নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস,
শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস —
বিদায় নেবার আগে তাই
ডাক দিয়ে যাই
দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে
প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে।
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমি যে কিরকম ফুটেজ খেতে পারি, সেটা গত এক-দেড় বছর ধরে লোকে ভালোই দেখতে পাচ্ছে; কিন্তু গত দু’দিন ধরে অনেক কিছু দেখার পর, আজ লিখতে বসতে সত্যিই ভয় করছে।
১৪ই ফেব্রুয়ারি পুলওয়ারার ঘটনা নিয়ে আদৌ কি হবে, কি হচ্ছে, মানে ভারতীয় সেনা কি নির্দেশ পাবে আর যুদ্ধ বাঁধবে কিন, এসব বিশ বাঁও জলে। যে যুদ্ধ বাঁধার, সেটা বেধে গেছে। সে বিহারে কাশ্মীরি বিক্রেতাদের দোকান ভাঙচুর থেকে শুরু করে কলকাতায় লোকজন কার বাড়িতে জড় হয়ে বাড়িতে ভাঙচুর করে, তাঁকে নাক খত দিয়ে ‘ভারত মাতা কি জয়’ বলানো। একটা দেশের লোক, দেশের লোকের বিরুদ্ধে চড়াও হচ্ছে, তারা নাকি দেশদ্রোহী তাই…
আচ্ছা, দেশদ্রোহের সংজ্ঞা কি ? না, তার চেয়ে বরং দেখা যাক, দেশপ্রেমের সংজ্ঞা কি। দেশপ্রেমের সংজ্ঞা হল এমন জিনিস, যেটা দিনে দিনে ক্ষণে ক্ষণে বদলে যায়। এই মুহুর্তে দেশপ্রেমের সংজ্ঞা কি ?
১। পাকিস্তান ধ্বংস হোক বলতে হবে দু বেলা।
২। পাকিস্তানের সরকার কে মা-বোন তুলে গালি দিতে হবে দু বেলা।
৩। নিজেকে দেশের সীমান্তে কল্পনা করে, ভারত পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর মাঝে রেফারি মনে করে, তারস্বরে চিল্লাতে হবে, ‘লেগে যাক নারদ নারদ’।
৪। এবং নির্দ্বিধায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমস্ত কার্যকলাপকে সমর্থন করতে হবে।
এটা এখনকার জন্য। ক্রিকেট বিশ্বকাপ শুরু হলে, ভারত ছাড়া অন্য কোনো দলকে সমর্থন করলেই আপনি দেশদ্রোহী। এবং প্রকাশ্য দিবালোকে আপনার ছাল তুলে, মুখ সেলাই করে দিলেও সেটাই সংবিধান।
মাইরি ! ইংরেজ আমলেও এত দেশদ্রোহী ছিল কিনা কে জানে।
কিন্তু না… এসব লেখা যাবে না… প্রাণের ভয় আছে তো… আমার না, আমার নিজের না, আমি তো দিল্লীতে বসে আছি, এখন আমার বাড়িতে যদি লোকজন চড়াও হয়, আমার মা-বাবার নিরপত্তা নিয়ে ভয় পাচ্ছি আমি বইকি।
এখন আমি যদি বলি, ভারতীয় সেনা আমার বাড়ির চাকর নয়, কারণ আমি কি বললাম বা না বললাম, সেটার ওপর নির্ভর করে তারা কালই লাহোরে গিয়ে একখানা অ্যাটম বম্ব ফেলে দিয়ে আসবে। -তাহলে আমি দেশদ্রোহী…
আরে মশাই, চকোলেট বোমার শব্দে আমার জিনিসপত্র মাথায় উঠে যায়, আমি কোন সাহসে অন্য একজন কে বলব,
-“যা না, টুপ করে বোমাটা ফেলে দিয়ে চলে আয়…” ?
উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় দেশ হিসাবে ভারতের সেনাবাহিনীর ওপর আমার ভরসা, গর্ব, দুইই আছে। আজ যতজন জওয়ান শহীদ হলেন, তাঁদের মা-বাবা-ভাই-বোনের চোখের জল মোছাতে যাওয়ার সাহস, বা ক্ষমতা কোনোটাই আমার নেই।

তাই না, আমি অন্যের বাবা, অন্যের ছেলে, অন্যের ভাইকে যুদ্ধে যেতে বলতে পারব না। কারণ আমি বিশ্বাস করি,
“An Eye for An Eye, makes the whole world blind…”
আমার তো মনে হয় ‘জাতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত’ ৩৩০০ কোটি টাকার স্টাচুটাকে সীমান্তে পাঠিয়ে দেওয়া হোক… যুদ্ধ করুক…
এই রে ! কেউ আবার দেশদ্রোহী ভাবল না তো? এখন আমি যদি ভুল করে বলে ফেলি, ওরকম একটা আখাম্বা মূর্তি না বানিয়ে টাকাটা যদি সি আর পি এফ ওয়েলফেয়ারে লাগানো যেত, তাহলে তো লোকে নিশ্চই আমাকে দেশদ্রোহী ভাববে, ১০০%…
আর ধর্ম নিয়ে আমি কিছু লিখলামই না… মানে লেখার সাহসই নেই…
কিন্তু ব্যাপারটা যে আদতে কি, সেটা লেখার শুরুতেই লিখে দিয়েছি। বিশ্বকবির কথা। তা এরকম বিষাক্ত পরিবেশে শুধু শান্তি কেন, কোন কথাই কেউ ঠান্ডা মাথায় শুনতে রাজি নয়। সবাই হাতে স্ট্যাম্প নিয়ে বসে আছে, ছাপ্পা মারতে; কে দেশদ্রোহী, আর কে দেশপ্রেমী।
লেখাটা শুরু করার আগে তাই ভয়ে ভয়ে ফোন করলাম কলকাতা পুলিস কে, যদি কিছু প্রোটেকশনের ব্যবস্থা করা যায়…
-“হ্যালো ! লালবাজার ?”
-“হ্যাঁ, বলুন…”
-“বলছি আমার বাড়িতে একটু প্রোটেকশনের ব্যবস্থা…”
-“না মশাই, ওসব হবেটবে না… এখন বিস্তর কাজ। সিনেমা হলে হলে ঘুরতে হচ্ছে…”
-“সে কি ? কেন ? আপনারা আজকাল ফেবু পেজে সিনেমার রিভিউ টিভিউ…”
-“না মশাই না… ১৮৭৬ সালে ‘নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রন আইন’ করেছিল না? তা সেটার ১৪২ বছর অ্যানিভার্সারিতে, দিদি সেটা আবার চালু করছেন; শুরু হচ্ছে ওই অসভ্য লোকটা, মাওবাদী, সিপিএমের ক্যাডার, অনীক দত্তর সিনেমা বন্ধ করে…”
-“বলেন কি মশাই ! এ তো একেবারে বিপ্লব ঘটে গেল দেখছি !”
-“এই আপনি কে মশাই ? বিপ্লব-টিপ্লব বলছেন… আপনিও মাওবাদী?’
আমি আর কথা বাড়াইনি, ফোন রেখে দিয়েছি।

হাসব না কাঁদব ভেবে পাইনি…
না কি প্রিয়নাথ মল্লিকের মতো চিৎকার করে বলব-
“বাংলা সিনেমার টিনের তলোয়ারের ভয়ে শাসক কাঁপছে, এট আমাদের কতবড় জয় বলুন তো?”
একজন ভদ্রলোককে সত্যিকথা বলার জন্য, আজ তার ওপর রাগ মেটাচ্ছেন হেডঅফিসের দিদিমনি। আর আমি যখন বলেছিলাম মেঘনাদবধ রহস্য-কে চলতে দেওয়া হল না, কে একজন তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করেছিলেন। যাই হোক। আজ আবার প্রমাণ হয়ে গেল, সত্যিই পরিবর্তন আসেনি। যাঁরা পা চাটতে এক্সপার্ট, তাদের থুতুর অভাব হচ্ছে না, আর যারা সেটা পারছেন না, তার লাথি খেয়েই বেড়াচ্ছেন।
আসলে কি বলুন তো, ভারতীয় মা-বাবারা নীজের সন্তানদের স্পুন-ফীড করান, আর তাই বড় হয়ে সবারই অন্যদের স্পুনফীড করার ইচ্ছে জাগে। তাই তো বার বার, এই সিনেমা দেখো না, ওই গান শুনো না, অন স্ক্রীনে চুমুও খেও না থেকে শুরু করে ছোট জামা পোড়ো না অবধি চলে আসে।
না মশাই… যুদ্ধ চাই। স্বাধীনতার যুদ্ধ। স্বাধীনতা আজ বাহাত্তুরে বুড়ো, তাই আজ আবার স্বাধীনতা কেড়ে নিতে হবে… কথা বলার স্বাধীনতা, সিনেমা দেখার স্বাধীনতা… যেকোনো ধর্মের হয়েও, যে কোনো রাজ্যের হয়েও শান্তিতে বাঁচার স্বাধীনতা… নীজের হাতে পায়ে, ছোট ছোট অসংখ্য বেড়ী পড়ে, যদি চিৎকার করি ‘সীমান্তে যুদ্ধ চাই’ ‘প্রতিশোধ চাই’ তাহলে লোকে আমাকে দেশদ্রোহী বলবে না…
জোকার বলবে… ভাঁড় বলবে…
(এখনো) শান্তির আশায়…
নীল…
‘তাই আজ আমারো বিশ্বাস, “শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।” তাই আমি চেয়ে দেখি প্রতিজ্ঞা প্রস্তুত ঘরে ঘরে, দানবের সাথে আজ সংগ্রামের তরে॥’
রবীন্দ্রনাথের প্রতি
সুকান্ত ভট্টাচার্য
ছাড়পত্র
LikeLiked by 1 person
এই সংগ্রামের আসাটা করতেও ভয় করে আজকাল…
LikeLike
মতামত কবির ব্যক্তিগত
LikeLiked by 1 person