টিচার্স ডে…

না মশাই… আমি সেইসব লোকজনদের মধ্যে পড়ি না, যারা টিচার্স ডে-এর দিন স্ট্যাটাস দেয় “এক্স কে ধন্যবাদ, ও না থাকলে ধোঁকা খাওয়া শিখতাম না”… বা “বন্ধুদের ধন্যবাদ, ওদের জন্যই আজ নিজেই জয়েন্ট রোল করতে পারি”… না… আমি শিক্ষক দিবসটাকে আমি অত্যন্ত সিরিয়াসলি নিয়ে থাকি; কারণ ‘শিক্ষক দিবস’-এর মধ্যে শিক্ষক কথাটার গুরুত্ব বেশি… না, অপরিসীম। আসলে “দিবস” ব্যাপারটা একটা কারণে ঘেঁটে গেছে কয়েক বছর ধরে। সেটাও বলব; কিন্তু তার আগে একটু সেইসব শিক্ষকদের কথা একটু না বললেই নয়, যাঁদের প্রভাব আমার জীবনে পড়েছে, কখনো বেশী, কখনো কম…

শিক্ষকদের কথা বলতে হলে সবার আগেই যাঁর কথা বলতে হয়, তিনি আমার বাবা, বিজলী প্রসাদ সিংহরায়। আজ যেটুকু ইংরেজী শিখেছি, তার পেছনে এই লোকটিরই অবদান সবথেকে বেশী। আবার অঙ্কটা অনেক কষ্ট করেও আমাকে শেখাতে পারেননি; কারণ তাঁর অন্যমনস্ক ছেলের জন্য তাঁকে ৫-১০ মিনিট অন্তর অন্তর ধৈর্য্য এবং মেজাজ হারাতে হত; কিন্তু সে কথা না হয় থাক। গোটা জীবনটাকে ছকে বাঁধার চেষ্টা করে নিয়মানুবর্তিতারও শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, আর সফলও হয়েছিলেন, কিন্তু ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির ৩ বছরের অনার্সের জন্য, আমার নিয়মানুবর্তিতার নটেগাছটিকেও অচিরে মুড়োতে হয়েছিল।  আজও তাঁর আক্ষেপ, এবং সে কথা প্রায়শই বলে থাকেন, “তোমাকে ১৬ বছরে যা শেখালাম, ৩ বছরে সব গোল্লায় পাঠিয়ে দিলে”। তবে বাবার কাছে বেশিরভাগ ছেলে-মেয়েই হল সব থেকে বাজে ছাত্র/ছাত্রী…

বাবা – মা

সেদিক থেকে বলতে গেলে, এই ব্লগের ৫০% অবদান বাবার, আর বাকি ৫০% মায়ের। কারণ আমার বাংলার শিক্ষিকা ছিলেন আমার মা। তিনি ভাষা ছাড়া আর কতটা কি শেখাতে পেরেছেন জানি না, তবে আমার শিক্ষার ব্যাপারে একটা জিনিস সবক্ষেত্রেই অপরিহার্য ছিল, সেটা হল ধোলাই। জেবনে এত্ত ধোলাই বোধহয় আর কোনো ব্যাপারে খাইনি। তবে এই ধোলাই দেওয়ার ব্যাপারে যিনি সবার আগে এগিয়ে আছেন, তিনি আমার দিদি শ্রীযুক্তা সেঁজুতি সিংহরায়। তবে আমাকে পড়তে বসালে যেসব ঘটনা ঘটত, তাতে আমার মাঝে মাঝে মনে হত, নামটা সেঁজুতি না হয়ে হুজ্জুতি বা শুধু ‘জুতি’ হলে অনেক সময়োপযোগী হত। মানে কিসের কিসের ঘা খাইনি ! লাঠি, ঝাঁটা, জুতো, পিঠ চুলকানো কাঠি, চিরুনি, স্কেল…

হুজ্জুতি…

তবে, বলাই বাহুল্য, প্রহার নামক এই ধনঞ্জয়ের আবির্ভাব আমার জীবনে না ঘটলে আমি উচ্চ-মাধ্যমিকে কেমিস্ট্রিতে ৮১ পাওয়া তো দুরস্ত, পাসও করতে পারতাম না…

কিন্তু এই দিদি আমার গরমের ছুটির দিনগুলোকে বিষময় করে তুলেছিল, ক্লাস এইট থেকে ক্লাস নাইন-টেন-এর বই খুলে প্রতিদিন একটা করে চ্যাপ্টার… ভাবলে আজও গায়ে শিহরন জাগে, চোখে জল আসে। তবে, এই অত্যাচারের সমুচিত প্রতিফল আমার দিদি পেয়েছেন, “নরানাং মাতুলক্রম”-এই নিয়ম মেনে আজ ভগবানই দিদির গর্ভে আর একটি হনুমান পাঠিয়েছেন, আর সে আমার থেকে এককাঠি ওপর বই নিচে না। আমার ভাগনে বাবাজীবনের আজ বয়স ছ’বছর। তাই হয়তো একটু হালকার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। তবে তার কপালে যে কত কালো দিন অপেক্ষা করছে, তাহা স্মরণ করিলে শয্যাকন্টকি হয়…

এ তো গেল ঘরের কথা; এবার একটু বাইরে বেরোতেই হচ্ছে। স্কুলে আসার আগে আর এক জায়গার কথা বলা আবশ্যক, সেটা হল গানের ক্লাস। আমার “মাষ্টারমশাই” ৺বেচু মুখোপাধ্যায়কে বড্ড কম সময় পেয়েছিলাম। আমার ফাঁকিবাজির জন্য নিত্য গালাগালি খেতাম, এবং “কাতলা মাছের মত মোটা মাথা”, “ছাগলের মত বড় বড় কান” ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত হয়েও, কোনোদিন গায়ে লাগেনি; আসলে ছোট থেকেই গন্ডারের চামড়া ছিল তো…

মাষ্টারমশাই…

মাষ্টারমশাই চলে গেলেন, তখন ক্লাস নাইন-এ পড়ি। গান শেখার ইতি আমার সেখানেই। গুরু খুঁজলে হয়তো পেতাম। কিন্তু সেই আন্তরিকতাটা কোথাও পেতাম না, এটা জেনেই আর… যাক গে…

স্কুলে পড়াকালীন, দেখা হল রাণা স্যারের সঙ্গে। প্রথমে দু-একবার দেখেছিলাম, আর ভাবতাম, কবে ইনি আমাদের ক্লাস নেবেন। যেদিন থেকে নিতে শুরু করলেন, সেদিন থেকে ফিজিক্স জিনিসটার প্রতি যে মোহ-মায়া তৈরী হল, সেটা অনার্সের জঘন্য রেজাল্ট করার পড়েও যায়নি।

রানা স্যার

একটা চ্যাপ্টার শুরু করার আগে স্যার একটা করে গল্প বলতেন। থার্মোডাইনামিক্স পড়ানোর আগে কাউন্ট রামফোর্ড-এর গল্প, তারপর ওয়েভ-পার্টিক্যাল ডুয়ালিটির আগে ডি-ব্রুই (ডি ব্রগলি নয়)-এর গল্প। ফিজিক্স-এর প্রতি ভালোবাসা, প্রেম, যা যা বলা যায়, সেটার পেছনে রাণা স্যারের অবদান প্রচুর। আমি ফলো থ্রু করতে পারলাম না, সেটা আমার দোষ।

সরস্বতী পুজোর সময় ফুটবল খেলা থেকে শুরু করে সব খেলাধুলার ক্ষেত্রেই স্যার এগিয়ে থাকতেন।

দূর্গা স্যার

উপপাদ্য নামক ভয়াবহ জিনিসটা একটু হলেও সোজা করে দিয়েছিলেন সিদ্ধার্থ স্যার। আর বাংলা ভাষাটার প্রতি আমার অনেক কালের যে ভালোবাসা, সেটা একটা অন্য পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের দূর্গা স্যার। তাই এনাদের কথা না বললে, ঘোরতর অন্যায় করা হবে।

সিদ্ধার্থ স্যার…

টিচার্স-ডে উপলক্ষে স্কুলে প্রতি বছর একটা প্রোগ্রাম হত। সেটা স্কুল ছাড়ার পড়ও অনেকবার দেখতে গেছিলাম। চার বছর আগে শেষবার।  

সেইবার স্কুলে গেছিলাম, শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠান দেখতে, আর সেই স্যার-ম্যাডামদের সাথে একটু দেখা করতে। কিন্তু  সেই অভিজ্ঞতাটা মোটেই ভালো হয় নি। স্যার ম্যাডাম-দের সাথে দেখা হল ঠিকই, কিন্তু অনুষ্ঠান দেখার অভিজ্ঞতাটা, মাঠে মারা গেল। অনুষ্ঠান চলার মাঝখানে, কিছু অবাঞ্ছিত লোকজন স্টেজ এ উঠে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সংবর্ধনা জ্ঞাপনের সাথে সাথে, নিজেদের সংস্থার বিজ্ঞাপন ও করছিল(বলা বাহুল্য তাতে আমাদের কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকার অনুমতি/মদত ছিল)। শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠানের নামে এই প্রহসন, আমি সহ্য করতে পারিনি। ১২ বছর ধরে যা যা শিখেছিলাম, (যেমন, ‘সদা সত্য কথা বলিবে’, ‘অন্যায়ের প্রতিবাদ করিবে’, “সত্য বলিতে ভয় পাইবে না’) সব হড় হড় করে বেড়িয়ে এল। কিন্তু তারপর বুঝলাম, একটি কথা এখনো শিখিনি, সবই করবে, কিন্তু সকলের আড়ালে, একা একা, হয়তো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে… সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা হল, সংস্থার লোকজন সামান্য ক্ষমা চাওয়ার কথা ভাবলেন-ও না। বরঞ্চ আমার-ই ভাই-বোন দের আয়োজন করা অনুষ্ঠানের বারোটা বাজিয়ে তাঁরা উঠে পড়ে লাগলেন নিজেদের কাজকর্মের ব্যাখ্যা দিতে। একজন শিক্ষিকা, এসে আমাকে বেশ কড়া বাষায় বোঝালেন, কত বড় গর্হিত অপরাধ আমি করেছি।

সেই যে স্কুল থেকে বেড়িয়ে এসেছি, আর স্কুলমুখো হইনি। স্যারেদের সাথে যোগাযোজ আছে; কখনো ফোনে, কখনো বাড়ি গিয়ে।  

টিচার্স-ডে এর ক’দিন আগে একটা খুব খারাপ খবর পেলাম। ক্লাস টেন-এ একজন স্যারের কাছে অঙ্ক আর মেকানিক্স পড়তাম। তিনি আমার থেকে ৪ বছরের বড় ছিলেন। দু-তিন দিন আগে খবর পেলাম, তিনি মারা গেছেন। সেই দেবার্পণ দা আমার মাধ্যমিকের রেজাল্টাটা পাতে দেওয়ার মত হওয়ার জন্য অনেকটাই দায়ী…

দেবার্পণ দা…

আমার দিদির স্কুল (ব্রাহ্ম গার্লস)-এর ম্যাডাম ছিলেন শর্মিষ্ঠা বন্দ্যোপাধ্যায়। ওনার কাছে অঙ্ক পড়তে গিয়ে আলাপ হয়েছিল ওনার স্বামী, মানে প্রেমাশিষ স্যারের সাথে। অঙ্ক কতটা শিখেছিলাম জানি না, কিন্তু ওনাদের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম, অনেক গানের সিডি পেয়েছিলাম, আর একটা অসাধারণ পরিবার, বাড়ি দেখেছিলাম। আর কি শিখেছিলাম, সেটা আর বললাম না, ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাবে তাহলে। কিন্তু একটা অদ্ভূত সুন্দর পরিবেশ ছিল বাড়িটায়। এখনো নিশ্চয় আছে, তবে যাওয়া হয়নি অনেকদিন…

শর্মিষ্ঠা দি ও স্যার…

কলেজে পেয়েছিলাম অমিতাভ (এ এস) স্যারকে। রাণা স্যার যে ভালোবাসাটা তৈরী করেছিলেন, সেটা কালক্রমে এ এস স্যারের প্রভাবে দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছিল। তা  ছাড়া কলেজের পিকনিক, ক্রিকেট ম্যাচ, ডিপার্টমেন্টের ম্যাগাজিন, সব ব্যাপারেই স্যার আমাদের যে মদত আর সাহয্যটা দিয়েছেন, সেটা কোনোদিনই ভোলার নয়। সেমিনার ক্লাবের সেমিনার অর্গানাইজ করা, কলেজের পারমিশান, সব ব্যাপারেই আমাদের বিপত্তারণ ছিলেন ডক্টর অমিতাভ শীল।

অমিতাভ স্যার…

বাড়িতে অনার্স পড়তাম সাধন দা এবং দীপঙ্কর দা-এর কাছে। নাম নিলুম, কিন্তু এত খারাপ স্টুডেন্ট তো তাঁরা জীবনে পাননি, তাই আজ ত্যাজ্যছাত্র করলে অবাক হব না।

কেমিস্ট্রির প্রতি আমার ভালোবাসা কোনোদিনই ছিল না। সত্যি কথা বলতে গন্ধ সহ্য হত না। উচ্চমাধমিকের পর, দিদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়ার পর পাসের কেমিস্ট্রি নিয়ে বেশ চাপে ছিলাম। কিন্তু অর্গানিক ক্লাসে ঢুকে বেশ স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলেছিলুম কৌশিক স্যারের পড়ানো দেখে। দিনে দিনে কথা বাড়ল সিনেমা নিয়ে, ফাউন্টেন পেন নিয়ে, তারপর কলেজ স্ট্রীটে পেনের দোকানে দাঁড়িয়ে চা খাওয়া থেকে একসাথে পেন কিনতে এদিক ওদিক যাওয়া, ঘন্টার পর ঘন্টা স্টিফেন কিং থেকে লাভক্রাফট, আর হেলবয় থেকে শার্লক হোমস নিয়ে আলোচনা,  আর মাঝে মাঝেই স্যারের বাড়িতে আড্ডা। স্যার আমার কাছে স্যার রয়ে গেলেন, স্যারের স্ত্রী ‘বউদি’ হয়ে উঠলেন, আর একটা ভাইঝিও পেলাম। এটা ছাত্র হিসাবে আমার একেবারেই অন্যরকম প্রাপ্তি।

স্যার, বউদি আর ভাইঝি…

তবে, কলেজের পড়, এরকম শিক্ষক একজনও পাইনি, যিনি আমার জীবনকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন। সত্যি বলছি।

তবে, এ সবের বাইরে একজনের কথা না বললে, এই বিরাট লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তিনি আমার জামাইবাবু, কৌস্তভ বন্দ্যোপাধ্যায়। সামান্য যে টুকু জ্ঞানের জন্য নিজেকে ফটোগ্রাফার বলে কলার তুলে ঘুরি আজ, সেটার হাতেখড়ি হয়েছিল কৌস্তভদার হাতেই। ডি এস এল আর ধরা শিখেছিলাম, শিখেছিলাম ছবি তোলা।

কৌস্তভদা…

বিরাট বড় লেখা হয়ে গেল, জানি। কিন্তু সবার কথা লিখতে গেলে পরিসরের কথা চিন্তা করা মুশকিল। দিন প্রায় শেষ হতে চলল, কিন্তু দিনের শেষে আমার সব শিক্ষক-শিক্ষিকাকে জানাই আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম। আপনারা না থাকলে, আমি সত্যিই থাকতাম না…

শান্তির আশায়…

নীল…

পুনশ্চ – শনিবার যথারীতি প্রতুলের ডায়েরীর দ্বিতীয় কিস্তি আসবে…

Advertisement

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.