ও দাদা, বুঝতে পারলাম না…

আমি অনেক সময়ই বলে থাকি, আজ থেকে ১০-১২  বছর আগে যখন আন্তর্জালিক যোগাযোগব্যবস্থায় জড়িয়ে আমরা দুবেলা হোঁচট খেতাম না, তখন জীবন অনেক সহজ ছিল। ফেসবুক থেকে ট্যুইটারের রমরমায় সবার আগে যে জিনিসটা আমরা হারিয়েছি, সেটা হল আমাদের সততা, মানে সত্যি কথা বলার সৎ সাহস।

আমরা মানি,  বা না মানি, আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া একটু একটু করে আমাদের পরিচয় বা আইডেনটিটি-এর একটা বড় অংশ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমি কি পোস্ট করছি, কাকে ফলো করছি, কার কোন পোস্ট-এ কি রিঅ্যাকশন দিচ্ছি, সবই আমার মনোভাব আর পরিচয়ের অঙ্গ হয়ে দাঁড়াচ্ছে দিনে দিনে। আর শুধু এই কারণেই একটা বিপত্তি ঘটছে।

মান্না দে সেই কয়েক দশক আগে গেয়ে গেছেন…

“যা খুশি ওরা বলে বলুক, ওদের কথায় কি আসে যায় ?”

কিন্তু ব্যাপার হল, অনেক কিছুই আমার যাচ্ছে-আসছে… একটা লাইন সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করার আগে তাই আমি দশবার ভাবছি – “লোকে কি ভাববে…” কারণ চাই বা না চাই, সোশ্যাল মিডিয়ার চক্করে আমরা অনেক বেশী জাজমেন্টাল হয়ে পড়েছি; দু’জনের ব্যক্তিগত মতামত আলাদা হতেই পারে, আর সেই নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করাটাই হিউম্যান নেচার। এখন অনেক তর্কেরই অবসান হতে পারে “লেটস এগ্রি টু ডিসেগ্রি” বলে। কিন্তু  তর্ক-বিতর্ক আজকাল শেষ হয় প্রথমে পারস্পরিক কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি আর তারপর ‘ব্লক’-এ এসে।

তাই, এইরকম এঁড়ে তর্ক আর ফালতু জাজমেন্ট এড়ানোর জন্য, আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় এক বর্ণ লেখার আগে দশ বার ভাবি… আর, মিথ্যে লিখি বা বলি…

যেমন ধরুন সিনেমা… পরিচালকরা যতই মনুষ্যোত্তর হোন না কেন, তাঁরা নিজে একা দেখার জন্য একটা সিনেমা নিশ্চয় তৈরী করেন না। আর একজন লোক, যে পয়সা খরচ করে একটা সিনেমা দেখছে, তার নিজের ওপিনয়ন দেওয়ার অধিকার অবশ্যই আছে… আর এখানেই আসে আনপপুলার ওপিনিয়নের কথা। ধরুন একটা সিনেমা, সবাই দেখে এসে ধন্য ধন্য করছে; আমি সেটা দেখে আগাপাস্তালা কিছুই বুঝতে পারলাম না। তাই আমি স্টেটাস দিলাম, “অমুক সিনেমাটার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝলাম না…” ব্যস, অমনি এসে জুটবে একদল লোক, যারা প্রমাণ করতে উদ্যত যে আমার জ্ঞানের পরিধি কতটা ছোট। সেখান থেকে পার্সোনাল অ্যাটাক আর অনেক কিছু আগে থেকেই সত্য হিসাবে মনে মনে প্রতিষ্ঠা করে খিস্তিবর্ষন। খুব কম লোক আছেন, যারা কমেন্ট করবেন “কেন দাদা ? কি হল ?” বলে একটা গঠনমূলক আলোচনা/সমালোচনার সাহয্য নেবেন। তাই একটা সিনেমা, যেটা দেখে গত এক-দেড় ঘন্টা আমার ক্রমাগত মাথাব্যাথা করেছে, সেটা দেখে এসে আমায় সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখতে হয় “মাইন্ডব্লোইং !!! অমুকের সেরা সিনেমা…”

দেখুন, লোকে সিনেমা/শিল্প বুঝতে পারে না দু’টো কারণে;

এক, সেটা নিয়ে অনেক কিছু ভাবার বিষয় আছে, অনেক স্তর বা লেয়ার আছে গল্পের, যেটা নিয়ে অনেক ভাবনা চিন্তা করা যায় এবং আলাদা আলাদা উপসংহার-এ পৌছোনো যায়।

আর দুই, তাত মাল-মশলা কিছুই নেই, শুধু ঢপের কেত্তন, আর সেটা নিয়ে ভাবারও কিছু থাকে না পরে, শুধু মর্কেটিং আর সোশ্যাল মিডিয়ার ডামাডোলে ১-২ মাসের জন্য কাল্ট ক্লাসিক হয়ে দাঁড়ায়; তারপরে সেটার দিকে কেউ ভুল করেও ফিরে তাকায় না।

আমি যে সমাজে বাস করছি, শিল্প-সংস্কৃতি সেটার একটা বড় অংশ। তাই আমি অন্তত মনে করি, সেই সমাজবদ্ধ জীব হয়ে খারাপকে খারাপ আর ভালোকে ভালো বলার মৌলিক অধিকার আমার আছে। আমার মতামতের দাম কে দিল, সেটা দেখার কোনো প্রয়োজন বোধ করি না আমি, আমার মতামতের দাম শুধু আমার কাছেই আছে, কারণ আমার মতামতে আমি নিজেকে মিথ্যে বলছি না।

এখন সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে সেলিব্রিটি-দর্শক দূরত্ব অনেক অনেক কমে গেছে; কিন্তু সেলিব্রিটিরা নিজেদের মনুষ্যোত্তর জীব ভাবতে শুরু করেছেন। এখন কেই যদি সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনা দেখে দাবী করেন “আপনারা ইন্ডাস্ট্রির কি বোঝেন ?” তার থেকে বাজে যুক্তি আর কিছুই হতে পারে না… দর্শকরা না থাকলে, আপনার কোথায় থাকতেন ?

তাই নিজের অজান্তেই আমরা আমাদের মানসিক অবনমন ঘটিয়েছি। নিজের মনের সততাকে ফেলে দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার জগতের সাথে তাল মেলাতে তৈরী করেছি এক অন্য আমি, যার নিজস্বতা ভুলে গিয়ে সে অনেক কথায় কথা আর তালে তাল মেলাতে পটু। তার এইটুকু সাহস নেই, যে কারোর কথার ধার না ধেরে সে বলতে পারে,

-“ও দাদা, বুঝতে পারলাম না…”   

শান্তির আশায়,

নীল…

Advertisement

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.