বাঙালির চিন্তার বিভিন্ন স্তর আমাকে অবাক করে, মুগ্ধ করে… আবার মাঝে মাঝে মনে হয় এরকম চিন্তাভাবনা লোকে করে কি ভাবে ?
হ্যাঁ, সত্যিই… আসলে চিন্তার স্তরের কাজ সবসময় তর থেকে তমের দিকে যাওয়া, কিন্তু সেটা উচ্চতর বা নিম্নতর, সেটা বোঝা, অনেকক্ষেত্রেই যিনি চিন্তা করছেন, তাঁর পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। আবার কিছু লোক(?) তো চিন্তা-ভাবনাকে নিম্ন থেকে নিম্নতর স্তরে নিয়ে যাওয়াটাকে আর্টের পর্যায় নিয়ে গেছেন, এককথায় যাঁদের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্য বলে…
তা এরকম কিছু চিন্তাভাবনার স্তরের উদাহরণ দিই…
স্তর ১ – অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন; বাঙালির আজ অতি গর্বের দিন।
স্তর ২ – কোলকাতার ছেলে, আজ নোবেল জয়ী, এটা কোলকাতার গর্ব।
স্তর ৩ – কোলকাতায় মোট ৬ জন নোবেল লরিয়েট এর বাস ছিল… আপনার শহরে কজন ?
স্তর ৪ – কোলকাতায় মোট ছ’টা নোবেল, একটা অস্কার…
স্তর ৫ – অমর্ত্য সেনের পর অর্থনীতিতে ভারতের দ্বিতীয় নোবেল !!!
স্তর ৬ – অমর্ত্য সেনের মত এনার ও একাধিক বিয়ে…
স্তর ৭ – ওনার প্রথম স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়ে একটা হাঁটুর বয়সী মেয়েকে বিয়ে করেছেন…
স্তর ৮ – একাধিক বিয়ে না করলে আসলে নোবেল পাওয়া যায় না বোধহয়…
স্তর ৯ – যারা নোবেল পায়, তারা সবাই-ই দুশ্চরিত্র

হ্যাঁ, জানি এর মধ্যে বেশ কিছু কথা হল, যাকে বলে ‘চাড্ডীকথন’। কিন্তু আমি জানি, অনেকের মনে মনে এই ধারণাটাই তৈরী হয়েছে। কিন্তু এখন ব্যাপার হল, যিনি প্রথম স্ত্রীর সাথে বিবাহবিচ্ছেদ করে আবার বিয়ে করেছেন, তিনি কি নৈতিকভাবে নোবেল পাওয়ার যোগ্য ? তা, এই ব্যাপারেই ভাবলুম কিছু লিখে ফেলি।
প্রথম কথা হল, আমি আমার সীমিত জ্ঞান থেকে যতটুকু জানি, নোবেল বোধহয় নৈতিকতায় দেওয়া হয় না। বিশেষ করে, পুরস্কারটা আলফ্রেড নোবেলের স্মৃতিতে, ‘হাজব্যান্ড অফ দ্যা ইয়ার’ নয়। এসব ব্যাপারে পুরস্কার দেওয়া হলে, ডক্টর ব্যানার্জী সেটা পেতেন কিনা, সেটা আলোচনাসাপেক্ষ, কিন্তু ব্যাপার হল, নোবেল পুরস্কার কাকে দেওয়া হবে, ভাগ্য ভাল, সেটা আমাদের মত মিনমিনে মানসিকতার ভেতো বাঙালিরা ঠিক করে না। নাহলেই হয়েছিল।
একটা গল্প বলি এই প্রসঙ্গে, আজ থেকে অনেক বছর আগে, ১৮৭৯ সালে জার্মানিতে এক ব্যক্তির জন্ম হয়। জুরিখে পড়াশোনা করাকালীন এক সহপাঠিনীর সাথে প্রেম, বিবাহবহির্ভূত একটি কন্যা সন্তান হয়। তবে সঠিকভাবে জানা যায় না, মেয়েটির ঠিক কী হয়, কেউ বলেন মেয়েটিকে বাপ-মা দত্তক দিয়ে দেয়, কেউ বলে স্কারলেট ফিভারে মারা যায় শিশুটি। এরপর ১৯০৩ সালে দু’জনের বিবাহ। ১৯১০ এবং ১৯১৪ সালে দু-দুটি পুত্রসন্তানের জন্ম, ১৯১৪ সালে দু’জনের বার্লিনে গমন এবং সেখানে সংসার পাতা। কিন্তু বার্লিন যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই ব্যাক্তির স্ত্রী আবিস্কার করেন যে ব্যাক্তিটি তাঁর খুড়তুতো বোনের প্রতি অনুরক্ত। ফলে তিনি স্বামীকে পরিত্যাগ করে জুরিখে ফেরত আসেন, আর ১৯১৯ সালে বিবাহবিচ্ছেদ। সেই বছরেই ব্যক্তিটি নিজের খুড়তুতো বোনকে বিবাহ করে সংসার পাতেন। আর ১৯২১ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পান। শুধু তাই কেন, পদার্থবিদ্যায় তাঁর অবদান ছাড়া, আধুনিক পদার্থবিদ্যা তাঁকে ছাড়া আজ অচল…
জানেন ব্যক্তিটি কে ? যাঁরা আন্দাজ করতে পারেননি, তাঁদের জন্য বলি, তিনি অ্যালবার্ট আইনস্টাইন…

এবার বলুন ? কি করবেন ? আঁস্তাকুড়ে ফেলে দেওয়া হবে, জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি ?
এটা একটা উদাহরন দিলাম… আরো ভুড়ি ভুড়ি আছে। লিখতে শুরু করলে রাত কাবার হয়ে গেছে। তাহলে ? কি হবে এদের নিয়ে ?
আর এখানেই আসে আমার লেখার শিরোনাম, ‘ফলেন পরিচয়তে’। আইনস্টাইন নামটা শুনলে আপনার কি মনে পড়বে ? ব্ল্যাক হোল… ফিজিক্স… গ্র্যাভিটি… নাকি মিলেভা আর এলসা আইনস্টাইনের কথা ? বিশ্বাস করুন বা না করুন… এনারা নিজের যোগ্যতায় নোবেল পেয়েছেন। তাঁর সাথে এনার কটা বিয়ে, কটা ছেলেপুলে, কিচ্ছুর মানে দাঁড়ায় না। তাই বিশ্বাস করুন, আজ থেকে ১০ বছর পর, ১০০ বছর পর, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় নামটা শুনলে অর্থনীতিতে নোবেলই মনে পড়বে, মনে পড়বে না তিনি কতবার ছদনাতলায় গিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ শুনলে গীতাঞ্জলিই মনে পড়বে; ‘কাদম্বরীদেবীর সুইসাইড নোট’ নয়।
আর ১০ বছর পর কিন্তু চাড্ডী মানে জাঙিয়া আর অর্ণব গোস্বামী মানে নেড়ী মনে পড়বে… দেশনেতা নয়…
আর দ্বিতীয় কথা, যদিও এটা অনেকেই অনেকবার বলে ফেলেছেন। এবার অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, এস্থার ডাফলো এবং মাইকেল ক্রেমার। তারমধ্যে এস্থার ডাফলো পৃথিবীর সবচেয়ে কমবয়সী নোবেল পুরস্কার প্রাপক। এস্থারের এছাড়া অনেক ছোট্ট একটা পরিচয় আছে, তিনি অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী। মনে রাখবেন। তিনি আগে নোবেল লরিয়েট ইন ইকোনমিক্স, তাঁরপর অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী। অনেক পরে…
শান্তির আশায়…
নীল…
Great !! 😎
LikeLiked by 1 person
Nice.
LikeLiked by 1 person
খুব সুন্দর লেখা
LikeLike