লেখকের কথা :
কলেজস্ট্রীটের ফুট থেকে পুরোনো ডায়েরী কিনে যে কেন এনেছিলাম, সেটা ভাবলে এখন নিজের মনকেই কোনো সদুত্তর দিতে পারি না; হয়তো ভেবেছিলাম, প্রোফেসর শঙ্কুর পরের ডায়েরী, যেটা হয়তো মাণিকবাবুর হাত এড়িয়ে পুরোনো বইয়ের বোঝার ভেতরে আত্মগোপন করে ছিল… কিন্তু সেরকম কপাল নিজে আর এই পোড়া দেশে কতজনই আর জন্মেছে ? শঙ্কুর বদলে পেলাম প্রতুলকে। তবে না, সে বিজ্ঞানী-টীজ্ঞানী নয়… আসলে তার ডায়েরী পড়ে বোঝা যায় না, সে কি করে, ঠিক কি তার পেশা। কিন্তু তাকে যেটুকু চিনেছি, তা তার ডায়েরীর থেকে… প্রথমে ভেবেছিলাম, তার ডায়েরীটাকে হুবহু তুলে দেব, কিন্তু তারপর ভাবলাম, না… আসলে প্রতুলের ডায়েরীর সংষ্পর্ষে থেকে আমার নিজের অনেক কথা, যেগুলো বলতে গেলে গলার কাছে দলা পাকিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসে, সেগুলো যেন বেড়িয়ে আসছে, একটু করে… তাই প্রতুলের ডায়েরীটা আমি কিভাবে পড়েছি, এবং কি পড়েছি, দুটোই এখানে লিখতে বসলাম। ভালো হয়তো আপনাদের লাগবে না, কিন্তু প্রতুলদের মনের মধ্যে কি চলে, সেটা জানতে পারবেন, আর বুঝতে পারবেন, মুখ ঘুরিয়ে নিতে না পারার কি জ্বালা…
সাধরণ মানুষের সংজ্ঞাটা, সময়ের সাথে সাথে বদলে গেছে আমাদের কাছে। একসময় সাধারণ বলতে আমরা বুঝতাম পরশপাথরের তুলসী চক্কোত্তি, কিংবা কাপুরুষ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এখন কি বুঝি, সেটা আমার চেয়ে ভাল সিজিদ্দা বলতে পারবেন। এবার, আমাদের সমাজের কাঠামো যদি ধরি একটা ধাতব পাতের ওপর খোদাই করা হয়, তাহলে সাধরণ মানুষও সেই পাতে একটা দাগ ফেলে তার দৈনন্দিন কাজের মাধ্যমে; প্রতুল হল সেই ব্যক্তি, যে সমাজের ছাঁচে সামান্যতম দাগ ফেলতেও অক্ষম… অর্থাৎ, সাধারণ মানুষেরও একটা স্তর থাকে, প্রতুল ধরে নিন সেই স্তরেরও নীচে বসবাস করে। মানে সাধারণের থেকেও সাধারণ যদি কিছু থেকে থাকে, সেই সম্প্রদায়েরই সদস্য প্রতুল। রাস্তার ভীড়ে যাদের পাবেন, তারাই সাধারণ মানুষ; কিন্তু প্রতুল হল সেই লোক, যে খালি রাস্তায় একা হাঁটলেও সবার চোখ এড়িয়ে যাবে।
তার সম্পর্কে এ ধারণা আমার হয়েছে তার রোজনমচায় চোখ বুলিয়ে। কালো চামড়ারূপী রেক্সিনে বাঁধানো ডায়েরীটার প্রথম পাতায় লেখা রয়েছে “প্রতুল সেন”। ব্যাস… আর কিচ্ছু না, সন তারিখের বালাই নেই, রঙ-বেরঙের কালিতে লেখা। তবে লেখা পড়লে বোঝা যায় সেটা একদিনে কখনোই লেখা নয়। আর প্রথম লাইন থেকেই এক এলোমেলো অগোছালো মানুষের পরিচয় পেয়েছি…

বছরের পর বছর, একের পর এক ডায়েরী জমিয়ে শেষে এটায় লিখতে শুরু করলাম। ঠিক রোজনামচা হিসাবে নয়, যখন যা মনে হবে সেটাই। আমার দোষ তো ওই একটাই; যতই নিজেকে ‘পারফেক্সনিষ্ট’ ভাবি না কেন, একটা কাজে রেগুলারিটি মেইনটেন করা আমার জীবনে হল না। তাই, ডেট বসিয়ে নিজের অক্ষমতার সাক্ষ্য রাখার পক্ষপাতী আমি নই। যখন যা মনে ইচ্ছে হবে লিখব। কোনো টিপ্পনী থাকবে না, লেখা চলবে লাগামহীন ঘোড়ার মতন।
এবার একটু শেষ কয়েক বছরের কথা বিশ্লেষণ করা যাক। এখানে ভর্তি হওয়ার আগে থেকেই স্কুলের বন্ধুদের জন্য মাঝে মাঝে মনখারাপ করত। আর এখানে এসে চারপাশের লোকজনদের দেখে শুনে ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি অবস্থা হয়েছিল। ক্লাসের ছেলেপুলে যে রেটে টাকা ওড়ায়, সেটা আমার অন্তত খুবই দৃষ্টিকটু লাগে। আসলে ‘তোমার ভালো আরো ভালো হোক’ আর ‘তোমার ভালোতে আমি খুশি হলাম না’ এই দুটো জিনিসের মধ্যে অনেক তফাত আছে। এখানে এসে এই দ্বিতীয় প্রজাতীর মানুষের সম্মুখীন হতে হয়েছে আমাকে… তুমি যদি কিছু ভালো করতে চাও, তোমাকে সবাই আটকাতে চাইবে, তোমার ক্ষতি করতে চাইবে, আর না পারলে তোমার ভালো কাজ, তোমার সুন্দর জিনিসটা দেখেও নাক সিঁটকাবে। আসলে কারোর ভালো কাজ দেখে প্রশংসা করার আগে মনে হয়, আমার নিজের অক্ষমতাটা বড় হয়ে গেল। অন্যের অ্যাচিভমেন্ট-এর সামনে, আমার অক্ষমতা, যেন অ্যামপ্লিফায়েড হয়ে গেল। ওর ভালো কাজের প্রশংসার থেকে লোকে আমার অকর্মণ্যতার তুলনা করে বোঝাবে, আমি কতটা অক্ষম, কতটা তুচ্ছ।
এ শালা কোন দেশে এসে পড়ালাম রে বাবা ! চারদিকে আনকালচার্ড পাবলিকের সমন্নয়। এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায় দেখ। টিচারদের পদলেহন করাটা নতুন কিছু নয়, কিন্তু তা বলে এত ? এবার তো পায়ে লালা জড়িয়ে আছাড় খাবেন তিনি ! এমনই উচ্চ চিন্তাধারার মালিক এনারা, রেস্টোরেন্টে ৫-৬০০ টাকার বিল তুচ্ছ জিনিস এদের কাছে, কিন্তু জেরক্সের দোকানে কেন ৭০ এর জায়গায় ৭৫ পয়সা নেব, এই নিয়ে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিতে এনারা পিছপা হন না…
শনি রবি ছুটির দিন, আর এই দুদিন ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিই মোটামুটি… সারা সপ্তাহে অতটা যাতায়াত, ধকল কি আর কম যায়। রাতে ঘুমের অসুবিধা আমার কোনোকালেই ছিল না; দেশে যুদ্ধ বাঁধুক, বা মহামারী; আমি একেবারে মরার মতোই ঘুমাই… ঘুম আসে না শুধু কম্পিউটার খারাপ হলে… ইদানিং, খাওয়ার পড়ে, মানে ভাতঘুম এর সময় স্বপ্নের সংখ্যায় দিন দিন বেড়ে চলেছে; রাতে স্বপ্ন হয়তো কালেভদ্রে দেখে থাকি, কিন্তু দিনের বেলা স্বপ্ন দেখাটা একেবারে নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে…
Daydream ? Or “Daymare” ?
এই অবধি পড়ার পর মায়ের ডাকে খেতে গেলাম, সেদিন রাতে আর পড়ার সময় হয়নি, একটা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। ডায়েরীর পড়ের পাতায় যাওয়ার সুযোগ ঘটল আমার ঠিক একদিন পড়, রাত্রিবেলা…
শুরুটা ঠিক ‘ঘটনাবহুল’ নয় ঠিকই, কিন্তু সুচনাতেই যদি সব শেষ হয়ে যেত, তাহলে তো আমাকেও বলতে হত সব ‘একলাইনে বলার কথা…’ যাক গে। আগেই বলেছি, কত কিস্তিতে শেষ হবে এটা জানি না, আর কতদিনে শেষ হবে সেটাও জানি না, তাই, একটু সহ্য করতে হবে বইকি !!!
শান্তির আশায়,
নীল…
Pingback: প্রতুলের ডায়েরী – শেষ কিস্তি – Libberish