বাংলা ভাষার ইংরেজীকরনের সাথে সাথে, অনেকের মনে একটা ভ্রান্ত ধারণা জন্মেছে, যে কিছু কিছু ইংরেজী শব্দের কোনো বাংলা প্রতিশব্দ হয় না। তাই ‘রেবেল’ (Rebel) কথাটার বাংলা করলে যে পাতি বিদ্রোহী বা লিঙ্গভেদে বিদ্রোহিনী দাঁড়ায়, সেটা ভেবে হয়তো অনেকের কপাল কুঁচকাবে, কারণ একটা দুই সিলেবল(দল)-এর শব্দ যদি চার সিলেবল-এর বাংলা যুক্তাক্ষর-সম্বলিত হয়ে দাঁড়ায় অনুবাদে, তাহলে মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠতে চায় তো বটেই।
তো আজকের বকবকানি আমাদের এই রেবেল শব্দটাকে নিয়েই। অনেকের অনেক গালাগাল খেয়েছি, কিন্তু, আজ হয়তো গোটা নারীজাতি আমার গুষ্টি উদ্ধার করতে উদ্যত হবে, কিন্তু মাথায় যেটা এল, সেটা না লিখে থাকতে আমি পারুম না… যাউক গিয়া। কামের কথায় আসি… ‘রেবেল’, ‘রেবেল গার্ল’ অর্থাৎ কিনা ‘বিদ্রোহিনী নারী’ (হ্যাঁ, জানি কেমন স্বপন সাহার সিনেমা মার্কা হয়ে গেল), অর্থাৎ সমাজের কুসংস্কার, কুপ্রথা, আরো যত নারীবিরোধী ‘কু’ আছে, সে সবের বিরুদ্ধে জেহাদ (লস্কর বা আইসিস-এর টা নয়) ঘোষণা করা। মানে, তথাকথিত সংজ্ঞা ধরলে, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, মাতঙ্গিনী হাজরা থেকে মালালা ইউসুফজাই, সবাইকেই এই রেবেল গার্ল-এর তকমা দেওয়া যায়। এখন ব্যাপার হল, আশেপাশে একটু ঠাহর করে দেখলে পরে এখন গন্ডায় গন্ডায় মেয়েদের দেখা যাচ্ছে, যারা নিজেই নিজেদের গায়ে রেবেল তকমা লাগিয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরছে। তাদের যদি একটু দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘তুমি ঠিক কোন গোকুলের ষাঁড়, মা ?’ উত্তর শুনলে পিলে চমকে যাবে…

-“আমি ডেইলী ৪০টা করে ‘সিগি’ সেবন করি, আমাদের বংশে এই প্রথম কোনো মেয়ে স্মোক করছে…”
-“আমি সপ্তাহে একদিন করে হুইস্কি সেবন করে থাকি, বাড়ির কেউ জানে না…”
-“ও মা! দেখছেন না, আমার টপের কাঁধ থেকে ব্রা-এর স্ট্র্যাপ উঁকি মারছে?”
হ্যাঁ, আমাদের পুরুষতান্ত্রিক বুর্জোয়া সমাজ এককালে মনে করত (অনেকাংশ এখনও করে), যে তম্বাকু এবং সোমরস উপভোগের একচেটিয়া অধিকার কেবলমাত্র শিশ্নধারীদেরই আছে; বরং যেসব মেয়েরা এসব ‘কু-অভ্যাসের’ শিকার, তাদের ‘বাইজি’ বা ‘বেশ্যা’ বলে আখ্যা দিতেও কেউ পেছপা হত না, বা হয় না। পোশাক আশাকের ব্যাপারেও কি ছিল বা আছে, সেটা আমি বলেছি; আমরা যতই ‘হিজাব’-এর কথা ভেবে চোখ কপালে তুলি না কেন, এককালে হিন্দু বনেদী বাড়ির বউ এবং বাহিরমহলের মধ্যে একগলা ঘোমটা আর দরমার বেড়া ছিল।
হ্যাঁ, ব্রা সব মেয়েরাই পড়ে, সবাই জানে সব মেয়েরাই পড়ে, ব্রায়ের স্ট্র্যাপ জামার বাইরে উঁকিঝুঁকি মারতেই পারে, এখন আমাদের সমাজে প্রচুর বিকৃতকাম ব্যাক্তি বাস করে, যারা উঁকি মারা স্ট্র্যাপ দেখে মনে মনে ‘চোলী কে পিছে ক্যায়া হ্যায়…’ কল্পনা করে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলে; তবে সেটা নতুন নয়; বোরখা দেখেও শীঘ্রপতন অনেকেরই হয়ে থাকে। তাই আপনার অন্তর্বাসের ফিতে দর্শন করে আমাকে আপনাকে আমায় বিদ্রোহিনী আখ্যা দিতে হবে? এটা একটু বেশী হয়ে গেল না ম্যাডাম?
হ্যাঁ মানলুম, আপনি আপনার বংশের প্রথম মেয়ে জিনি দায়িত্ব নিয়ে নিজের লাং ক্যান্সার হওয়ার প্রোবাবিলিটি বাড়িয়ে দিচ্ছেন; হ্যাঁ, সেদিক থেকে দেখলে, দেশের জনসংখ্যা রোধের পথে দু’চারটে নুড়ি আপনি ফেলছেন ঠিকই, কিন্তু সেজন্য আপনাকে রেবেল আখ্যা দিয়ে কি প্রভাসের অপমান করব (এটা আমার দঃ ভারতীয় সিনেমাপ্রেমী বন্ধুদের জন্য একটা… যাকে বলে ইনসাইড জোক :-D)?
কিন্তু একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই রেবেল শব্দটা। চিরাচরিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে একটা বৈপ্লবীক কিছু করাকে আমরা অবশ্যই সম্মান এবং গুরুত্ব দেব, কিন্তু মেয়ে (এবং ছেলেদের) মধ্যে একটা ধারণা তৈরী হয়ে যাচ্ছে, অন্যায় কিছু নির্দ্বিধায় করে ফেলা, বা পুরুষরা যেসব অন্যায় কাজ করে থাকে, সেসব কিছু করতে পারলেই আমরা বিপ্লব করে ফেলেছি। একথা আমি আগেও বলেছি, আবারও বলছি; অন্যায়টা সবার জন্যই অন্যায়। একজনের জন্য অন্যায় আর অন্যজনের জন্য ‘কুল’ নয়।
এই জাতীয় বিদ্রোহিনীদের মধ্যে আমি আর একটা জিনিস দেখেছি। জীবনে বেশ কয়েকবার মা-বাবাকে লুকিয়ে মদ-গাঁজা-সিগারেট খেয়ে ফেলেছি মানেই আমাদের জীবন ধন্য হয়ে গেছে। দেশোদ্ধার করে ফেলেছি…
-“আচ্ছা, তুই মাস্টার্সে ভর্তি হলি না কেন?”
-“না রে, বাড়ি থেকে মানছে না… ছেলে দেখছে বিয়ে দেবে বলে…”
ব্যাস? হয়ে গেল আপনার বিদ্রোহ? মা-বাপকে লুকিয়ে মদিরায় মগ্ন হতে পারলেন; আর পড়াশোনায় দাঁড়ি পড়ার কথা হলেই ‘ঠিক আছে’ ?
এরকম বেশ কিছু ‘বিদ্রোহিনী’-কে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম, যারা বাড়িতে মদের বোতল লুকিয়ে রাখতেন কিন্তু যে ভদ্র, সভ্য, স্বচ্ছল ছেলেটা তাকে প্রেম নিবেদন করল, তাকে ‘বাবা-মা মানবে না’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আবার আর একজন এতই উচ্চদরের রেবেল, যিনি একবার অকৃতকার্য হওয়ার পর দ্বিতীয়বার ‘ভয়ে’ উচ্চমাধ্যমিকে বসেননি, আর সিগারেট টানতে টানতে প্রমাণ করতেন তিনি কতটা ‘ডিপ্রেসড’।
যাই হোক, তাই আমার মনে হয় আমরা যত খেলো ভাবে ‘রেবেল’ কথাটা ব্যবহার করে থাকি, কথাটা সেরকম নয়, কথাটা অত্যন্ত গুরুগম্ভীর এবং কঠিন। একটু ভেবে দেখুন, দীপা কর্মকার থেকে মেরী কম, গীতা ফোগাত থেকে কিরণ বেদী, সকলেই কিন্তু প্রথা ভেঙ্গে, বাইরে এসে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাই তাঁরা লেজেন্ড বা লিভিং লেজেন্ড। কেউ কিন্তু জিজ্ঞাসাও করে না, ‘কোন ভারতীয় মহিলা প্রথম সিগারেট বা মদ খেয়েছিলেন বা কে প্রথম ব্রা-এর স্ট্র্যাপ বের করে রাস্তায় হেঁটেছিলেন। দু’টো জিনিস যদি পাশাপাশি তুলনা করার চেষ্টা করেন, তাতেই হাসি পাবে। তুলনা করা তো দুরের কথা। তাই, হে আমার আঁতেল মামনিরা, আপনারা কিছুই উৎপাটন করিতে পারেন নাই। এবং চিৎকার থামাইয়া, কিঞ্চিৎ মূত্র বিসর্জন করিয়া, ঘুমাইয়া পড়ুন…
(অ)শান্তির আশায়…
নীল…
ভালো…
LikeLike