পাঁচ – শাসন
-“তোমাকে কি আমি ব্যাপারটা বোঝাতে পারছি না, নিয়োগী ? আর এক মাসের মধ্যে আমার এই পুরো ঝামেলাটার শেষ চাই, অ্যাট এনি কস্ট…”
-“আমি বুঝতে পারছি স্যার, আমি আপ্রাণ চেষ্টা করছি…”
-“আপ্রাণ চেষ্টা করছ… তোমাকে জাদুর গায়ে হাত বোলাতে কিন্তু আমি রাতারাতি ডি সি পি করে দিইনি, নিয়োগী… রমেনের বাড়ির পুরো অ্যাকসেস তোমার কাছে। আর বাবা মেক অ্যান একজাম্পল… মারধোর কর, হাত-পা ভেঙে দাও… তোমার মেথড আমার জানার ইচ্ছাও নেই। আমার রেজাল্ট চাই…”
-“রেজাল্ট কি পাননি, এতদিন স্যার ?”
-“বাজে তক্ক কোরনা… দু’চারটে চুনোপুঁটি ধরে নিজেকে ‘আবদুল মাঝি’ প্রমাণ করার কোনো দরকার নেই।“
-“না, স্যার… তর্ক করিনি, আসলে ওদের একটা ইউনিটকে অনেকদিক ধরে ট্র্যাক করছি, প্রায় এগারো-বারো জনের একটা দল। এদের কিন্তু একদম সোজাসুজি চারুর সাথেই কথা হয়। আশা করছি আজকালের…”
রণদীপের কথায় বাধ সাধে ঘরের দরজায় একটা টোকা। দরজা ঠেলে মাথা গলায় হরিশ।
-“এক্সট্রীমলী সরি, স্যারস… আসলে ডি সি পি স্যারের একটি খো… মানে মোল রিপোর্ট করেছে, আরজেন্ট…”
রণ আবার টেবলে বসা লোকটির দিকে মুখ ফেরাতেই, তিনি ইশারায় মাথা এবং দুই হাত নেড়ে তাকে যেতে বলেন। তাকে একটা স্যালুট ঠুকে দরজা পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রণদীপ মুখ খোলে;
-“বাঞ্চোদ !!! সেন্টার ওকে হুড়কো দেবে, আর সেই হুড়কো নিয়ে ও গুঁজবে আমার গাঁড়ে…”
হরিশ হেসে ফেলে…
-“আবার তাড়া মারছিল ?”
-“তা নয়তো কি ? যত তাড়া এখন। ছাড়, কোন মাল রিপোর্ট করল ?”
-“ওই তো, সমীর মৈত্র বলে ছেলেটির বাড়ির চাকর। আজ বাজারে ছেলেটাকে দেখে মায়ের অসুস্থ হওয়ার গল্প দেয়, তাতে সে নাকি কঁদে টেদে বলে আজ বিকেলে যাবে…”
-“ফলো করে ডেরার খোঁজ নিতে পারল না ?”
-“রণদা, অত বুদ্ধি থাকলে আর আমাদের কি হত ?”
বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেলে রণদীপ গুহ নিয়োগী। তারপর বলে
-“সমীর না কি নাম ? তার বাড়িতে পোস্টিং…”
-“দু’জন আছে, রণদা… সাদা পোশাকে।”
-“গুড… বাড়ির কেউ দেখার আগেই যেন তুলে নেয়, আর সোজা রমেণের বাড়িতে গিয়ে ফেলে। আমি ওখানেই যাচ্ছি, তুই স্পটে চলে যা।”
-“ও কে…”
গট গট করে হেঁটে সোজা নিজের জীপে গিয়ে ওঠে রনদীপ। জীপ পাওয়া ইস্তক সে ড্রাইভার নেয়নি, নিজেই ড্রাইভ করে। আজ ছেলেটা ধরা পড়লে কলকাতার বুক থেক নক্সাল উচ্ছেদের পথে একটা বড় ধাপ সামনে যাওয়া যাবে। এদের ইউনিটের একটি ছেলেকে সপ্তাহ খানেক আগে ধরছিল রণ; বিশ্বনাথ বাগচি। কিন্তু প্রায় ১০ ঘন্টা অকথ্য অত্যাচারের পরও সে একটুও মুখ খোলেনি। এরকম আর কয়েকটা তেজী বাচ্চা ব্রিটিশ আমলে থাকলে, দেশটা পঞ্চাশ বছর আগেই স্বাধীন হয়ে যেত। জেরার শেষ পনেরো মিনিট ছেলেটার বুকে একের পর এক সিগারেট নেভানোর পরও যখন মুখ খুলল না, তখন একরকম বাধ্য হয়েই ক্ষমতার উৎসের সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে লাশটা শ্রদ্ধানন্দ পার্কের ধারে ফেলে এসেছিল সে।

এনকাউন্টার ব্যাপারটা মজার, মানে সেটাতে একটা শিকার আর শিকারী খেলার স্বাদ পাওয়া যায়, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়না। পেট থেকে কথা বার করতে না পারলে আর লাভ কি হল ? তাই নামের পাশে এনকাউন্টারের সংখ্যা নিয়ে ভাবে না রণ। এনকাউন্টার মানেই সার্ভিস রিভলভার ব্যবহার করতে হবে, ফাইল বানাতে হবে, অনেক হ্যাপা। ক’টা ছেলে মিসিং হল সে নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। আর কেউ থানায় ডায়েরী করতে এলে প্রথম প্রশ্ন করা হয় ‘ছেলে আপনার নক্সাল করে ?’ বাড়ির লোক না জানুক বা অস্বীকার করুক এই ডামাডোলের বাজারে ছেলে হারিয়েছে মানেই ছেলে নক্সাল করে, আশা ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে বসে থাকুন। লাশ পেলে সৎকারের ব্যবস্থা করবেন।
রমেন চৌধুরীর বাড়িটা শেয়ালদা আর বৈঠকখানার মাঝামাঝি জায়গায়। এককালের গুন্ডা, এখন সরকারী অনুগ্রহে মুচির কুকুরের মত ফুলে ফেঁপে উঠেছে। তার বিরাট বড় বাড়িতেই রণদীপের ‘ইন্টারোগেশন রুম’। তার একার নয়, সঙ্গে সহকারী প্রচুর; কিছু পুলিসের লোক, কিছু রমেনের ভাড়া করা গুন্ডা। তবে এখানে সমস্ত কাজ রণর নির্দেশমতই হয়।
বাড়ির সামনে জীপটা থামিয়ে গাড়ি থেকে নামে রণদীপ। বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে রমেন নিজে। তাকে দেখেই বলে ওঠে,
-“তোর ডানহাত ফোন করেছিল এইমাত্র। একটা ছেলেকে নাকি ধরেছে, নিয়ে আসছে…”
-“বাহ… খুব ভালো…”
কথাটা বলেই দরজা দিয়ে বাড়িটায় ঢুকে যায় রণ। একটা চওড়া উঠোন পেড়িয়ে সামনে একটা হলঘর। সেটাতে ঢুকলে একটানা গোঙানির শব্দ শোনা যায়। একটা ছেলে ন্যাতা দিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা রক্ত পরিস্কার করছে। ঘরের আবছায়ার মধ্যে ঠাহর করলে দেখা যাবে একগাদা নগ্ন লাশ… লাশ ? না ঠিক লাশ নয়, প্রায় লাশ। জীবন তাদের সরু সুতোয় ঝুলছে। কেউ কেউ হয়তো যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মরে যাবে। আর বাকিদের প্রয়োজন ফুরোলে মেরে ফেলা হবে।
ঘরটা পেরিয়ে একটা ছোট্ট ঘর, যেটা রণদীপের বসার ঘর, সেখানে গিয়ে চেয়ারে বসে, সামনের চেয়ারে পা তুলে একটা সিগারেট ধরায় সে। পেছন পেছন রমেন এসে ঢোকে।
-“যে মালটাকে ধরেছি, এ মুখ খুললেই একটা গোটা দল ধরা পড়বে…”
-“গোটা দল ? কতজন ?”
-“এই ধর এগারো-বারো…”
-“অতগুলো ছেলেকে কি এখানে এনে তুলবি নাকি ?”
এবার একটু বিরক্ত হয়ে রমেণের মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয় রণ…
-“তা নয়তো কি বাঁড়া তোর শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাব, জামাইষষ্ঠীর নেমন্তন্ন খাওয়াতে ? ঝাঁটজ্বালানো কথাগুলো বলিস কেন ?”
-“না ! এখানে আরো এগারোটা ছেলেকে আটকে রাখা সম্ভব নয়…”
-“তো বাঞ্চোদ অতগুলো ছেলেকে এখন কার গাঁড়ে ঢোকাবো আমি ?”
-“আমি জানি না… একটা ছেলে আসছে, ঠিক আছে… তার চেয়ে বেশী…”
এবার বেশ রেগে ওঠে রণদীপ;
-“শোন রমেন, এইসব বালবাজারি না, বন্ধ কর। ওদিকে তোর বাপ আমার পোঁদে লেগে আছে, শালা ডেডলাইন মারাচ্ছে… আর তুই এবার বেশী আলবাল বকলে না, শালা তোরই চামড়া ছাড়িয়ে নেব। আমাকে চিনিস না যেন…”
রণদীপ কে হাড়ে হাড়েই চেনে রমেন। ‘আমার বাড়িতে আমার কথা চলবে’ এটা খুব জোর দিয়ে বোঝাতে গিয়ে নিজের বাড়িতে দাঁড়িয়ে রণর হাতে একটা থাপ্পড় খেয়েছিল রমেন। সে কথা ভাবলে এখনো মাঝে মাঝে গালটা টনটন করে। তাই এক পা পেছিয়ে গিয়ে, একবার ঢোক গিলে একটু নরম সুরে বলে,
-“দেখ রণ, মাথা ঠান্ডা করে শোন। পুরোনো বাড়ি, মোটা দেওয়াল, সব মানছি। কিন্তু এত লোকের চিৎকার বাইরের লোক শুনতে পাবে এবার। বিরাট সমস্যা হয়ে যাবে তখন। তোরও, আমারও। তাই এই ছেলেটা আসুক। এর ডেরার সন্ধান পেলে আমি ব্যবস্থা করে দেব তোকে অন্য জায়গার।”
রণদীপে কোনো উত্তর না দিয়ে একমনে সিগারেট টানতে থাকে। রমেন ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। বেরিয়ে দেখে, হরিশ একটা ছেলেকে টেনে-হিঁচড়ে ঘরে ঢোকাচ্ছে। তাকে কোণার একটা ছোট ঘর দেখিয়ে দিয়ে নিজের ঘরের দিকে এগোয় রমেন। তার একটা জরুরী টেলিফোন করার আছে।
ছয় – একটি রাত
কৌটোটা হাতে ধরে ভালো করে দেখে একবার প্রবালের আর একবার অন্বয়ের মুখের দিকে তাকান ডক্টর দেবেশ সৎপতি। আবার কৌটোটার ভেতরের পেরেকদুটোকে ভালো করে দেখে সেটা টেবলে রেখে প্রবালের মুখের দিকে তাকান তিনি।
-“দিনে ক’টা ?”
-“কি ক’টা ?”
-“ছিলিম !? সবই তো গঞ্জিকার প্রভাবজনিত কথাবার্তা বলে মনে হচ্ছে…”
এবার প্রবাল বেশ বিরক্ত হয়ে বলে…
-“এ এ এই জন্য আমি বলেছিলাম ভাই, অন্য ডাক্তার দেখ, যাব না শালা দেবুর কাছে…”
-“তুই থাম। তুই এসে বলবি, কাশতে কাশতে তোর গলা থেকে লোহার পেরেক বেরিয়েছে, আর সেটা আমি বিশ্বাস করে নেব। কি ভাবিস আমায় বলতো ? এরপর তো কাল এসে বলবি স্বয়ং অ্যান্টমি হপকিন্স এসে তোর এক্সর্সিজম করে গেছে… নেহাত পসার জমার পর থেকে খিস্তি দেওয়া ছেড়ে দিয়েছি, নাহলে এতক্ষণে তোর বাপ-চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করে দিতাম…”
-“এই অন্বয়, ওঠ তো… শুধু শুধু সময় নষ্ট…”
-“তুই থাম… ওকে সালিশি মেনে কি হবে… বস…”
-“গলায় ব্যাথা আছে ?’
-“না, ব্যাথা যন্ত্রণা কিছু নেই…”
-“গুড… ঢোক গিলতে গেলে লাগছে ?”
-“আরে না রে বাবা ওসব কিছু হচ্ছে না…”
-“আচ্ছা; একবার হাঁ কর তো ভালো করে…”
একটা জোরালো টর্চ দিয়ে ভালো করে প্রবালের গলাটা আর মুখে ভেতরটা দেখল দেবেশ। তারপর চেয়ারে বসে বলল,
-“নাহ, কোন ইনজুরি তো দেখলাম না। ব্যাথা যন্ত্রণা যখন নেই, তখন ফালতু ফালতু এন্ডোস্কোপি করে পয়সা নষ্ট করার মানে হয় না। ক’দিন অবজার্ভ কর, আর কোন সমস্যা হলে তখন দেখা যাবে। আর যদি ফট করে মারা যাস, তো শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রনটা যেন পাই, ভাই…”
প্রবাল চোখ কপালে তোলে। অন্বয় এবার মুখ খোলে…
-“কিন্তু এটার কারণটা কি হতে পারে ?”
-“তুই সিরিয়াসলি এই প্রশ্নটা আমাকে করছিস ? একটা জ্যান্ত মানুষ কাশলে তার গলা দিয়ে কফ ওঠার কথা। তার বদলে পেরেক বেরোচ্ছে !!! এমন কথা আমি অন্তত কোনো অ্যানাটমির বইতে পরিনি, তবে হলিউডের সিনেমায় বিলক্ষণ দেখেছি। প্রবাল আজকাল ম্যাজিক ট্যাজিক প্র্যাকটিশ করছে না তো ?”
-“আরে না রে ভাই। অফিসের কাজের চাপে ঘুমের সময় পাই না, আর ম্যাজিক…”
-“যাক গে… বাড়ি যা, অফিসের কাজ কর, সস্তার গাঁজা কম খা… আর এত কমপ্লিকেটেড কেস আনিস না ভাই… সিফিলিস বা গনোরিয়া হলে বলিস, ওষুধ দিয়ে দেব। তবে এইডসটা না বাধালেই ভালো; ওটার ওষুধ জানা নেই…”
প্রবাল বিরক্ত হয়ে উঠে পড়ে।
-“চল তো… দুনিয়া রাজ্যের ভাট বকে ডাক্তার হয়েছে…”
এই বলে সে বেরিয়ে যায়, পেছনে পেছনে অন্বয়…
-“অ্যাই শালা ! আমার ফি দিয়ে যা !!!”
-“দেব না ! ভিক্ষে করে মর শালা…”
-“তোর মত রুগী দিনে দু’চারটে এলে তাই করতে হবে রে, শুয়ার…”
দেবেশের চেম্বারের বাইরে এসে দু’জনে সিগারেট ধরায়। পেরেকের ব্যাপারটা অজেয়া আর তন্দ্রিকার কাছে চেপে গিয়ে যে সুবিধাই হয়েছে, সেটা আরও একবার স্বীকার করে প্রবাল। মেয়েদুটো অলরেডী জোমাটোতে জমজমের নেগেটিভ রিভিউ দিয়ে ক্ষান্ত হয়েছে। পেরেকের কথা জানলে যে কি করত…
-“মেয়েদুটো অত রাতে প্যানিক করতে শুরু করলে খুব চাপ হয়ে যেত ভাই। একে তো বিরিয়ানীতে চুল নিয়ে নিয়ে একটা গা ঘিনঘিন করা ব্যাপার হয়েছিল।”
-“শুধু চুল না, রক্তমাখা চুল…” -ধোঁয়ার রিং ছাড়ার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে বলে অন্বয়।
-“ধুস ? আমার তো মনে হয় বিরিয়ানীর ঘি-মশলা-কেওড়ার জল এসব মিশে…”
-“বেশ, তাহলে বল, তোর মুখ থেকে পেরেক দু’টো বেরোলো কোথা থেকে…”
প্রবাল আবার চুপ করে যায়।
-“ভাই… ভূতের কাজ নাকি এগুলো ?”
-“নাও ইউ আর রিচিং…”
-“রিচিং ? কেন ? ভূত দেখিনি বলে ? তুই তো মানুষের গলা থেকে পেরেকও বেরোতে দেখিসনি… দেখেছিস ?”
সারাদিন অফিসে কাজে মন বসেনি দু’জনের। অন্বয়ই সন্ধ্যেবেলা একরকম জোর করেই দেবেশের চেম্বারে নিয়ে আসে প্রবালকে। কিন্তু দু’জনেই কি করবে কিছু ভেবে পায়নি। আসলে মানুষ কথায় বলে থাকে যে বোঝার বাইরে, বা যুক্তির বাইরে অনেক জিনিস আছে। কিন্তু যেইমাত্র কোনো অযৌক্তিক জিনিস প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়, তখনই সারাজীবন ধরে মাথায় চেপে থাকা জ্ঞানের বোঝা ‘চোখের ভুল বা মনের ভুল’ নামক যুক্তিটি খাড়া করে নিজের কাজ সমাধা হয়ে গেছে মনে করে।
সিগারেট শেষ করে দু’জনে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
সন্ধ্যেবেলা একবার স্নান না করলে তন্দ্রিকার মন ভরে না। ঘুমটারও বেশ সুবিধা হয়। অফিস থেকে ফিরে তাই শাওয়ারটা চালিয়ে সেটা হালকা ধারার নীচে দাঁড়িয়ে থাকাটাই তার জীবনের একমাত্র বিলাসিতা। সেদিনও অফিস থেকে ফিরে তাই করছিল। মাথার চুলের মধ্যে আঙুল চালাতে চালাতে হঠাৎ নিজের নখের একটা বেয়াড়া খোঁচা খেয়ে বেশ অবাক হয়েই হাতটা সামনে নিয়ে আসে। এই তো ক’দিন আগেই ম্যানিকিওর করেছে; এরকম তো হওয়ার কথা না…
বাঁ হাতটা সামনে আনতেই দেখতে পেল, তর্জনীর নখটা খুব বেয়াড়াভাবে বেঁকে রয়েছে। ধরে একটু সোজা করতে যেতেই সেটা বেমালুম উপড়ে চলে এল তার হাতে। আর কয়েক মূহুর্তের মধ্যেই আঙুলের ডগা থেকে বেরোনো রক্তের ধারায় লাল হয়ে গেল গোটা বাথরুমের মেঝে। প্রচন্ড চিৎকার করতে ইচ্ছে করল তন্দ্রিকার। কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোলো না। কোনরকমে তোয়ালে জড়িয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে সামনে অন্বয়কে দেখেই তাকে জাপটে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল সে।
-“কি হয়েছে ? আরে কাঁদছিস কেন…”
-“আমার নখ… আমার হাতের…”
-“কি হয়েছে তোর হাতের নখের ?”
-“এই দেখ…” -কাঁদতে কাদতেই হাতটা এগিয়ে দেয় তন্দ্রিকা।
-“কি হয়েছে নখে ? দিব্যি তো আছে ?”

এবার আবার নিজের বাঁ হাতের তর্জনীর দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে যায় তন্দ্রিকা। তার হাতের প্রতিটা নখই অক্ষত। অন্বয় কে ছেড়ে দিয়ে এবার আবার বাথরুমে ঢুকে যায়। আর ভেতরের দৃশ্যটা দেখে ছিটকে বেরিয়ে আসে আবার। তার পেছন পেছন অন্বয় প্রবাল আর অজেয়া বাথরুমে উঁকি দেয়। তারা দেখতে পায়, বাথরুমের মেঝেতে জল জমেছে অল্প, জলটার রঙ হালকা গোলাপি। আর জলটা জমার কারণ, ড্রেনের মুখটা ব্লক করে রেখেছে একটা নয়, অনেকগুলো নখ, আর তাল তাল চুল।
–“আমি এখানে আর থাকব না…”
কথাটা বলেই তন্দ্রা দৌড়ে তার বেডরুমে গিয়ে ঢোকে। অজেয়ার মুখটা ভয়ে সাদা হয়ে গিয়েছে, অন্বয় আর প্রবালের মুখ থেকেও কোনো কথা বেরোচ্ছে না। তখনই, ওরা শুনতে পায় পায়ের শব্দ। ছাদে পা ফেলে কে বা কারা যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে।
-“আমি এখুনি ছাদে উঠব…” এই বলে অন্বয় ঘরের দরজার দিকে এগোয়।
তাকে আটকাবার জন্য পা বাড়ায় প্রবাল। কিন্তু তার আগেই তন্দ্রা তার শোবার ঘর থেকে আর্তনাদ করে ওঠে। তিনজনে আবার সেদিকে ছোটে। ঘরে তন্দ্রা তার মাথার বালিশটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর তার বালিশের জায়গায়, বিছানার ওপর পড়ে রয়েছে, একদলা কালো চুল। ছাদে তখনো দুপদাপ করে পায়ের শব্দ।
-“প্রবাল, তুই ওদের সঙ্গে থাক, আমি ছাদের চাবি জোগাড় করে আনছি।”
এবার অন্বয় কে বাধা দেওয়ার সাহস বা শক্তিও কারোর নেই। অন্বয় লিফটের তোয়াক্কা না করেই সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে যায় নিচে। বিল্ডিংয়ের দরজার বাইরে বসে ঢুলতে থাকা দারোয়ানকে একরকম ধাক্কা দিয়েই জাগিয়ে তোলে সে।
-“ছাদের চাবি কোথায় ? দাও…”
-“ছাদের চাবি তো আমার কাছে নেই, স্যার… সকালে যে ডিউটি করে, সে ভুল করে নিয়ে চলে গেছে…”
-“তাকে আজকেই নিয়ে যেতে হল ?”
ছাদের চাবি না পেয়ে আবার ঘরে ফিরে আসে অন্বয়। ঘরের পরিবেশ অত্যন্ত থমথমে। তন্দ্রিকা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। অজেয়ার অবস্থাও তথৈবচ। প্রবাল দুজনকে সাহস বা সান্ত্বনা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। অন্বয় ঘরে ঢুকতেই তন্দ্রিকা প্রায় চিৎকার করে ওঠে।
-“আমি এখানে আর একমূহুর্ত থাকব না… একমুহূর্ত না…”
-“কাম ডাউন… এত রাতে কোথায় যাব…”
-“আমি জানতে চাই না, দরকার হলে ওয়ো বুক কর…”
-“তন্দ্রা, প্লিজ মাথা ঠান্ডা করে আমার কথাটা শোন। আজকের রাতটা কাটাই। কাল সকাল হলে ভাবব… কাউকে একা থাকতে হবে না, আমাদের ঘরের খাটটা বড়, ওখানেই চারজনে শোবো আজকে… চোখ মোছ… প্লিজ…”
তন্দ্রা কোনো কথা না বলে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মুছে ফেলে। ছাদে পায়ের শব্দ তখন আর নেই।
-“ছাদের চাবি পেলি না ?” -প্রশ্ন করে প্রবাল।
-“না, সকালের গার্ড নিয়ে চলে গেছে। কাল দেখা যাবে…”
তারপর চারজনে একই ঘরের খাটে গিয়ে শোয়ার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু সে রাতে আলো নেভাতে কেউই রাজি হয় না। একটা ছোট আলো জ্বেলে, খাটে শুয়ে থাকতে থাকতে চোখ বুজতেও ভয় করে সবার। কিন্তু রাতের নিশ্তব্ধতা আর সারাদিনের ক্লান্তি একটু একটু করে চোখের পাতাগুলোকে ভারী করে তোলে। আর একটা খাটে গাদাগাদি করেই ঘুম আসে সকলের।
আগামী পর্বে শেষ হয়ে যাচ্ছে ‘স্তুপ’। নক্সাল আমলের সাথে সত্যিই এই কাহিনীর কোনও যোগাযোগ ছিল কিনা সেটা শেষ পর্বের উপসংহারেই লিখব। তাই আর একটা সপ্তাহের অপেক্ষা। গল্প শেষ হোক, জানান কেমন লাগছে, আর এরপর কি হবে, সেটা না হয় পরেই ভাবা যাবে।