“ও আলোর পথযাত্রী, এ যে রাত্রী এখানে থেমোনা
সলিল চৌধুরী
এ বালুচরে আশার তরণী তোমার যেন বেঁধোনা…”
আচ্ছা, আপনার কি মনে হয়, আপনি এই মূহুর্তে এশিয়ার বৃহত্তম গনতান্ত্রিক, সার্বভৌম, স্বাধীন, সমাজতান্ত্রিক দেশে বসবাস করছন ? তাহলে প্লিজ, আর পড়বেন না। কারণ এরপর আর এগোলে আপনার গাত্রদাহ শুরু হবে, আর আপনি অচিরেই আমাকে খিস্তি করে দেশদ্রোহী মার্কা লাগিয়ে দেবেন। তাই বলছি, মানে মানে কেটে পড়ুন।
…
…
যাননি ? আছেন এখনো ? বেশ… তাহলে শুনুন।
আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন টিভিতে একটা কার্টুন দেখতে খুবই ভালোবাসতাম। ডিজনীর ‘ডাক টেইলস’। তো গত বছর, সেই ডাক টেইলস-এর পূনঃসূচনা করা হয়েছে, এবং আংকেল স্ক্রুজের কন্ঠদান করেছেন ডেভিড টেনান্ট স্বয়ং। তা এ হেন সিরিজের রিবুট আমি মিস করব, এত বড় পাষন্ডও আমি হয়ে যাইনি। তা কাল যখন সেটা খুলে দেখতে বসেছি। একটা জিনিস দেখে বেদম মাথা গরম হয়ে গেল। যারা ‘ডাক টেইলস’ আগে দেখেছেন, তারা ‘ওয়েবিগেল’ কে খুব ভালো করেই চেনেন। তা এইখানে ওয়েবিগেল-এর মুখে একটা ডায়ালগ আছে;
I’m going to eat a Hamburger…
বললে বিশ্বাস করবেন না, কে বা কারা ‘Ham’ শব্দটাকে ব্লিপ করে দিয়েছে! মানে দশচক্রে ভগবান ভূত হয়, আর এই কুলোপানা চক্করে হ্যাম খিস্তি হয়ে গেল। মানে, কেন ? কারণ হ্যাম কথাটা কি দোষ করল ?
আমি বলছি কি দোষ করল। ধরুন আপনার খুকি বা খোকা, হ্যামবার্গার কথাটা শুনে সেটা খাওয়ার বায়না ধরল। এবার আপনি তাকে গোমাংশ ভক্ষণ করাবেন না করাবেন না, সেটা একান্তই আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার হওয়া উচিত, তাই না ? কিন্তু এখানে কি হল ? সেই সিদ্ধান্তটা আপনার হয়ে অন্য কেউ নিয়ে নিল।

আপনি ভাবলেন, তাতে কি আর এল গেল… একটা কার্টুনের একটা ডায়ালগে একটা শব্দ যদি বাদই পড়ল, তাহলে কি আর এল গেল ?
নিশ্চয়ই। কিছুই যাওয়া আসার কথা নয়। কিন্তু তারপর কি হল বলুন তো ? সদ্য মুক্তি পাওয়া ‘ফোর্ড ভার্সাস ফেরারী’ ছবিতে যত মদের গ্লাস ছিল সব ব্লার করে দেওয়া হল। কেন ? সিনেমাটিতো ঠিক ‘চিল্ড্রেন্স ফিল্ম’ বলে আখ্যা পেয়েছে বলে আমার জানা নেই। আর যারা সেই সিনেমা দেখতে যাচ্ছে, তাদের মাথায় এইটুকু বুদ্ধি আছে আমি আশা করি, যে লোকে ডিনার করতে করবে কপিল মুনীর ভাঙের শরবত বা প্যারামাউন্টের ডাব মালাই খাবে না।

এর অন্য মানে বের করবেন না; আমি মদ্যপান করি না, কারোর মদ্যপান করা সমর্থনও করি না। মানে, আমি মনে করি মদ খেলে লিভার খারাপ হয়, চরিত্র না। কিন্তু তা বলে কেউ মদ খেলে রাম নাম করে চোখ বুজি না, বা তার নামে খাপ পঞ্চায়েত ও বসাই না। আমি মনে করি, যে যার পয়সায়, স্বেচ্ছায় যা খাচ্ছে, খাক… আমার পরিচিত কেউ খেলে, আমি বারণ করব, বুঝিয়ে বলব। সে আসক্ত হয়ে গেলে দরকার হলে নেশামুক্তি কেন্দ্রেও নিয়ে যাব। কিন্তু গোটা দেশের কোটি কোটি লোক মদ্যপান করল কি করল না, সেটার নির্ধারণ করার আমি কেউ না, যে একদল অশিক্ষিত, মূর্খ, গাধার দল পার্লামেন্টে বসে দেশ চালানোর নামে সাট্টা খেলছে, তারা তো নিশ্চিতভাবে না।
নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রন আইন লাগু হয় ১৮৭৬ সালে। গ্রেট ন্যাশানাল থিয়েটারের অনেক নাটককে ‘অশ্লীল’ এবং ‘দেশদ্রোহী’ ঘোষণা করে গিরিশ ঘোষ সহ অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়। হিটলারের কথায় যাচ্ছি না, এই ঘটনা ঘটেছিল খোদ আমাদের শহরে। নাটকের ভয়ে ব্রিটিশ সরকার কলাকুশলীদের মুখ বন্ধ করতে চায়।
এটা যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে, মানে কেউ মুখ খুললেই আগে মুখ বন্ধ কর। মারধর কর। হোস্টেলের ফি বাড়ানোর প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণ মিছিল, তার ওপর আলো নিভিয়ে লাঠি চালাও। নকল ভিডিও তৈরী করে ছাত্রনেতাকে জেলে ভরো, তার বক্তব্যের সততার ওপর প্রশ্ন তোলো। কিন্তু ব্যাপার হল, আমরা এখন যে ‘জেনারেশন’-এর ছেলেপুলে, আমরা ইন্টারেনেট স্পীড কম হলে সোশ্যাল মিডিয়ায় হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ড করিয়ে দিই, তো বার বার আমাদের ‘চুপ কর’ ‘চুপ কর’ বলে শাসন করা যাবে বলে কার মনে হয় ? মুখ বন্ধ করা যদি অতই সহজ হত, তাহলে তো আজও ভারত ইংল্যান্ডের কলোনীই হয়ে থাকত, তাই না ?

দেশের যাবতীয় দূর্দশার হাল যুবসমাজের ঘাড়ে চাপিয়ে, হাত ধুয়ে ফেলা ব্যাপারটাও আজকের নয়। যুগে যুগে হয়ে এসেছে। চুল না পাকলে কথার ওজন বাড়ে না, কথায় আমল দেয় না কেউ। আজও তাই হচ্ছে, স্বয়ং অর্থমন্ত্রী যখন প্রেস কনফারেন্স ডেকে বলতে পারেন, অটোমোবাইল সেক্টরে মন্দা এসেছে যুবসমাজের জন্য; তখন বুঝতেই হবে যে অন্য সব অজুহাত ফুরিয়ে গেছে। যুবসমাজ নাকি ভেপিং বা ইলেক্ট্রনিক সিগারেটের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে ধূমপায়ী হয়ে পড়ছে; তাই ভেপিং মেশিন বা ই-সিগারেট ব্যান হল। কেন ‘যূবসমাজ’ কি পনেরো টাকা দিয়ে গোল্ডফ্লেক কিনে খেতে পারে না ? সেটা তো যতদুর জানি ভেপিং মেশিনের থেকে সস্তা ! কিন্তু না… সরকারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুললেই ‘দেশদ্রোহী’, ‘আর্বান নক্সাল’ ইত্যাদি ডিগ্রী গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে; আর আজ তো শুনলাম হোম মিনিস্টার নাকি সি আর পি এফ কে আর্বান নক্সাল দমনের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তা একটু ভেবে দেখুন, এই আর্বান নক্সাল কে বা কারা হবে ?
এই, আমি… বা আমার মতো ছেলেমেয়েরা, যারা চুপ থাকতে পারে না, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে গেলে যাদের গায়ে লাগে, ভারত পেট্রোলিয়াম বিক্রী হয়ে গেলে যারা সরকারের অপদার্থতার দিকে আঙুল তোলে। পতনশীল জিডিপি-এর জন্য যারা সরকারী নীতির সমালোচনা করে। কাল যে একজন জওয়ান এসে আমার পশ্চাতদেশে বেয়োনেট ঢুকিয়ে দেবে না, তার কি নিশ্চয়তা আছে ?
এবার আসি শেষ কথায়। প্রায় ২০১৫ সাল থেকে ইউটিউবে কদর্যভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে চলেছে শ্রী রোদ্দুর রায়। মাঝে মাঝে তাঁর দু-একটা গান চর্চায় আশে। এবং তার মধ্যে হালে যেটা এসেছে, সেটা হয় ‘সেদিন দু’জনে দুলেছিনু বনে’। গানটির ভিডিওতে তিনি গেয়েছেন
‘শালা চাঁদ উঠেছিল গগনে, বাঁড়া চাঁদ উঠেছিল গগনে, বাঞ্চোদ চাঁদ উঠেছিল গগনে…’
এখন প্রচুর লোকের গোপনাঙ্গের কেশ-এ যাকে বলে ‘স্পন্টেনিয়াশ কমবাশান’ শুরু হয়ে গেছে এই গান শুনে। কেউ বলছেন রাস্তায় ফেলে পেটাও কেউ বলছে গায়ে ল্যাংটো বাংলা পক্ষ ছেড়ে দাও। আর কেউ ‘ধুর ও পাগল’ বলে হেসে উড়িয়ে দিচ্ছে।
এখন কথা হল, রবীন্দ্রনাথের কপিরাইট যখন নেই, তখন এত গায়ে লাগছে কেন ? জানি উত্তরগুলো, ‘উনি বিশ্বকবি’, ‘উনি বাঙালির ইমোশান’, ইত্যাদি ইত্যাদি… তা দাদা/দিদিরা, রবীন্দ্রনাথের গানের যখন আপনারা এতবড়ই বোদ্ধা, তাহলে যখন নচিকেতা-অঞ্জন দত্ত ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’ গানটাকে দাদরার বদলে কাহারবা তালে গাইলেন তখন আপনাদের গা কি জ্বলনাঙ্কে পৌছোয় নি ? যখন লোকে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে আরো হাজারগন্ডা ছ্যাঁচড়ামো করেছে, তখন কি হয়েছিল আপনাদের ? না কেন, ওরা দু’টো খিস্তি ঢুকিয়ে দেয়নি বলে ? মানে খিস্তিটাই মূল, তাইতো ? ওসব অবমাননা, ইমোশন ওগুলো শুধু কথার কথা ?

তা এবার আমি একটা খিস্তি খাওয়ার মত কথা বলি ? বলছি, দাদা/দিদি, আর কতদিন ? শুধু সংস্কৃতির নামে অতীত আঁকড়ে ধরে থাকলে কি লাভ হবে ? আমি সিনেমার কথা আগেও বলেছি। গানের রিমিক্স, রিমেক করে, বাংলা গানে খুচরো এবং পাইকারি দরে অন্য শব্দ ঢুকিয়ে, আর ২৫শে বৈশাখে কবিগুরুর ছবিতে মালা দিয়ে এখনো গোটা ভারতীয় সংস্কৃতির পৃষ্ঠদেশে পোষকতা করছি, বললে হবে ?
ভাবুন, দাদা/দিদি, ভাবুন। রোদ্দুর রায়কে খিস্তি করার আগে ভেবে দেখুন, রবীন্দ্রনাথকে আপনি কতটা সম্মান দিয়েছেন সারাজীবনে ? যে লোকটা সাহিত্যে নোবেল (যেটা এই দেশে আর কেউ পাননি) পেয়েছিলেন, তাঁর সম্পর্কে আপনি ঠিক কতটা জেনেছেন, কতটা শ্রদ্ধাশীল। বেসুরে, নোট চেঞ্জ করে গান গাওয়া পাবলিকদের কিন্তু আপনি অ্যাভয়েড করেন, পেটাবো ভাবেন না। দাঁড়িপাল্লাটাকে সমান করতে শিখুন। এখানেও কিন্তু একটা বাক-স্বাধীনতার (এবং আপনার যোগ্যতার) কথা ঢুকে বসে আছে।
শান্তির আশায়…
নীল…
পুনশ্চ : প্রথম লাইন দুটো আমার সামান্য শ্রদ্ধাঞ্জলী, তাঁর প্রতি, যিনি আজও আমাদের মাঠঘাট-বন পেড়িয়ে আশা আহ্বান শোনার সাহস জোগান। আজ যিনি বেঁচে থাকলে হয়তো আমারও অনেক আগে ‘আর্বান নক্সাল’ বলে খ্যাত হতেন।
‘হ্যামবার্গার’ শব্দে ‘হ্যাম’ অংশে বিপ দেওয়া এবং মদের গ্লাস blurr করে দেওয়া অপ্রয়োজনীয় ও নিন্দনীয় মনে হলেও তার সাথে রোদ্দুর রায়ের বিকৃত representation এবং ‘বং কানেকশন’ এর ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’ কিভাবে তুলনীয় বুঝলাম না। আমি যেহেতু সংস্কৃতির সাথে যুক্ত আছি তাই শেষ দুটি প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু কথা বলি। কোনো সৃষ্টিকে স্রষ্টার ইচ্ছের বিরুদ্ধে যদি বিকৃতরূপ দেওয়া হয় তা অবশ্যই অন্যায় এবং সর্বতোভাবে নিন্দনীয়। রবীন্দ্রনাথ নিজে চেয়েছিলেন যাতে তাঁর গানে কেউ স্টিম রোলার না চালায়, যাতে তাঁর গানের স্বকীয়তা বজায় থাকে, যাতে তাঁর গান তাঁর বলে আলাদা করে চেনা যায়, সবকিছুরই তো স্বকীয় কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে! এক্ষেত্রে প্রথমে আসি ‘বং কানেকশন’ ছবিতে ‘পাগলা হাওয়া’কে দাদরা থেকে ৪/৪ বিটে ‘উলালা’ সহযোগে অন্য রূপ দেওয়ার প্রসঙ্গে। এই বিকৃতরূপের আমি যতদূর জানি প্রচুর নিন্দা হয়েছে, প্রতিবাদও হয়েছে। আমি নিজেও এই পরিবর্তন সমর্থন করিনি। তবে মুশকিল হল এই যে বেশির ভাগই শিল্পস্রষ্টার ইচ্ছেকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজেকে জাহির করতে চায় বুঝে কিংবা না বুঝে। আর প্রতিবাদ করলেই আরো বেশির ভাগ মানুষ প্রতিবাদীদের ‘রক্ষণশীল’ বা ‘গোঁড়া’ তকমা লাগিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন রবীন্দ্রনাথ নিজেই অচলায়তন বা তাসের দেশে রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন, উনি নিজেই লিখেছেন ‘ভাঙনের জয়গান গাও’ কিংবা
‘যদি মাতে মহাকাল উদ্দাম জটাজাল
ঝড়ে হয় লুণ্ঠিত, ঢেউ উঠে উত্তাল,
হোয়ো নাকো কুণ্ঠিত, তালে তার দিও তাল,
জয় জয় জয়গান গাইয়ো।।”
কিন্তু কতটা ভাঙন হলে তার জয়গান গাওয়া উচিত, আর মহাকাল কতটা মেতে উঠলে তালে তাল না দিয়ে কুণ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন সৃষ্টিকে বাঁচাতে সেই বোধটা থাকাটাও প্রয়োজন। ‘খোদার ওপর খোদগিরি’ দেখিয়ে এরকম আরো বিকৃতি হয়েছে, হয়তো হবেও।তার নানাসময়ে নানাভাবে প্রতিবাদ হবে, কখনো বা হবে না। ভালো-মন্দের দ্বন্দ্ব চিরকালই ছিল নানাভাবে। কিন্তু যারা প্রকৃত শিল্পী, বা শিল্পের সমঝদার, তারা সঠিকটাই গ্রহণ করবেন এবং করাতে চাইবেন। এই গানটায় অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকেই হয়তো বা বুঝেছেন যে ওই improvisationটা জোর করেই চাপানো, প্রয়োজনীয় ছিল না। তবে, সেটা অন্যায় হলেও অশালীন ছিল না কোনোভাবে, হয়তো গতানুগতিকতার বাইরে শুনেছি বলে শ্রুতিকটু লেগেছে। কিন্তু ওই যে বললাম, ওই experimentটা অশালীন ছিল না বলে প্রতিবাদগুলোও শালীনতার মাত্রা ছাড়ায় নি, মুখের কথাতেই বা লেখাতেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।
কিন্তু রোদ্দুর রায় নামক আপাত বিকৃতমস্তিষ্ক ব্যাক্তিটি যেটা করছেন, সেটা শুধুমাত্র বিকৃতি বা অশালীন নয়, সেটা নোংরামি। Cultural heritage নিয়ে এই নোংরামি করার অধিকার কারোর নেই। হতে পারেন উনি ওনার ব্যক্তিজীবনে খুবই intellectual একজন, কিন্তু সমাজের ওপর ওনার প্রভাব পড়ছে শুধুমাত্র এই বিকৃতির কারণে। অনেকে বলছে ওনার বক্তব্য আসলে বর্তমান সমাজেরই প্রতিফলন, কেউ বলছেন এই তো চাই! এই না হলে প্রতিবাদ! বিপ্লব! আমি নিজে কখনো ওনার কোনো বক্তব্য পুরো শোনার প্রয়োজনবোধ করিনি, একটু আধটু শুনেই আমার মনে হয়েছে যদি উনি বিপ্লব করতে চান, তার একটা মার্জিত ভাষা থাকা উচিত। ওনার এই প্রয়াস আমার কাছে শুধুই সোজাপথে বিখ্যাত হতে না পেরে বাঁকাপথে negative publicity কুড়িয়ে প্রচার পাওয়ার প্রচেষ্টা, যাকে আমি একেবারেই প্রত্যাশিত, গ্রহণযোগ্য, প্রশংসনীয় এবং যুক্তিযুক্ত মনে করি না। কোনটা সুস্থ সংস্কৃতি আর কোনটা অপসংস্কৃতি সেটা বোঝার জন্য সংস্কৃতির ব্যাপারে সম্যক জ্ঞানের দরকার পড়েনা, রবীন্দ্রনাথের গানের অশালীন বিকৃতি বোঝার জন্য রবীন্দ্রনাথকেও বোঝার দরকার পড়ে না। আর সবথেকে বড় কথা এখানে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্তের সৃষ্টিতে বিকৃতি, রক্ষণশীলতা এর কোনোটাই মুখ্য না, আমাদের সাধ্য কি ওঁদের ছোট করার! সবকিছু ছাপিয়ে ওনার অশালীনতাই প্রকট হয়ে গেছে। একজন মানুষের সবকিছু বদলে দিতে পারে তার আচরণ, তার ভাষার প্রয়োগ। তুই আমি বা আমরা অনেকেই অনেক খিস্তিই জানি, ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োগও করি বিশেষ বিশেষ মহলে। কিন্তু সেগুলো আমাদের ভাষার শুধুই একটা অঙ্গ, অপ্রাসঙ্গিকভাবে তার বহুল প্রয়োগ করতে আমাদের রুচিতে বাধে। উনি যেটা করছেন তাতে বলতে হয় খিস্তি ভাষার অঙ্গ নয়, সেটাই ওনার ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছে। খিস্তি দেওয়া যদি বাদও দিই, ওনার বাকি representationগুলোও অত্যন্ত বাজেরকমের বিকৃত,অসভ্য, অমার্জিত লেগেছে আমার, খিস্তি দেওয়া তো হালে। এখন ওনাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলেই হয়তো হত। যদি ওনার এক-আধটা এরকম নিদর্শন থাকত তাহলে মুখে নিন্দা করেই সবাই চুপ করে যেত হয়তো। কিন্তু এক-আধটাতে তো সীমাবদ্ধ নয়, উনি এমন অজস্র বিকৃতি সৃষ্টি করেছেন আর করে চলেছেন। তাই ওনাকে থামানোটা খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তা নাহলে ওর এই অদ্ভুতরকমের বিকৃতি দিনে দিনে আরো বাড়বে আর তার খুব খারাপ প্রভাব পড়বে আমাদের ওপর। আমাদের সমাজের একটা বড় অংশ, বিশেষ করে গঠনশীল পর্যায়ের যুব-কিশোর সমাজ ব্যতিক্রমী কিছু পেলে সেটা ভালোমন্দ বিচার না করেই সাদরে গ্রহণ করে, সেটা মানার জন্য নানারকম যুক্তিও খাড়া করে, যেটা আখেরে খারাপই করে। আর এই রোদ্দুর রায় ওনার বিকৃত representation দ্বারা, অপ্রাসঙ্গিক আর বহুল খিস্তির প্রয়োগ দ্বারা যুবমানসে এতটাই জাঁকিয়ে বসেছেন যে একটা রোদ্দুর রায় অজস্র রোদ্দুর রায়ের জন্ম দিয়ে ফেলেছেন, আর তাই আজ দেখতে পাচ্ছি ইডেনের গোলাপী টেস্টে একদল, কিংবা ক্লাসরুমে একদল পড়ুয়া, পাড়ার রাস্তা দিয়ে যাওয়া কিছু বাচ্চা ছেলের দল, সর্বোপরি অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে কোনো এক কলেজের অনুষ্ঠানে কোনো এক performer সব শ্রোতাদের involve করে সেই রবীন্দ্রসংগীত(যদি এটাকে আদৌ তা আর বলা যায়) গাইছে, ভুলটা সানন্দে গ্রহণ করছে। এই কি আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি? তাহলে কি এদের হাত ধরেই সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবক্ষয় ঘটবে আর আমাদের সেটাকে যুগের হাওয়া বলে ignore করে মেনে নিতে হবে? এরা কি করে বাঁচাবে আমাদের cultural heritage? আর সংস্কৃতিবান মানুষের দলই বা সেটা ঠিক করার চেষ্টা না করে কি করে মেনে নেবে এই ক্রমাবক্ষয়? অথচ এই এদের কাছেই সঠিকভাবে পরিবেশিত হলে, এই বিকৃতরূপ প্রকাশিত না হলে সঠিক প্রচেষ্টাটা দিতে পারত। রবীন্দ্রনাথের গান না গাক, এরা অন্য একটা ভালো গান গাইতে বা বানাতে পারত। তাই ওদের বাঁচাতে, এই অবক্ষয় বাঁচাতে, ওনার আরো বিকৃতরূপ প্রকাশ পাওয়া আটকাতে প্রচুর প্রতিবাদটা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে, ওই ইতরটাকে থামানো প্রয়োজন। ঢিল মারলে পাটকেল খেতেই হয়।
“আহ্বান, শোন আহ্বান,
আসে মাঠ-ঘাট বন পেরিয়ে
দুস্তর বাধা প্রস্তর ঠেলে বন্যার মত বেরিয়ে।
যুগসঞ্চিত সুপ্তি দিয়েছে সাড়া
হিমগিরি শুনল কি সূর্যের ইশারা–
যাত্রা শুরু উচ্ছল চলে দূর্বার বেগে তটিনী,
উত্তাল তালে উদ্দাম নাচে মুক্ত স্রোত নটিনী।
এই শুধু সত্য যে নব প্রাণে জেগেছে,
রণ সাজে সেজেছে, অধিকার অর্জনে।”
তুই যাঁর কথা দিয়ে শুরু করলি আমি তাঁর একই সৃষ্টির কথা দিয়ে শেষ করলাম, অন্য অংশ তুলে। ‘আলোর পথযাত্রী’ রাতের অন্ধকারে আলোকের প্রত্যাশা ছাড়ে না, বরং নতুন সূর্যোদয়ের আহ্বান শোনার চেষ্টা করে। কিন্তু সেই চেষ্টা সৎভাবেই করে, অসদুপায়ে নয়।
LikeLiked by 1 person
ভাই, রোদ্দুর রায় এর চ্যানেল শুরু হয়েছে 2015 সাল নাগাদ। তখনও খিল্লি হয়েছে, এখন একটা গান ভাইরাল হয়েছে, আর সেটাও ওনার চ্যানেল থেকে নয়। ভিডিও টা হোয়্যাটস্যাপ এ উনি ফরোয়ার্ড করেন নি; তাই ‘সমাজের অবক্ষয়’ বা ‘যুগের হাওয়ার’ দোষটা ওনাকে দেওয়া যাচ্ছে না মোটেই। আর সমাজের স্তরে স্তরে সংস্কৃতির অবক্ষয়ের দায় ওনার ঘাড়ে ফেলে দেয় সেরে দিলে তো হবে না… ওনাকে থামাতে হলে ওনাকে নিয়ে চর্চা বন্ধ কর। লিগালি ওনাকে থামানোর কোনো ক্ষমতা কারোর নেই; থামানোর যা প্রয়াস চলছে, সেটাতে ওনার পপুলারিটি বাড়ছে বই কমছে না…
LikeLike