শীতে জমে গেছি, টাইপ করতে পারছি না, গোছের কিছু লেখা যায়। তার ওপর যখন গত সপ্তাহে ভেবে রাখা দু-দুটো লেখার একটাও শেষ করতে পারলাম না, তখন এ সপ্তাহেও লেখা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু, কপাল ভালো হাবিজাবি লেখা আমার জমে থাকে সবসময়ই। আজও তারই একটা ছেড়ে দিলুম। ভূতের গপ্পো নয় ঠিকই, কিন্তু এই শীতে গায়ে একটু শিরশির ভাব, লেপটা আর একটু আঁকড়ে ধরে থাকার ইচ্ছে জাগানো একটা লেখা আরকি। পড়ে দেখুন, আশাকরি ভালো লাগবে।

বাড়ির দরজার ঠিক উল্টোদিকে, দূর্বোধ্য ভাষায় লেখা বিজ্ঞাপনটাকে দেখে, বেশ অবাক হয়ে গেল অমরেশ। সেই একই, মাথার মহাগুনসম্পন্ন তেলের বিজ্ঞাপন। কিন্তু ভাষাটা বোঝা যাচ্ছে না, কন্নড় বা তামিল হবে হয়ত। আশ্চর্য্য! সকালে অফিস বেরোনোর সময় অবধি তো বিজ্ঞাপনটা বাংলাতেই লেখা ছিল। মাত্র ৮ ঘন্টায় এরকম আমূল পরিবর্তন? যাই হোক, ঠোঁটে একটা কটাক্ষের হাসি চলে আসে আপনাআপনি, আর বিড়বিড় করে “বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক” কথাটা বলে, চাবিটাকে তালার গর্তে ধুকিয়ে, ডানদিকে মৃদু একটা মোচড় দিল। তাতে চাবিটা ঘুরল না দেখে, বেশ অবাক হয়ে গেল অমরেশ। প্রায় নতুন ইয়েল-লক, কদিন আগেই অয়েলিং ও করা হয়েছে, তার মধ্যেই এই? এবার মোচড়টা একটু জোরেই দেয় অমরেশ। কি বিপদ! দরজা বা তালার কোনো হেলদোল নেই! এবার বেশ জোরে দুবার মোচড় দিতে গিয়ে, একবার ভুল করে, বাঁদিকে মোচড় পড়ে যায়। অমনি, ‘কট’ শব্দে খুলে যায় তালা, আর মৃদু ঠেলা দিতেই, ক্যাঁচ শব্দে খুলে যায় জানদিকের পাল্লা। বেশ অসন্তুষ্ট ও অবাক হয় অমরেশ। এ আবার কি? খোলার তো কথা বাঁদিকের পাল্লাটা। ডানদিকের টা তো ছিটকিনি দিয়ে আটকানো। ভেতরে ঢুকে দরজাটা টেনে বন্ধ করে বেশ অবাক হয় অমরেশ। নাহ! বাঁদিকের পাল্লাটাতো ছিটকিনি দিয়ে আটকানো। ডানদিকের টা তো নয়! তাহলে নিশ্চয় মিনু, মানে মৃণালিনী, বেরোনোর আগে ভুল করে উল্টোদিকের পাল্লায় ছিটকিনি দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ইয়েল লকটাই বা সমস্যা করছে কেন? উল্টো মোচড়ে খুলছে, দরজাও উল্টো করে লাগানো। কে জানে! তারপরই, সমরেশ এর মনে হয়, কে জানে! হয়তো দরজাটা ওইরকমই। তার নীজের যা ভুলো মন!
দোতলায় নীজের ঘরে ঢুকে, কাঁধের ব্যাগটাকে খাটে ফেলে, হাতঘড়িটাকে রাখার জন্য, টেবলের ডানদিকের ড্রয়ারটা খুলে এবার বেশ বিরক্তই হল অমরেশ। ড্রয়ারে যত জঞ্জাল আর যন্ত্রপাতি। এটাতো বাঁদিকের ড্রয়ারটা! এ কাজ অবধারিত টিঙ্কুর। সে প্রায়শই ডানদিকের ড্রয়ারটা খুলে বাঁদিকে লাগিয়ে দেয় বাবার সাথে মজা করার জন্য। অমরেশ ড্রয়ার দুটোকে আবার অদল বদল করে দেয়। তারপর বাঁ হাত দিয়ে বুক পকেট থেকে পেনটা বের করতে গিয়ে, আবার ধাক্কা খেল সে। তার বুকের বাঁদিকে কোনও পকেটই নেই! পেন সমেত পকেটটা কি করে তার বুকের ডানদিকে গেল, সেটা ভেবে, অবাক হওয়ার সাথে সাথে এই প্রথম, অমরেশের শিড়দাঁড়ায় একটা হালকা সুড়সুড়ি খেলা করে যায়। সে, একটু যেন ভয় পায়। ডানপকেট থেকে পেনটা বের করার সময় হাতটা একটু যেন কেঁপে ওঠে। কিন্তু বিজ্ঞানের ছাত্র অমরেশ, নীজেই নীজের মনকে ধমক দেয়। হতেই পারে এই শার্টটার পকেট ডানদিকে! তার তো ওরকম দু’একটা শার্ট আছে। হয়তো ভুল করে সেরকম শার্টই পড়ে গেছে অফিসে। আবার, মনের মধ্যে কে যেন বলে ওঠে, আজ বড্ড বেশীই ভুল হচ্ছে তার। ড্রয়ারটা বন্ধ করে, মুখটা সোজা তুলে, এবার যা দেখল অমরেশ, তাতে তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল এক সেকেন্ডে। সামনের দেয়ালে ঝোলানো ছিল তার বাবা-মায়ের ছবি। মানে আজ সকাল অবধি ছিল, কিন্তু এখন আর নেই। শুধু তাই নয়, দেয়ালে ছবি ঝোলানোর পেরেকের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। বিদ্যুতবেগে উল্টোদিকে ঘুরে সে দেখল, তার মা বাবার ছবি, আচমকাই দেয়াল বদল করে নিয়েছে। আর, ছবিতে মা আর বাবাও বদল করেছে নীজের জায়গা। মা বরাবরের মত বাঁদিক ছেড়ে বাবার ডানদিকে। অমরেশ দুচোখ কচলে নেই একবার, হাতে চিমটিও কাটে। ব্যাথায় হাতটা সাড়া দিলেও, চোখের দৃশ্য বদল হয় না। নীজের হৃদপিন্ডের শব্দ শুনতে পাচ্ছে অমরেশ। হৃদপিন্ড! তাই তো! বুকে হাত দিয়ে, একটু হলেও আশ্বস্ত হয় অমরেশ। হৃদপিন্ডটা বুকের বাঁদিকেই আছে, আর সেটা প্রাণপনে চেষ্টা করছে, রক্তপ্রবাহ বাড়িয়ে, কর্তার মাথা ঠান্ডা করতে। অমরেশ স্থবিরের মত দাঁড়িয়ে আছে ঘরে মাঝখানে। হাত পা কাঁপছে অল্প অল্প। ঘরের আলোটা যেন সড়ে গেল একদিক থেকে অন্যদিকে। অমরেশ বুঝতে পারল, ঘরের জানলাটাও দেয়াল বদল করে ফেলেছে। সবকিছু যেন অসহ্য হয়ে উঠেছে! অমরেশ যেন একটা অদ্ভূত স্বপ্নের মধ্যে আটকা পড়েছে, যেখান থেকে হাজার চেষ্টা করেও বেরোনো সম্ভব হচ্ছে না। অমরেশ দৌড়ে বাথরুমে গেল। বেসিনটা যথারীতি ডানদিকের বদলে বাঁদিকে, আর বেসিনে রাখা সাবানটাও ঠাঁই বদল করেছে। কলটা খুলতে গিয়ে নাজেহাল হয়ে, অমরেশের মনে পড়ল, ডানদিকে নয়, বাঁদিকে ঘোরালে কলটা খুলবে। মুখে ছপ ছপ করে জল দেওয়ার পড়, আবার নীজের ঘরে ফিরে আসে অমরেশ। নাহ! মুখে মগ মগ জল দেওয়ার পড়েও, সে এখনো সেই দুঃস্বপ্নের জগতেই বাস করছে। অমরেশ এবার মরিয়া হয়ে ওঠে। সে সবকিছু আবার আগের মত করে ছাড়বে। বাঁদিকের ড্রয়ার টা খোলে হাতুড়ি বের করবে বলে। কিন্তু সে দেখল, ড্রয়ার দুটো আবার জায়গা বদল করেছে। রাগে দুটো ড্রয়ারই খুলে, মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিল অমরেশ। জিনিসপত্র সব মাটিতে ছড়িয়ে যায়। তারপর দেয়ালে একটা পেরেক পুঁততে শুরু করে সে। আর উল্টোদিকে দেয়াল থেকে বাবা মায়ের ছবিটা খুলে, আবার ঘুরতেই দেখে দেয়ালে সদ্য পোঁতা পেরেকের চিহ্নমাত্র নেই। আবার উল্টোদিকে ঘুরে দেখে, তার বাবা মায়ের ছবি দেয়ালে ফিরে গেছে, আর সে খালি হাতে দাঁড়িয়ে। অমরেশ আবার ছবিটা খুলে নেয়, কিন্তু উল্টোদিকে দেয়ালে পৌছোনোর আগেই, সেটা বার বার অদৃশ্য হয় তার হাত থেকে, আর ‘নীজের’ জায়গায় ফিরে যায়। অমরশের আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছে করে। সে উন্মাদের মত গোটা ঘরের জিনিসপত্র তচনছ করতে শুরু করে। ইচ্ছে করে এই দুনিয়ে ছেড়ে পালাতে। এমন সময় বাইরের দরজার লক খোলার, এবং তারপর দরজা খোলার শব্দ হয়। একটি পরিচিত নারীকন্ঠ বলে ওঠে,
-“তুমি কি ফিরেছ?”
গলাটা, অমরেশের স্ত্রী মৃণালিনীর। সে আবার বলে ওঠে,
-“টিঙ্কু কে আনতে গেছিলাম।”
অমরেশের তখন বাহ্যজ্ঞান নেই। ওরা কারা ? কারা পায়ে পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আসছে? মিনু আর টিঙ্কু? নাকি তাদের প্রতিবিম্ব? গোটা পৃথিবীটাই কি তাহলে আজ প্রতিবিম্ব? একমাত্র সে ছাড়া? আবার নীজের বুকে হাত রাখে অমরেশ। নাহ! হৃদপিন্ডটা এখনো বাঁদিকেই আছে।
-“একী! এ কি অবস্থা তোমার ঘরের?” – ঘরে দরজায় দাঁড়ানো মৃণালিনী প্রশ্ন করে।
অমরেশ মুখ তুলে তাকালো। আর দেখল, মৃণালিনীর বাঁ গালের তিলটা এখন ডানগালে। অমরেশ থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে প্রায় ফুঁপিয়ে উঠল। মৃণালিনী ঘরে ঢুকতে ঢুকতে আরো অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,
-“কি হয়েছে তোমার ?”
অমরেশ এক লাফে উঠে, মৃণালিনী আর টিঙ্কু কে টপকে দুড়দাড় শব্দে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামল। পেছন থেকে শুনতে পেল,
-“কোথায় যাচ্ছ? কথা শোনো। কি হল?”
দরজা খুলে রাস্তায় বেরোতেই আর একটা জিনিস বুঝতে পারল অমরেশ। রাস্তার সাইনবোর্ডের লেখাটা বাংলায়। মানে বাংলা লেখা আয়নায় দেখলে যেরকম হয়, ঠিক সেরকম। রাস্তায় গাড়ি বাঁদিকের বদলে ডানদিকে দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু অমরেশ কোনো কথা না ভেবে, কোনো কিচ্ছু না দেখে দৌড়োতে শুরু করল। কিসের থেকে পালাচ্ছে, কেন পালাচ্ছে, সে নিজেই জানে না। কিন্তু থামতে সে পারছে না।, কারণ তাহলেই চোখে পড়বে, আরো কত কি জিনিস, নীজের প্রতিবিম্ব হয়ে গেছে। কতক্ষণ বা কতটা ছুটেছিল জানে না অমরেশ, হঠাৎ বিরাট কিছু সাথে ধাক্কা লেগে সে ছিটকে পড়ল, আর তারপর তার আর কিছু মনে নেই।
যখন জ্ঞান ফিরল, তখন সারা গায়ে, হাতে, পায়ে, মাথায় ব্যান্ডেজ করে হাসপাতালের বেড এ শুয়ে আছে সে। শিয়রের কাছে বসে মৃণালিনী। আর তিলটা? না, বাঁ গালেই। জীবনে এত খুশি আর আস্বস্ত বোধহয় আর কোনোদিনও হয়নি অমরেশ।
-“তোমার কি হয়েছিল কি বলতো?”
মৃণালিনী উদ্বেগ এবং ধমকের সুরে প্রশ্ন করে। মৃদু হেসে, অমরেশ উত্তর দেয়,
-“আজ ক্যান্টিনের খাবার খেয়ে গ্যাস হয়ে গেছিল বোধহয়। আবোল তাবোল জিনিসপত্র দেখছিলাম।”
মৃণালিনী আর কথা বারাবার আগেই, রাউন্ড আপে বেরোনো ডাক্তারবাবু সমরেশ এর কেবিনে হাজির হন। তিনি বেশ হাসি হাসি মুখ করে বলে ওঠেন,
-“এই তো ! Welcome Back to the land of the living! কি বিপদটাই বাধিয়েছিলেন বলুন তো? আপনার হয়েছিল কি ?”
অমরেশ আশ্বস্তির সুরে বলল,
-“কিছু না! আসলে গ্যাস মত হয়ে গিয়ে হ্যালুসিনেট করছিলাম বলে মনে হচ্ছে।”
-“That better be! আপনার CT বা MRI তে তো কোনো দোষ পেলাম না, Apart from the mild concussion. এরকম সমস্যা persist করলে, I’d recommend a psychiatrist.”
-“I don’t think that would be necessary! মানে আমার ফ্যামিলি তে তো কোনো মেন্টাল ইলনেস এর হিস্ট্রি নেই!’
-“Ya, right, talking about medical history, আগে কিরকম ডাক্তার দেখাতেন মশাই! অত বড় মেডিকাল হিস্ট্রি দিয়েছে, But he failed to Mention an important thing!”
-“কি জিনিস? কি Important thing?”
-“আপনার Desxtrocardia আছে! মানে অন্যান্য লোকের মত, আপনার হার্ট, আপনার পাঁজরের বাঁদিকে নয়, ডানদিকে।”
আবার, মতামত জানার অপেক্ষায় রইলাম। কমেন্ট, ফেসবুক বা ই-মেইল এ…
শান্তির আশায়…
নীল…
বাহ্… ভালো…
LikeLike