১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট। কি হয়েছিল, সবাই জানে; আর তার আগের ঘটনা তো অনেক বেশী করেই জানে, নেতাজী, বাঘাযতীন, মাস্টারদা সূর্য্য সেন… দেশের জন্য প্রাণ বলিদান করা সেইসব মানুষদের কথা, আমরা বহুবার শুনেছি, পড়েছি, দেখছি (রূপোলি পর্দায়)। এখন কথা হল, ব্রিটিশরা দেশ ছাড়ার পড়, ১৯৫০-এ সংবিধান প্রতিষ্ঠার পর, দেশের প্রকৃত আইন-কানুন হল, রাষ্ট্র স্বীকৃত পতাকা, সংগীত, গান, সবই হল, এবং বলা হল, রাষ্ট্রের প্রতিক হিসাবে এগুলির মর্যাদা করা জরুরী। আরো অনেক গুলো কথা বলা হল, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’, ‘সার্বভৌম্য’ রাষ্ট্রের কথা, চোখবাঁধা আইনের দেবীর দাঁড়িপাল্লার কথা। যেখানে নিক্তি ওজনে সাক্ষ্যপ্রমাণ ওজন করে শাস্তিবিধান করা হয়।
এই সংবিধানই বলে, অপরাধী, ‘ইনোসেন্ট, আনটিল প্রুভেন গিল্টি’। এবং সে যত জঘন্য অপরাধেই অভিযুক্ত হোক না কেন, সংবিধান তাকে আইনি সেবা প্রদান করার অঙ্গীকার করে। তাই মানবতার নিক্তি ওজন যাই বলুক না কেন, কোনো আইনজীবিই যদি কোনো এক অপরাধীকে আইনি সেবা দিতে অগ্রাহ্য করে, তাহলে সেটা হয়তো মানবিকতার খাতিরে ঠিক, কিন্তু সংবিধান অবমাননা নয় কি ? যাক গে যাক, ওসব কথা থাক। আবার ফিরে আসি সেই মোটা বইটার কথাতেই।
সংবিধান লেখা হয়েছিল, বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য আনার চেষ্টায়। গোটা দেশবাসীর যেখানে ভাষা, ধর্ম, আচার, ব্যবহার সবই আলাদা, তখন তাদের একত্রিত করার একমাত্র সুতো ছিল ওই কন্সটিউশান।

এখন পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা আমাদের এই স্বাধীনতা, আমাদের কারোর কারোর দাদু ঠাকুরদা হয়তো আনতে সাহায্য করেছেন, আমার দেশে আমি বাস করি, যতদূর জানি, ভালোবাসা, মানে সেটা দেশের প্রতিই হোক, বা অন্য কারোর প্রতি, সেটা কিভাবে প্রকাশ করব সেটাও আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এখন আমি তো আর ভালোবেসে দেশকে বারবিকিউ নেশনে বুফে খাওয়াতে নিয়ে যেতে পারি না, বা জন্মদিন (মানে স্বাধীনতা দিবসে) শরদিন্দুর বইও উপহার দিতে পারি না। তা তবুও, দেশের প্রতি ভালোবাসা ব্যক্ত করার অনেক উপায়ই আছে, কিন্তু, ওই যে বললাম, সেটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার।
এবার, আমাদের সংবিধান একটি মন্ত্রীসভার দাবী জানায়। এখন আমাদের কপাল হল, আমাদেরই আঙুলের চাপে, যারা সেই মন্ত্রীসভার গদিতে বসে দু’বেলা পাদছেন, তার এমনই মাল, যে আজ ব্রিটিশ আমল হলে, গোটা ইংরেজ সরকারের জুতো ওনারা জিভ দিয়েই চেটে পরিস্কার করে দিতেন। কিন্ত ‘কোথা অযোধ্যা, কোথা সেই রাম ?’ কিন্তু, এ হেন লোকেদের মনে প্রশ্নই উঠতে পারে,
“আমি কি সত্যিই দেশকে ভালোবাসী ?”
এখন, বদ লোকেদের একটা অদ্ভূত বৈশিষ্ট্য আছে, জানেন ? তারা নিজেদের মনে ওঠা প্রশ্নগুলিকে সবসময় অন্যের ওপরে নিক্ষেপ করে নিজের অক্ষমতাটাকে চাপা দিতে চায়। তাই এখানেই ব্যাপার হল তাই। এই লম্বা জীভধারী ব্যক্তিবৃন্দ, প্রশ্নটা নিক্ষেপ করলেন, আমার আপনার ওপর। প্রশ্ন উঠল,
“আপনি কি সত্যিই দেশকে ভালোবাসেন ?”
যখন আপনি-আমি উত্তর দিলাম ‘হ্যাঁ’ তখনই পালটা দাবী এল,
“প্রমাণ করুন”
কিভাবে ?
“আপনি নিজের ট্যাঁকের পয়সা খরচ করে, নিজের হাল্কা চালে গা এলিয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে যখনই ছায়াছবি দেখতে যাবেন, আমি আপনার সামনে ‘ন্যাশানাল অ্যান্থেম’ চালিয়ে দেব, আর স্ক্রীনে লিখে দেব ‘প্লিজ রাইজ’ আর আপনাকে গদি থেকে পোঁদ তুলে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে প্রমাণ করতে হবে, আপনি একজন সাচ্চা দেশপ্রেমিক, আমার মত নকলি নন…”
বিশ্বাস করুন, ১৫ই আগস্ট ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে যখন স্কুলের প্রেয়ার লাইনে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে সবার সাথে যখন জন গন মন তে গলা মেলাতাম না, গায়ে কাঁটা দিত। চোখের সামনে এক এক করে ভেসে উঠত নেতাজি, ভগত সিং, বাঘাযতীনের মুখগুলো। রাস্তায় কোথাও সুরটা শুনতে পেলে সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে পড়তুম।
কিন্তু শেষ কয়েক বছরে এর পরিবর্তন ঘটেছে। যখন একটা সিনেমা হলে ঢুকে, সিনেমা শুরুর আগে প্রেমিকার সাথে ঝগড়া করছি, হাফটাইমে ক্যারামেল পপকর্ণ কিনব, না সল্টেড, বেজে উঠল সেই অতি পরিচিত সুর। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াতে হবে, আর সত্যি বলছি, গায়ে একটুও কাঁটা দেয় না, উলটে মনে হয় ‘দুশশালা… কখন যে শেষ হবে’।
কিন্তু না দাঁড়ালেও বিপদ। কারণ হলের বাকী লোকেরা গনপিটুনিটা যে অসংবিধানিক সেটা জানেন না, কিন্তু জাতীয় সঙ্গীতের ‘অসম্মান (?)’ যে অসংবিধানিক, সেটা বিলক্ষণ যানেন। তাঁরা যদি মনে করেন, পিটিয়ে আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে দেশপ্রেম ঢোকাবেন, তাহলে আমার কিছুই করার থাকবে না।
এ প্রসঙ্গে সাইমন এবং গারফাঙ্কেলের একটা গানের একটা লাইন মনে পড়ছে। গানের নাম, ‘The Boxer’, এবং লাইনটি হল
“…Still a man hears what he wants to hear And disregards the rest…”
তা সংবিধান হল এমন একটা মজার বই, যেটা আসলে এক লাইন জেনে, পরের লাইনটা না পড়লে, সেটা মারাত্মক। তাই আমরা সমানাধিকারের কথা শিখিনি, আমরা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা শিখিনি, আমরা শিখেছি, জাতীয় সঙ্গীত বাজলে দাঁড়াতে হয়, যে দাঁড়াবে না, তাকে পিটিয়ে পাঁপড় করে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দাও…
তাই অন্যের কথায় আমার দেশপ্রেম প্রমাণের চক্করে ‘পাঞ্জাব-সিন্ধু-গুজরাট-মারাঠা-দ্রাবিড়-উৎকল-বঙ্গ’ “খেলো” হয়ে গেল। জাতীয় সঙ্গীত ‘নির্যাতিত সঙ্গীত’ হয়ে গেল।
ক্ষী জ্বালা !!!
শান্তির আশায়,
নীল…