জয় শ্রী (?) রাম…

দিব্যি গেলে বলছি, এটা কোনো রাজনৈতিক পোষ্ট না। একটু পড়ে দেখুন; বুঝতে পারবেন। লেখাটার নাম ‘বাঙ্গালীর ধর্মাচরণ’ করলে হয়তো অনেক বেশী যৌক্তিক হত, কিন্তু লেখা ব্যাপারটাই এরকম, সবই যদি ব্যাখ্যা করে দিই, তাহলে তো ব্লগ আর উইকিপিডিয়ার মধ্যে কোনো তফাতই থাকল না… যাই হোক গে…

আমরা সকলেই জানি, ‘জয় শ্রী রাম’ কথাটা ইদানিং কালে কোন পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবহার হচ্ছে; এবং সেটাতে অনেকেরই গাত্রদাহ হচ্ছে। বলতে দ্বিধা নেই, যে সেই দলের আমিও এক সদস্য। অর্থাৎ, কথাটা শুনলে একটা চাপা অস্বস্তি যে আমি অনুভব করছি না, সেটা বলে নিজেকে মিথ্যেবাদী সাব্যস্ত  করব না। এবার কথা হল, কেন এই অস্বস্তি। রামায়ণ, যা কিনা ভারতের মহাকাব্য, তার মূল ‘প্রোটাগনিস্ট’-এর নামে জয়ধ্বনি শুনে, আমার সমস্যাটা কি হচ্ছে? এই সমস্যার কারণ ঢুকে আছে বাঙালীর রক্তে। ভারতের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় বাংলা ও বাঙালীর পুজো থেকে শুরু করে দেবদেবীর ধারণাটা একেবারেই অন্যরকম।

একেবারে সোজা উদাহরনটা দিয়েই শুরু করি; দূর্গাপুজো বললে আপনার কি মনে পড়ে ?

মহালয়া… বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র… প্যান্ডেল… খাওয়া-দাওয়া… পুজো… আড্ডা… অষ্টমীতে লুচি… নবমীতে মাংস… সন্ধীপুজো… বিসর্জন…

জাগো…

এই লিস্ট চলতেই থাকবে, তবে আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, সিংহভাগ বাঙালীর ক্ষেত্রে, লিস্টটা এরকমই হবে। মানে পুজোটা সত্যিই আমাদের কাছে উৎসব, মেলা, একটা বিশাল আকারের বিরাট বড় একটা যাকে বলে ‘লাইফ ইভেন্ট’। এবার বাংলার বাইরে যান, নবরাত্রি আর নিরামিষ জুটবে কপালে।

এবার এখানেও কথা হচ্ছে, দূর্গার এই সপরিবারে পূজিত হওয়ার রূপ, এটাও কিন্তু বাংলার উদ্ভাবন। অন্য জায়গায় দূর্গার সিংহবাহিনী যে মূর্তি পূজিত হয়(শেরাবালি), সেখানে কিন্তু দেবীর সাথে দেবীর বাহন থাকে শুধু।

তাই যুগে যুগে দেবতার আগে, তাদের পরিবারের সদস্য ভেবেছি আমরা। যেমন চন্দ্রিল ভট্টাচার্য্য বলেছিলেন, আমরা দূর্গাকে বাড়ির মেয়ে, শিবকে গাঁজাখোর বৈরাগ্যেভরা বাড়ির জামাই ভেবেছি। তাইত বাংলা ভাষায় এত গান, এত কবিতা…

-“অতি বড় বৃদ্ধ পতি সিদ্ধিতে নিপূণ।

কোনো গুন নাহি তাঁর, কপালে আগুন ।।”

আরও কত গান/কবিতা আছে… তাই সেই কোন আমল থেকেই বাঙালি দেবতাদের পূজার আগে আপ্যায়ণ করেছ। সে যা কোনো দেবতাই হোক না কেন। তাই ভারতচন্দ্র রায়গুনকার থেকে রূপচাঁদ পক্ষী পর্যন্ত, সকলেই সাহিত্য রচনাকে রেখেছেন দেবতার আগে। আর আমরা তাই সাহিত্য রচনাকেও  সরস্বতীর সাধনা; মানে পূজোই মনে করে থাকি।

রামায়ণ কি আমরা পড়িনি ? না মহাভারত পড়িনি ? কিন্তু মহাকাব্যকে মহাকাব্যের (এখানে কাব্য কথাটায় একটু জোর পরবে) মত করেই পড়েছি; ধর্মগ্রন্থ ভেবে নয়। আর সেটা ভাবি না বলেই রাম ভগবান হওয়ার অনেক আগে আমাদের কাছে অযোধ্যার রাজ পরিবারের ছেলে, যে বাবা-মা-সৎমা-বউ-ভাই-এর চক্করে ফেঁসে বনে গিয়েছিল চোদ্দ বছর। তারপর অযোধ্যায় ফিরে এসে সিংহাসনে বসে প্রজাদের দাবীতে সীতকে বনবাস; তারপর অগ্নিপরীক্ষার মধ্যে ফেলে একটা কেলেঙ্কারি কান্ড ঘটিয়েছিল। রামায়ণ পড়ে তাই আমার মত অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে; রাম কি রাজার কর্তব্য পালন করতে গিয়ে নিজের স্ত্রীর প্রতি কর্তব্যকে অবহেলা করেছিলেন ?

আর তাই আমরা বিতর্ক তুলতে পারি, দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামী হওয়াটা কি ম্যারিটাল রেপ নয় ?

এই প্রশ্নগুলো মনে জাগলে সেটা মুখে এনে বলতে, বা আলোচনা করতে পারি বলেই, আমি বাঙালি, এসব প্রশ্ন মনে এলেই জিভ কেটে কান মূলে প্রায়শ্চিত্ত করার কথা ভাবি না বলেই আমরা বাঙালি। তাই একটা লোকের মুখে আমার  মাতৃভাষা শুনলে, আমরা প্রশ্ম করি

_”আপনি বাঙালি ?”

জিজ্ঞেস করি না, ‘আপনি কি হিন্দু ?’ ‘বা আপনি কি হিন্দু-বাঙালি ?’ না… কারণ আমাদের ভাষা আসে ধর্মের আগে, আমাদের সংস্কৃতি আসে ধর্মের আগে। তাই আমরা দূর্গাপূজোয় অঞ্জলি দিই, আবার জাকারিয়া স্ট্রীটে ভিড় জমাই কাবাবের স্বাদ পেতে। সেন্ট পলস-এ যাই প্রেয়ার শুনতে।

ধর্মের জন্য পথে নামতে হয়নি বাঙালিকে; বিসর্জনে নাচা বা ঈদে নমাজ পড়া ছাড়া…

উগ্র হিন্দুত্ববাদ বলুন, বা সাম্প্রদায়িকতার কথা বলুন, আমরা কিন্তু ছুঁড়ে সব ফেলে দিয়েছি;

সতীদাহ রদ আটকানোর কম চেষ্টা হয়েছিল ? আটকানো গেছে? বিধবা বিবাহ প্রণয়ন, আটকাতে পেড়েছে ? বাংলাদেশের জাতীয় ভাষা ‘উর্দু’ করার চেষ্টা হয়েছিল, কি ফলাফল ছিল মনে আছে  (হ্যাঁ মশাই, আমি বাংলাদেশের লোকদের বাঙালিই মনে করি)?

তাই জয় শ্রী রাম শুনলে, কেমন অস্বস্তিই লাগে… কেন মশাই, আমি কি হনুমান নাকি ? আর বিশেষ করে, লোকের কথায় চিল্লাবো কেন ? আমার ইচ্ছে হলে আমি যা ইচ্ছা বলে চিল্লাব… সে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ হোক বা ‘ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও…’

আজকে এই লেখাটা লেখার একটা বড় কারণ হল এটাই; আমি আশাবাদী। এখনো এই ল্যাদখোর হুজুগে বাঙালীর প্রতি আমার অগাধ ভরসা আছে… আমি এখনো বিশ্বাস করি, সে এই হিন্দি আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িকতা, উগ্রতা, সবকিছুর ওপরে উঠে সব খারাপকে বর্জন করে আমরা আবার আমাদের শান্তি আর সম্পৃতির দিকে যেতে পারব।

তবে বলাই বাহুল্য, ছুঁড়ে ফেলতে বলছি বলে পিসিদিদির মত গাড়ি থামিয়ে তেড়ে যাবেন না… লোকে খিল্লি করবে…

শান্তির আশায়…

নীল…

Advertisement

One thought on “জয় শ্রী (?) রাম…

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.