প্রতুলের ডায়েরী – শেষ কিস্তি

গতকাল রাতে আমি প্রতুলের ডায়েরী পড়া শেষ করলাম। জানি, এটা কোনো গল্প বা উপন্যাস নয়, যে সেটার একটা উপযুক্ত উপসংহার থাকবে, কিন্তু, কারোর জীবনের ঘটনাও যদি বা হয়, তাতেও একটা সমাপ্তিমূলক অন্ত মানে ইংরেজীতে যাকে ‘ক্লোজার” বলে, সেটা আশা করা তো খুব একটা অমূলক নয় ? কিন্তু ডায়েরীটা যেখানে শেষ হল, সেখানে উপসংহার তো দুরের কথা,  কি যে হল, সেটা ভেবেই কূল-কিনারা করতে পারলাম না।

কেভেন্টার্সের ছাদে বসে আবার ডায়েরী খুললাম। হ্যাঁ, দার্জিলিং-এ এসেছি গত পরশু, তার মধ্যে মিরিক, আর দার্জিলিং-এর আশেপাশের জায়গাগুলো ঘুরে দেখা হয়ে গেছে। কিন্তু এর মধ্যে আর ডায়েরী লেখা হয়নি, আর না লেখার কারণটা আসলে বড়ই অদ্ভূত। যতবারই ডায়েরী খুলে বসেছি, ততবারই আগের পাতাগুলোয় চোখ চলে গেছে… আর সত্যি করে ভালো, বা সুন্দর কিছু লেখার কোনো ইচ্ছেই হয়নি। যতবারই বসেছি মনে মরবিড উদ্ভট চিন্তাভাবনা এসেছে। অনেক রাত অবধি ম্যালে একা একা হেঁটে, রাতে পাহাড়ের রাণীর গায়ের ধাপে ধাপে গজিয়ে ওঠা ছোট ছোট বাড়িগুলোর অসংখ্য আলোর দিকে অনেক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখে একটু হাসি নিয়ে হোটেলে ফেরার পড়ও ডায়েরী খুলেই যেন মনে হয়েছে নিজেকে খুশি করার জন্য এতক্ষণ যে পরিশ্রমটা করলাম, সেটা পুরোটাই মাটি।

হ্যাঁ, মিরিকে গিয়ে ঘুরেছি, বা কাল দার্জিলিং-এও খুব ভালো করে ঘুরেছি, কিন্তু ওই… ঘুরেছি, ভালো লেগেছে… কিন্তু লিখতে গেলেই মনে হচ্ছে, এতে আর লেখার কি আছে ? এরকম পেসিমিস্ট কিন্তু আমি কোনোদিনই ছিলাম না। হয়তো এই ক’দিনের ঘটনাই আমার এরকম মনে হওয়ার কারণ। লোকের খুশি থাকার কারণ আমাদের মস্তিষ্কে কিছু রাসায়নিক প্রক্রিয়া। এবং এটা খুবই বস্তাপচা আঁতেল যুক্তি। কিন্তু আশেপাশে এত খুশির, আনন্দের কারণ খুঁজে পাওয়ার পরেও, ডায়েরী খুলে কেন লিখতে পারছি না ? কুঁড়ে হয়ে গেলাম ?

আজ বিকেলের শেষের দিকে গ্যাংটক এসে পৌছেছি। হোটেল থেকে ম্যালের দিকে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ শিলাবৃষ্টি শুরু হল। এরকম আগে দেখিনি কখনো… একটা দোকানে আশ্রয় নিতে হল, আর বাইরের শব্দ শুনে কানে তালা ধরে গেল। অবিরাম শিলাবৃষ্টি। দেখতে দেখতে একপ্লেট মোমো খেয়ে ফেললাম। শিল পড়া থামলে, দোকান থেকে বেরিয়ে হেঁটে মলে পৌছালাম। আর…

আর লিখতে চেষ্টা করতেই, মলে ঘোরার আনন্দটা পুরো মাটি হয়ে গেল। আবার মাথায় সেইসব চিন্তা; কি লিখছি, কেন লিখছি… ধুর…

আজ রুমটেক মনেস্টারি… এশিয়ার সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ মঠ… দেখে ‘খুব সুন্দর’ লাগল, এই কথাটা জোর করে লিখতে হল… যন্ত্রচালিতের মত… যেমন পাভলভের কুকুর ঘন্টার শব্দে খাবারের খোঁজ করে, ঠিক সেরকম ভাবেই, আমি জানি ভালো লেগেছিল আমার রুমটেক। কিন্তু সেটা লিখতে গেলে, সেই অবাক হওয়ার, ভালো লাগার, বিষ্ময়ের মুহূর্তগুলো যেন আর অনুভব করতে পারছি না। এ এক অদ্ভূত ব্যাপার।

আজ টি এস্টেট দেখার সময় ঠিক করলাম, এই ডায়েরীটাই যত নষ্টের গোঁড়া। এরকম কথা লিখে লিখে আজ আর ভালো কিছু লিখতে মন চাইছে না। তাই চুলোয় যাক। হ্যাঁ, চুলোতেই যাক। আজই এই ডায়েরী আমি পুড়িয়ে ফেলব। সব গোল্লায় যাক। এই আমার ফাইনাল ডিসিশন। এই ডায়েরীটা পুড়িয়ে ছাই করে… অন্তত এই সিকিমের পাহাড়ের খাদে বিসর্জ্জন না দিয়ে আমি বাড়ি ফিরছি না… নেভার…

ডায়েরীর পড়ের পাতাগুলো ফাঁকা… এখন কথা হল, ডায়েরীটা অক্ষত। কোন পোড়ার চিহ্ন নেই কোথাও। তাহলে কি ডায়েরীটা পোড়ায় নি প্রতুল ? কিন্তু, না পুড়িয়ে যদি পাহাড়ের খাদে বিসর্জ্জন দিয়েও থাকে, তাহলে কলেজ স্ট্রীটের ফুটে, অক্ষত অবস্থায় ডায়েরীটা এল কোথা থেকে ? আর যদি ডায়েরী এখানেই শেষ হয়ে যায়, তাহলে প্রতুলের কি হল ? নাকি সে এই ডায়েরীটা কাগজওয়ালা কে বেচে দিয়ে নতুন কোনো ডায়েরীতে লিখছে ? এ প্রশ্নের উত্তর, এই জন্মে পাবো বলে তো মনে হচ্ছে না। হয়তো প্রতুল তার লেখার অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠেছিল, হয়তো। কিন্তু সেটা জানার সাধ্য আমার নেই। তাই, প্রতুলকে জানা, আমার আর ফুরালো না…

তবে যেখানেই থাকুক, আশাকরি মানসিক এবং শারিরীক ভাবে যেন সুস্থা থাকে… ব্যাস… এটুকুই…      

শান্তির আশায়…

নীল  

পুনশ্চ : প্রতুলের ডায়েরীর সমাপ্তি এখানেই। আপাতত পূজো এসে পড়েছে, আজ মহালয়া… সবাইকে জানাই শারদ শুভেচ্ছা। পরের সপ্তাহ থেকে নিজের ছন্দে ফিরবে লিবারিশ। প্রতুলের ডায়েরী কেমন লাগল, অবশ্যই জানান কমেন্টে, বাকি পর্বগুলোর লিংক দেওয়া রইল।

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

চতুর্থ পর্ব

আর, আমার লেখা একটি গল্প ‘ভূতের রাজা দিল বর’ প্রকাশ পেয়েছে ‘ব্ল্যাকবোর্ড – ই ম্যাগাজিনে; কেউ ইচ্ছুক হলে, ১০ টাকা খরচ করে, কিনে পড়ে দেখতে পারেন, কথা দিচ্ছি, ঠকবেন না…

Advertisement

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.