পোস্ট-পূজা ব্লুজ বলুন, বা পূজো পরবর্তী মনখারাপ, সেটা বাঙালি জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আর বলতে বাধা নেই, এখন হয়তো একাদশী থেকে বই খুলে বসতে হয় না, তবু পূজোর পরের একটা মন খারাপ করা পরিবেশ, সেটা কাটাতে বেশ সময়ই লাগে। তাই লেখাটা সপ্তমীতে শুরু করে, সেটা শেষ করতে এই পাক্কা ছ’দিন লেগে গেল।
তবে, সত্যি বলছি, এই ব্যাপারটা নিয়ে যে কোনোদিন লিখতে হবে, ভাবতে পারিনি। যখন আমি ছোট ছিলাম, আমার ঠাকুরমা-এর কল্যাণে বা বাতিকে যাই বলুন, বছরের ১২ মাসের মধ্যে সাড়ে ১১ মাস, আমাদের বাড়িতে কাঠের মিস্ত্রি লেগে থাকত। এবং সেই মিস্ত্রি, যাকে আমি আজীবন ‘মামু’ বলেই ডেকে এসেছি, সেই বিনোদ বিহারী হালদারের ভাষা শুনে আমি চমৎকৃত হতাম। বাংলা, কিন্তু বাংলা নয়, কিন্তু কি অদ্ভূত সুন্দর লাগত, সেই ভাষাটা… “থাকমু”, “করমু”, “খামু” থেকে “কি করতাস মামু ?” এভাবেই প্রথম ‘বঙ্গালী’ কথ্য উপভাষার সাথে আমার পরিচয়।
এর পরের পরিচয়ের জন্য যিনি দায়ী, তিনি হলেন শ্রদ্ধেয় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সিনেমা এবং কমিক, আমাকে ভাষার পর আলাদা ভাবে চেনায় বাঙালদের। ‘ওরা থাকে ওধারে’ দেখে, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান নিয়ে ঝগড়ার সব ঘটনা দেখে আমি হেসে কুটিপাটি। তখন আমার প্রশ্নের তাড়নায় জর্জরিত হয়ে বাবা-মা আমকে বলেছিলেন বাঙাল আর ঘটির গল্প। ব্যাস, আমি শুধু এটুকুই জানতাম, বাঙাল ঘটি মানে নদীর এপার আর ওপার। ব্যাস…
যখন আর একটু বড় হলাম, ঋত্বিক ঘটকের হাত ধরে জানলাম দেশভাগের কথা, উদ্বাস্তু হওয়ার কষ্ট, সব হারানোর যন্ত্রণা। কত নির্যাতন সহ্য করে নিজেদের শেকড় উপড়ে সবাই পশ্চিমবঙ্গে/ভারতে এসেছিল। আমার মনে হয়েছে আমি কত ভাগ্যবান যে আমার পূর্বপুরুষদের দেষভাগের মতো নারকীয় ঘটনার জন্য রাতারাতি সমস্তকিছু ফেলে চলে আসতে হয়নি। এটাই। আমি ঘটি, আমার বাঙাল বন্ধু/বান্ধবীদের লেগ পুলিং আমি আজও করে থাকি, সবকিছু নিয়েই, কিন্তু ব্যাপারটা পুরোটাই খেলার ছলে হয়ে থাকে।
কিন্তু আজ এই লেখার অবতারণার কারণ হল, আমি আশেপাশে যে অসন্তোষ দিন দিন দানা বাঁধতে দেখছি, সেটার জন্যই। সেটা হয়তো নতুন কিছু নয়, কিন্তু আমার চোখে আজকাল পড়ছে অনেক মানুষ, যারা ব্যাপারটাকে অনেক সিরিয়াসলি নেন, মানে অনেকে মনে করেন একে অপরের ছায়া মাড়ানোও পাপ। বিশ্বাস করুন, হেডিং-এর শব্দদুটো মানে ‘মাচা’ এবং ‘লোটা’ এদুটো আমি হালে শিখেছি, তাও ফেসবুকের দৌলতে। আমি আসলে ভেবে কূলকিনারা পাইনা, জানেন। বাঙালী ধর্মের উর্দ্ধে উঠতে দু’বার ভাবে না, শুধু সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে, কালচারের দোহাই দিয়ে; সেই বাঙালী কি করে ঘটি-বাঙালের মধ্যে আমরা ওরার বিভাজন করে, আমি কোনোদিন এর কোনো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাইনি।

আমার সবসময় মনে হয়েছে, বাঙাল-ঘটি নিয়ে এই যে ব্যাপারটা, এটা সবসময় চুলোচুলি, বা খুনসুটির পর্যায়েই আছে, বা থাকবে। কিন্তু দেশটা ভারতবর্ষ আর লোক তিলকে তাল করতে এখানে ওস্তাদ। তাই মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল নিয়ে যে ঝড় চায়ের কাপে ওঠার কথা, সেটা ফেসবুকে খিস্তি-খেউড়ির পর্যায়ে পৌছে যায়।
এখানে যে ব্যাপারটাকে নিয়ে সবথেকে বেশী নোংরামো করা হয়, সেটা হল “তোরা উদ্বাস্তু…” এখান থেকে শুরু হয়ে “তোরা আমাদের জায়গা দখল করে চাকরী খেয়ে বসে আছিস…” অবধি চলে যায়। আমি জানি, গোটা ব্যাপারটাই অযৌক্তিক, তাহলে এবার আমি একটা প্রশ্ন করি,
উদ্বাস্তু কাকে বলে ?
ধরুন, একজন লোক, নাম – চামর সিং, জাতিতে রাজপুত, রাজপূতানার কোনো এক অংশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে (বর্ধমান জেলায়) এসে জমিদারীর পত্তন করলেন, তারপর কালক্রমে রায়বাহাদুর পাওয়ার পর, সিং থেকে সিংহরায় হয়ে গেলেন, এবং বংশপরম্পরায় বাঙালি রাজপূত নামক লুপ্তপ্রায় জাতির ধারক হলেন তার বংশধররা, এবং তাদের মধ্যে একজন আপনার পরিচিত, নীলোৎপল সিংহরায়।
তা এনাকে কি বলবেন ? আমাকে কি বলবেন ? উদ্বাস্তু ? নাকি স্বেচ্ছায় আর অনিচ্ছায়ের যুক্তি দেবেন ?
আর সেই যুক্তি ঠিক হলে তো মশাই, যাঁরা অনিচ্ছায় ভিটে-মাটি ছেড়ে এসেছে, তাঁদের প্রতি তো আপনাদের আরও সহানুভূতিশীল হওয়া উচিত তাই না ?
পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ (হ্যাঁ, বাংলাদেশ), ভুলে যাবেন না, র্যাডক্লীফ লাইন টানার আগে অবধি কিন্তু ওটা আমাদের দেশেরই অংশ ছিল। ওরাও কিন্তু বাঙালি… গোটা পৃথিবীর মধ্যে বাঙালিদের ‘ন্যাচারাল হাবিট্যাট’। এবার, দেশভাগের আগে আর পরে কে নদী পেরিয়েছে বা পেরোয়নি, এটা নিয়ে যদি কোঁদল করতে চান, তাহলে আপনার মত মূর্খ ভূ-ভারতে নেই। আমার দৃষ্টিভঙ্গিটা একেবারেই অন্য। আমি চমৎকৃত হয়, এটা ভেবে যে একটা নদীর এপার আর ওপারের সংস্কৃতি, এক হয়েও কতটা আলাদা। রান্না, ভাষা, সব… আর কি কি, সেটা জানতে হলে মান্না দে-র ‘সেই ঢাকা মেল নেইকো আর’ গানটা একবার শুনে নেবেন।
আসলে হয়তো আমি এখনো সিরিয়াস হতে শিখিনি, বা, আপনারা আজকাল বড্ড বেশী সিরিয়ার হয়ে যাচ্ছেন। যদি মনে হয় একটা রাগ মনে মনে দানা বেঁধে উঠছে, তাহলে ‘ওরা থাকে ওধারে’ সিনেমাটা আবার একবার দেখে নিন। মাথা ঠান্ডা হতে বাধ্য।
শান্তির আশায়…
নীল…
পুনশ্চ – তবু মোহনবাগান জাতীয় ক্লাব… জয় মোহনবাগান !!!
খুব ভালো লাগলো পড়ে। এভাবে ভাবার জন্য ধন্যবাদ। তবে রান্না টা কিন্তু তোদের থেকে আমরাই ভালো করি। হিহ হিহ
LikeLiked by 1 person
Khaoa Tobe…biswas hbe
LikeLike
ভালো লাগলো পড়ে ||
LikeLiked by 1 person