যে থেকে গেছে; তার জীনের মধ্যে… চাইলেও যেন পরিবর্তন করার ক্ষমতা নেই তার।
অফিসের কাজকর্ম নেই সেরকম। আজ একটু আগে বেড়িয়ে যাওয়াই যায়। লাঞ্চ ব্রেকে এইসব কথাই ভাবছিল সোমনাথ। রোজ খাওয়া শেষ করে অফিসের সামনে একটু ঘুরপাক খাওয়া স্বভাব ওর। প্রায় মিনিটা পাঁচেক হয়ে গেল তাই করছিল; কিন্তু এমন সময় লক্ষ্য করল চারপাশের অধিকাংশ লোক কেমন অদ্ভূতভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে; যেন কি একটা আজব জিনিস দেখছে প্রথমবার। তারপর সোমনাথই ব্যাপারটা বুঝতে পারে। এতক্ষণ পায়চারী করতে করতে সে সিগারেট খাচ্ছিল। এবং একটান-দু’টান নয়; একটা কিং-সাইজ গোল্ড ফ্লেক প্রায় শেষের পথে। আর এটা আশ্চর্য্যের এই জন্যই, কারণ সোমনাথ কস্মিনকালেও সিগারেট খায় না। শুধু তাই নয়, সিগারেট-এর গন্ধও তার একেবারেই সহ্য হয় না। নাকে গেলেই কাশি হয়, গা গুলোয়। তাহলে সে এতক্ষণ ধরে একটা গোটা সিগারেট শেষ করে দিল ? কি করে ? হাতের পোড়া সিগারেটটা ঘেন্নায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে অপরাধীর মত মুখ করে নিজের টেবলে ফিরে আসে সোমনাথ। মনটা বড্ড বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। তার কি কোনো মানসিক রোগ দেখা দিল ? যেরকম সিনেমায় দেখায়, স্প্লিট পার্সোনালিটি গোছের ? তা না হলে এরকম হচ্ছে কেন ?

বাথরুমে গিয়ে মুখে ঘাড়ে থাবড়ে থাবড়ে জল দেয় ভালো করে। রাস্তাঘাট অচেনা লাগা, কিছুক্ষণের জন্য মোবাইল কথাটা মনে না করতে পারা, মেনে নেওয়া যায়; কিন্তু মনের ভুলে একটা সিগারেট খেয়ে ফেলা ? সবার সামনে পায়চারী করতে করতে সিগারেট খেয়েছে… সবাই কি ভাবছে কে জানে। বাকী সময়টা টাবলে বসে আনমনা হয়েই কাটিয়ে দিল সোমনাথ। অফিসে তাকে নিয়ে যে একটা ফিসফিসানি আর হাসাহাসি শুরু হয়েছে, সেটা সে বুঝতে পারছে বিলক্ষণ।
একটু আগে আগেই বেড়িয়ে পড়ল সোমনাথ। তার কেমন যেন মনে হচ্ছে প্রতিটা কাজ খুব ভেবেচিন্তে, গুনে গেঁথে করতে হবে; না হলেই বিপর্যয় অবস্বম্ভাবী। অফিসে থাকাকালীন মেঘাকে সে ফোন করে না; আসলে অফিস আওয়ার্সে বাড়িতে ফোন করতে তার এথিক্সে বাধে। চারপাশে লোকে দিনরাত যদিও মা, বাবা, বউ, প্রেমিকা সব্বাইকে ফোন করে দিনরাত গজগজ করে যায়; কিন্তু অফিস কম্পাউন্ডের মধ্যে সে কোনোদিন মেঘাকে ফোন করেনি। তাই অফিসের গেট পেরিয়েই তার প্রথম কাজ কানে ফোন ধরা এবং কথা বলা…
-“হ্যালো !!! কৌন বাত করতা হ্যায় ?”
-“তুমহারা স্বামী বাত করতা হ্যায়…”
-“ইতনা তাড়াতাড়ি অফিস সে নিকাল গিয়া ?”
-“হাঁ… কাজ-বাজ নেহি থা…”
-“ঘন্টা কাজ নেহি থা… তুম আজকাল প্রচুর কাজে ফাঁকি দেতা হ্যায়…”
এবার হেসে ফেলে সোমনাথ… সাথে সাথে মেঘাও হেসে ফেলে। আর সেই হাসির শব্দে সারাদিনের জমা হওয়া দ্বিধা, দ্বন্দ, গ্লানি সব মুছে গিয়ে এক মুহূর্তেই যেন নতুন মানুষ হয়ে ওঠে সে। কথা বলতে বলতে হাঁটতে থাকে কিছুটা রাস্তা, এইসময় হঠাৎ তার কাঁধে একটা টোকা পড়ে। পেছন ঘুরে সে একটি সম্পূর্ণ আচেনা লোককে দেখতে পায়। মাঝবয়সী লোক, শীর্ণ চেহারা। চুল পাকার বয়স হয়নি, কিন্তু জুলপি দু’টো ধপধপে সাদা চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। মুখে একটা স্মিত হাসি লেগে আছে।
-“এক মিনিট একটু কথা ছিল…”
লোকটার কথার উত্তরে মেঘাকে পরে ফোন করার আশ্বাস দিয়ে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে সোমনাথ বলল,
-“বলুন…”
-“আপনার নাম সোমনাথ সেন তো ?”
-“হ্যাঁ, কি ব্যাপার ?”
-“না… ব্যাপার মানে… আসলে কিছু না… এটা রাখুন… দরকার পড়লে আমাকে ফোন করবেন…”
-“এই বলে লোকটা একটা ভিজিটিং কার্ড এগিয়ে দেয় তার দিকে…”
সোমনাথ কার্ডটা নিয়ে দেখে, গোটা কার্ডে ঠিক তিনটে জিনিস লেখা;
ডক্টর অজিতেশ সামন্ত
৮৭৩৪২৯৮০৬৭
-“না, আপনাকে ফোন করব কেন ?”
কথাটা বলতে বলতে সামনের দিকে মুখ তুলে সে দেখল, লোকটা আর নেই। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে বেমালুম। কার্ডটা পকেটে ভরে বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটা লাগাল সে। মনটা আবার কেমন একটা হয়ে গেল। কে লোকটা ? এরকম অদ্ভূতভাবে কার্ডটা দিয়ে গেল কেন। আর সোমনাথ ওনাকে ফোন করতেই বা যাবে কেন?
বাসে উঠে বেশ কিছুটা রাস্তা চলে আসার পড়, সোমনাথের মনে পড়ল, আজ খাবার কিনে নিয়ে যাবে ভেবেছিল। সেটা ভুলে গেছে বেমালুম। বাসে বসে মেঘারও আর ফোন পেল না সে। উলটে মেসেজ এল ‘অ্যাই অ্যাম ইন অ্যা মিটিং’। বাস থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা মাঠের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে সোমনাথ। আবার কেমন মনে হয়, এই মাঠটা এখানে ছিল না তো…
আশা করি, গল্পটা যে নিছক প্রেমের নয়, সেটা একটু হলেও বোঝা যাচ্ছে; এই পোস্টের সাথে সাথে; কেউ পড়ুক বা না পড়ুক লিবারিশের ১৫০ পোস্ট সম্পূর্ণ হল; মোট ভিউয়ার সংখ্যা ৬৬৬৮, মোট ভিউ ১০,৮৯৭। এ গল্পটা কতদিন চলবে, এখনি বলতে পারছি না, কিন্তু খুব একটা বড় হবে বলে মনে হয় না। দেখা যাক। যাঁরা আমার ভিউ এবং ভিউয়ার সংখ্যা বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছেন, তাঁদের জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ। আশা করছি, আপনাদের সময়ের সদ্ব্যবহার করার মতোই লেখা আরো লিখতে পারব ভবিষ্যতে।
ধন্যবাদান্তে,
নীল…